অতনু বিশ্বাসের ‘পণ্য হল যা কিছু আজ...’ শীর্ষক প্রবন্ধের (১৪-১১) পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল মানুষের জীবনের দুটো প্রধান পরিসরের কথা বলেছিলেন। একটি সামাজিক পরিসর, যা ব্যক্তির রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গে যুক্ত আর অপরটি ব্যক্তিগত পরিসর, যা ব্যক্তির পরিবারকেন্দ্রিক জীবন নিয়ে গঠিত হয়। ইংরেজ দার্শনিক জন লকও মানুষের জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির অধিকারের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন এবং দেশের সরকারের এই প্রয়োজনীয় অধিকারগুলো সুনিশ্চিত রাখা উচিত বলেছিলেন। এর পরে হেগেল, জন স্টুয়ার্ট মিল-এর মতো দার্শনিক জনগণের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষায় সরকারের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। দার্শনিক জেরেমি বেন্থাম এক ধাপ এগিয়ে দেশের ‘আইন’কেই মানুষের ‘ব্যক্তিগত পরিসরের উপর এক প্রকার আক্রমণ’ হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন।
যুগের পরিবর্তন, বিশেষ করে ইন্টারনেটের প্রচলন এই সব ‘প্রাইভেসি’-র ধারণা ও গুরুত্বকে একেবারে বদলে দিয়েছে, একেবারে খাদের ধারে এনে দাঁড় করিয়েছে। ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো তো আধুনিক যুগের সরকারি নজরদারির (কারাগার-সুলভ) সম্ভাবনা প্রসঙ্গে বলেই ফেলেছিলেন, কয়েদিদের পক্ষে কারা-নিয়ম মান্য করা ছাড়া অন্য কোনও পন্থাই আজ আর নেই। আজ আমরা চাই বা না চাই, ব্যক্তিগত জীবন বলতে মানুষের কাছে খুব বেশি কিছু আর অবশিষ্ট নেই। গত শতাব্দীতেই জর্জ অরওয়েল নাইনটিন এইট্টি ফোর উপন্যাসে এ সব দিক দেখিয়ে দিয়েছেন। সেখানে ‘বিগ ব্রাদার’-এর নেতৃত্বে একটা ক্ষমতাসীন সর্ব-নিয়ন্ত্রক দল গণ-নজরদারি, বাক ও চিন্তা-ভাবনার স্বাধীনতার সীমায়িতকরণের মাধ্যমে তার ক্ষমতা জারি রেখেছে।
এখন দিনকাল অন্য রকম। যেখানে ‘একটা ফোন নম্বরই মন্থন করতে পারে অভাবনীয় তথ্যভান্ডার’, সেখানে নিজেদের সতর্ক থাকা খুব জরুরি। আর কোন সরকারই বা চাইবে না নজরদারির এই সুযোগ হাতছাড়া করতে। তা ছাড়া আজকের সমাজে বিভিন্ন প্রয়োজনে ফোন নম্বরের মতো একটা জরুরি ব্যক্তিগত তথ্য ‘শেয়ার’ করা ছাড়া অন্য উপায় কি কিছু আছে?
