দক্ষিণ ও উত্তরের রাজ্যগুলির মধ্যে কর বণ্টনের ফারাক আর ভবিষ্যৎ লোকসভায় প্রতিনিধিত্বের সম্ভাব্য ফারাক যে চিন্তাজনক পরিস্থিতি তৈরি করছে বা করতে চলেছে, সেটি সঠিক ধরেছেন শাশ্বত ঘোষ তাঁর ‘কম জনসংখ্যার বিপদ’ (৬-১১) প্রবন্ধে। তবে উপযুক্ত পরিপ্রেক্ষিতের অভাবে বিষয়টির গুরুত্ব যথাযথ ভাবে ধরা পড়েনি। সাধারণ ভাবে একটি যুক্তরাজ্যের মধ্যে ধনী রাজ্যগুলি পরোক্ষে পিছিয়ে থাকা রাজ্যগুলিকে সহায়তা দেবে, কর বণ্টন সাম্যের সেই নীতিতে কারও আপত্তি হতে পারে না। প্রশ্ন দ্বিতীয় নীতিটিকে নিয়ে, যার নাম দক্ষতা (এফিশিয়েন্সি)। যে সূচকগুলির ভিত্তিতে এই কর বণ্টন হয়, তা যদি প্রায় ৩০ বছর ধরে একটা অদক্ষ ব্যবস্থাকে সমর্থন করে আসে, যেখানে কিছু রাজ্য জনসংখ্যা স্থিতিশীল করার খেসারত দেবে আর কিছু রাজ্য তা না করতে পারার জন্য ‘পুরস্কৃত’ হতেই থাকবে, তা হলে কর বণ্টনের ভিত্তির প্রশাসনিক নৈতিকতা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। এখন এই প্রশ্নটা আরও প্রাসঙ্গিক কারণ জিএসটি আসার ফলে রাজ্যগুলির কর বসানোর যে সীমাবদ্ধ ক্ষমতা ছিল, সেটিও লুপ্ত। ফলে কেন্দ্রের উপর নির্ভরতা আরও বেড়ে গিয়েছে। পাশাপাশি ১৪তম অর্থ কমিশন রাজ্যগুলিকে বণ্টনযোগ্য করের ৪২ শতাংশ দেওয়ার যে সুপারিশ করেছিল, গত দশ বছরে কেন্দ্র নানা সেস বসিয়ে সেই অনুপাত কার্যক্ষেত্রে অনেকটাই কমিয়ে ফেলেছে, কারণ রাজ্যগুলিকে সেস-এর ভাগ দিতে হয় না।
প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নটিও রাজ্যগুলির যুক্তরাষ্ট্রীয় (ফেডারাল) ক্ষমতার সঙ্গে জড়িত। লোকসভায় কোন রাজ্যের কত প্রতিনিধি হল, সেটা রাজ্য চালনার ক্ষেত্রে বড় প্রশ্ন হয়ে ওঠে না, যদি লোকসভা ও কেন্দ্রীয় সরকার দেশের সামগ্রিক বিষয়গুলির (যেমন ব্যাঙ্কিং, কারেন্সি, বিদেশ নীতি, প্রতিরক্ষা নীতি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ইত্যাদি) জন্য নিজেদের সময় ব্যয় করে, আর বাকি সব কিছু স্থানীয় ও রাজ্য স্তরের সরকারগুলির উপর ছেড়ে দেয়। উপরোক্ত বিষয়গুলিতে সব রাজ্যের স্বার্থই এক। আমাদের দেশে ঠিক তার উল্টো হয়েছে। গ্রামে-শহরে শৌচাগার তৈরি, বা গরিবদের ঘর তৈরি করে দেওয়ার কাজটিও কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে। এই অবস্থায় প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নটি বা কর বণ্টনের প্রশ্নটি বিশেষ রাজনৈতিক মাত্রা পায়।
তামিলনাড়ুর মতো রাজ্য, যার মাথাপিছু আয় তিন লক্ষ টাকার বেশি, আর বিহার যার জনপ্রতি আয় ৬০ হাজার টাকা, এই দুই রাজ্যের দৃষ্টিভঙ্গি বিপরীতমুখী হয়ে যায়। এর মূলে রয়েছে কেন্দ্রীকরণের অর্থনীতি ও রাজনীতি, যার শুরু ইন্দিরা গান্ধীর সময় থেকে। এখন তা এক নিকৃষ্ট রাজনৈতিক মাত্রা পেয়েছে।
অশোক সরকার, আজ়িম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়
সংখ্যার বিপদ
‘কম জনসংখ্যার বিপদ’ প্রবন্ধ প্রসঙ্গে এই চিঠি। ২০২৬ সালে জনগণনার কাজ শেষ হলে এবং জনসংখ্যার ভিত্তিতে সংসদের আসন-সংখ্যার পুনর্বিন্যাস হলে, সংসদের আসন-সংখ্যা বর্তমানের ৫৪৩ থেকে বেড়ে হবে ৭৫৩। তখন উত্তরপ্রদেশ, বিহার, রাজস্থান এবং মধ্যপ্রদেশের আসন সংখ্যা বাড়বে সর্বমোট ১৫০টি। এই রাজ্যগুলির সন্তান উৎপাদনের গড় দেশীয় গড়ের চেয়ে অনেকটাই বেশি। দক্ষিণের পাঁচটি রাজ্যে সে সংখ্যা সাকুল্যে বাড়বে ৩৫টি, আর পশ্চিমবঙ্গে ১৮টি। তখন সরকার গড়তে, সরকারি নীতি তৈরি করতে, আমাদের ভোট আর দরকার পড়বে না। উত্তর এবং উত্তর-পশ্চিম ভারতের রাজ্যগুলোই তখন ঠিক করবে, এই দেশ কী ভাবে চলবে।
২০২১-২২ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় করে ১ টাকা তুলে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ ফেরত পেয়েছে ৮৭ পয়সা মাত্র। ও-দিকে সেই ১ টাকার অনুপাতে বিহার ফেরত পেয়েছে ৭ টাকা। অর্থাৎ, যারা সুষ্ঠু জনসংখ্যার নীতি মানল না, তারা পুরস্কৃত হল। তাদের অতি-উৎপাদনের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে হল সেই সব রাজ্যকে, যারা জনসংখ্যার নিয়ন্ত্রণ সুষ্ঠু ভাবে করেছিল।
এই জনসংখ্যা বিন্যাসের অপর কুফল— সংখ্যাগুরুবাদ। যার প্রভাবে দেশের আইন এবং শাসনবিভাগে কিছু রাজ্যের জমিদারি তৈরি হয়েছে। বাঙালি ও বাংলা স্বাধীনতা আন্দোলনে যত রক্ত দিয়েছিল, সে তো অধীন প্রজার মতো থাকার জন্য নয়। অন্যের তৈরি করা মানদণ্ডে পাশ করে কেন বাঙালিকে প্রমাণ দিতে হবে যে সে ভারতীয়? এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে বাঙালিকে।
ইন্দ্রনীল মণ্ডল, কলকাতা-১৬
মাসুলে সংস্কার
শাশ্বত ঘোষ তাঁর তথ্যপূর্ণ প্রবন্ধের এক জায়গায় বলেছেন, কেন্দ্রীয় করের পুনর্বণ্টনের ক্ষেত্রে আমূল সংস্কারের প্রয়োজন। করের অনুভূমিক হস্তান্তরের সংস্কারের একটা উপায় হিসাবে তিনি বলেছেন, বণ্টনের অনুপাত নির্ণয়ে জনসংখ্যার গুরুত্ব একটু কমিয়ে, জনসংখ্যা কমানোর কৃতিত্ব এবং তার সঙ্গে অন্যান্য সামাজিক সূচকের গুরুত্ববৃদ্ধি। অথচ, প্রবন্ধকার জনসংখ্যা বৃদ্ধির নিম্নগতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন, বিশেষত এই রাজ্যে। বিষয়টা স্পষ্ট হল না।
শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় করের পুনর্বণ্টনের সংস্কার নয়, মাসুল সমীকরণে সংস্কার খুব জরুরি এই রাজ্যের পক্ষে। অন্যান্য রাজ্যের পণ্যের মতো পশ্চিমবঙ্গ ও পার্শ্ববর্তী রাজ্যে লোহা, কয়লায় মাসুল সমীকরণে বৈষম্য এনেই ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বহু দিন ধরে পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলি এই নিয়ে সরব হলেও কেন্দ্রে বন্ধু বা বিরোধী কোনও সরকারই কর্ণপাত করেনি। প্রবন্ধকারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০৩৬ সালে পশ্চিমবঙ্গে অর্ধেকের বেশি জনসংখ্যা কর্মক্ষম বয়সের মানুষের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। ফলে কর্মক্ষম মানুষের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো প্রয়োজন। তার জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কাজের বাজার-সহ অন্যান্য আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামো বাড়ানো প্রয়োজন। আবার জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে যদি জোর দেওয়া হয়, তবে হয়তো কর্মক্ষম মানুষের উপর চাপ কমবে, কিন্তু সামগ্রিক ভাবে উৎপাদন বৃদ্ধি ঘটাতে হবে। সে ক্ষেত্রে পরিবেশের উপর পূর্বের চেয়েও বেশি চাপ পড়বে। তাতেও বিপদ কম নয়।
এক সময়ে গ্রামাঞ্চলে দরিদ্রদের জন্মহার বেশি ছিল। সেটা শুধুমাত্র তাঁদের অশিক্ষার জন্য নয়। একান্নবর্তী পরিবারে উপার্জনক্ষমের সংখ্যা বাড়লে রোজগার বাড়ে এবং নির্ভরশীলদের অনুপাত কমে আপাতভাবে দারিদ্রের কিছুটা সুরাহা হয়। দরিদ্র মানুষের কাছে সেটা একটা বড় কথা। তখন অবশ্য পরিবেশ সঙ্কট আজকের মতো প্রকট ছিল না।
সুতরাং, জনসংখ্যা বৃদ্ধির ভাবনায় সাবধানি হতে হবে। সব রাজ্যে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার সমান না হওয়ায় এত বছরে প্রতি রাজ্যের আসনপিছু ভোটার ব্যবধান যথেষ্ট হওয়ার কথা। সে ক্ষেত্রে রাজ্যপিছু আসন-সংখ্যা সমান হারে বাড়ালে ব্যবধান হয়তো ঘুচবে না, কিন্তু অনেকটাই কমবে। পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনে আসনপিছু ভোটার সংখ্যা সর্বত্র সমান নয়। তা ছাড়া ভোটের সংখ্যার নিরিখে সাংসদের ওজন নেওয়া নেহাতই সংখ্যার প্রতি অতিদুর্বলতা। তার জন্যে গণতন্ত্র ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর বিরূপ প্রভাব পড়তে দেওয়া যায় না।
দুর্গেশ কুমার পান্ডা, সোনারপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
দামের দাপট
পেঁয়াজের দাম ক্রমশ সেঞ্চুরির দিকে এগোচ্ছে। সংবাদে দেখলাম রাজ্যের কৃষি উপদেষ্টা তথা পঞ্চায়েত মন্ত্রী বলেছেন, এখানে পেঁয়াজ চাষ বাড়ানোর সঙ্গে, সংরক্ষণের উপরেও জোর দেওয়া হচ্ছে। উত্তম কথা। আশা করব, এক শ্রেণির ফড়ের দাপটে লাগামছাড়া দাম সরকারের নজরদারিতে এনে এবং বড় বড় বাজারে টাস্ক ফোর্স গঠন করে কড়া হাতে দমন করা হবে। তবেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে মধ্যবিত্ত।
গৌতম মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-১০১