গৌতম নারায়ণ দেব, কলকাতা-৭৪
মানবপণ্য
‘পণ্য হল যা কিছু আজ...’ প্রবন্ধে প্রবন্ধকার মতপ্রকাশ করেছেন, ‘প্রাইভেসি’ কোনও বানিয়ে তোলা ধারণা নয়, অন্তস্তলে প্রোথিত এক আকাঙ্ক্ষা, যা সম্পৃক্ত হয়ে রয়েছে মানুষের মজ্জায়। এই কথা মানতে একটু অসুবিধা হচ্ছে। আদিম মানবের ‘প্রাইভেসি’ ছিল না। প্রধান কারণ যৌনতা ও সম্পদ ব্যক্তিগত হয়নি। জীবজগতে মানুষ একমাত্র প্রাণী, যে দ্বিতীয় সাঙ্কেতিক স্তরের মাধ্যমে কথা বলার ক্ষমতা অর্জন করেছে। আর মূলত এই কথার মাধ্যমে এবং জৈব রাসায়নিক ও উন্নত স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে ‘অন্তস্তলে প্রোথিত’ হয়ে ‘প্রাইভেসি’ ধারণাটি ‘বানিয়ে তুলেছে’ ও তা মজ্জায় ‘সম্পৃক্ত’ হয়েছে। প্রাণিজগতের ইতিহাসে কোনও কিছুই শূন্য থেকে শুরু হয়নি। শ্রম, উৎপাদন থেকে পণ্য উৎপাদনেরও ইতিহাস আছে। প্রাইভেসি ও পণ্যের ইতিহাসের মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক আছে। তা বুঝতে ‘প্রাইভেসি’, ‘পণ্য’— কার নির্মাণ, কী ভাবে হয়, সেটা জানতে হবে, তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ করতে হবে।
প্রবন্ধকার প্রাইভেসি ও পণ্যের বিবর্তনে সমাজবিজ্ঞানীদের নানা ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ হাজির করেছেন। এই সব মতবাদে প্রাইভেসি ও পণ্য ব্যবস্থার সম্পর্ক আরও জটিল হয়েছে। শিশুর জন্মের পর থেকে তাকে কেন্দ্র করে সমাজব্যবস্থা ও বাজারব্যবস্থার সৌজন্যে সে পণ্য হয়ে যেতে থাকে। যার জন্য তার চুরি যাওয়ার ভয়, নানা রকম ক্ষতির ভয়ও বাড়ে। শিশুকে তাই যথাসাধ্য প্রাইভেসি, নিরাপত্তার ঘেরাটোপের মধ্যে বড় করতে হয়। ঝুঁকি কমাতে শিশুর হাতে নেটওয়ার্ক-সহ আধুনিক গ্যাজেট তুলে দেওয়া হয়। এ ভাবে শৈশব থেকে নিরাপত্তার সঙ্গে বোঝাপড়া চলে। শিশু থেকে বৃদ্ধ— সকলেই পণ্য হয়ে যান।
এত দিন মানবপণ্যের যৌনতা, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও অর্থসম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ সবচেয়ে ঝুঁকিপ্রবণ ছিল। প্রাইভেসিও ততটাই মূল্যবান ছিল। ক্রমশ যন্ত্রের কৃত্রিম মেধা ও সেটির সুবিধাভোগীরা এই জায়গা গোলমাল করে দিচ্ছে। এত দিন মানুষের বোধ, জ্ঞান, প্রজ্ঞার মাধ্যমে ঝুঁকির মোকাবিলা করা যাচ্ছিল। কিন্তু এখন যেন ভূপেন হাজরিকার গানই সত্য হয়ে উঠছে, মানুষ মানুষকে পণ্য করে।
শুভ্রাংশু কুমার রায়, চন্দননগর, হুগলি
বিষময়
বর্তমান সময়ে ভারতের কর্মক্ষেত্রে, প্রধানত বেসরকারি ক্ষেত্রে কর্মসংস্কৃতির চূড়ান্ত অবনমন ঘটে চলেছে। কর্পোরেট কালচারের নামে এক রকম অনৈতিক কর্মী শোষণ ঘটে চলেছে প্রায় সর্বত্র। মাত্রাতিরিক্ত কাজের বোঝা ছাড়াও দৈনিক অতিরিক্ত কিছু ঘণ্টা শ্রম করানো, পাওনা ছুটি না দিতে চাওয়া, ছুটির দিনে অফিসে ডেকে বা বাড়ি থেকে অনলাইনে কাজ করানো— এ সব এখন জলভাত হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনও কর্মী যদি এই সবের সঙ্গে মানিয়ে নিতে না চান, তা হলে তাঁর কপালে জুটতে পারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অবজ্ঞা। ফল, যোগ্যতার চেয়ে নিম্নমানের কাজ পাওয়া, কাজের মূল্যায়ন কমে যাওয়া যাতে বাৎসরিক বেতনবৃদ্ধি কম হয় এবং আরও নানা রকম মানসিক হেনস্থা। বেতন বৈষম্যের কথা নাহয় বাদই দিলাম, একই গ্রেডে বিভিন্ন দফতরের কর্মীদের বেতনের অস্বাভাবিক প্রকারভেদ বিস্মিত করে। ইন্টারনেটে ভাইরাল হওয়া এ রকম প্রচুর খবর দেখা যায় যেখানে কর্মী অধস্তন কর্মচারীদের বিশ্রী ভাষায় শাসাচ্ছেন, কোথাও অতিরিক্ত কাজের চাপে কোনও কর্মীর কর্মস্থলে অকালমৃত্যু ঘটছে, কোথাও কেউ আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন।
কিছু শিল্পপতি আর তরুণ উদ্যোগপতি আবার নিজেদের স্বার্থে অতিরিক্ত শ্রমের পক্ষে সওয়াল করছেন। সাম্প্রতিক কিছু সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, বিষাক্ত কর্মসংস্কৃতির মানদণ্ডে ভারতের অবস্থা শোচনীয়। এ তো অনেকটা সবার গা-সওয়াও হয়ে গিয়েছে। যে-হেতু স্থায়ী বেসরকারি চাকরি বলে সে ভাবে কিছু হয় না, কর্মীরা চাকরি বাঁচানোর জন্যই এগুলো সহ্য করে টিকে থাকতে বাধ্য হন। এমন অবস্থার মূল কারণ হল শ্রম মন্ত্রক-সহ অন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলির ঔদাসীন্য। কোনও অঘটন ঘটলেই কিছু দিন আলোড়ন পড়ে মাত্র, তার পর যে কে সেই। আশঙ্কার বিষয় এই যে, ভারতের বর্তমান দক্ষিণপন্থী সরকার শ্রম আইন সংস্কারের নামে বকলমে কর্মীদের আরও কোণঠাসা করে পুঁজিপতিদের হাত শক্ত করতে চাইছে, শ্রমিক সংগঠনগুলির চাপে যা আপাতত ঠেকনা দিয়ে আটকানো গিয়েছে। তবে বামপন্থী শ্রমিক সংগঠনগুলি প্রধানত সরকারি কর্মীদের এবং বেসরকারি ক্ষেত্রে কায়িক শ্রমিকদের সংগঠিত করার কাজ করে, কিন্তু বেসরকারি যে সব কর্মীরা মানসিক শ্রম করেন, তাঁদের প্রতি সংগঠনকে তেমন সাহায্যের হাত বাড়াতে দেখা যায় না। এক জন সরকারি কর্মী, যাঁর বেতনের উপর খুচরো মূল্যবৃদ্ধি সূচক খুব একটা প্রভাব ফেলে না, তাঁর ডিএ বাড়ানোর জন্য বামপন্থীদের যতটা দরদ দেখা যায় তার সিকিভাগও কি দেখা যায় কোনও বেসরকারি কর্মীর ক্ষেত্রে? তাঁদের তো কোনও ডিএ-ই নেই, উপরন্তু বছরের পর বছর কোনও বেতনবৃদ্ধি হয় না বা হলেও তা যৎসামান্যই হয়!
বেসরকারি কর্মীদের সুরাহার জন্য সব রকমের বেসরকারি সংস্থা, ব্যাঙ্ক, বিমা সংস্থা ইত্যাদির উপর রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রম মন্ত্রকের এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার শক্ত রাশ থাকা দরকার। কোনও কর্মী যদি নিয়োগকর্তার বিরুদ্ধে কোনও বিষয়ে শ্রম দফতরে অভিযোগ জানাতে চান এবং তার যাতে সন্তোষজনক বিহিত হয়, তার পদ্ধতিরও সরলীকরণ করা দরকার। এ বিষয়ে বামপন্থী-সহ অন্য শ্রমিক সংগঠনগুলোর সদর্থক ভূমিকার প্রত্যাশা রইল।
দেবজিৎ ঘোষ, কলকাতা-৩৮