RG Kar Protest

সম্পাদক সমীপেষু: নাগরিকের পুনর্জন্ম

ঝড়, জল ও নানা ধরনের চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করে দিনের পর দিন এক ঝাঁক মেধাবী ছেলেমেয়ে রাস্তায় পড়ে থেকেছেন, নিছক ব্যক্তিগত কোনও লাভের আশায় নয়, বরং এক সহপাঠীর মর্মান্তিক মৃত্যুর বিচার চেয়ে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৫:১২

অভিরূপ সরকারের ‘কে ভাই কে দুশমন’ প্রবন্ধটির (২২-১১) সঙ্গে সহমত হতে পারলাম না। দশ দফা দাবির সব ক’টি আদায় হয়নি মানেই আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে, তা কিন্তু নয়। এই আন্দোলন থেকে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির বরং কিছু উল্লেখযোগ্য প্রাপ্তি ঘটেছে। আর জি করে নির্যাতিতার জন্য ন্যায়বিচার যে দু’-তিন মাস বা ছ’মাসের মধ্যে আদায় হওয়ার মতো সহজ বিষয় নয়, সে কথা এ দেশের বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা যে কোনও মানুষই বোঝেন। এই দাবিটি থেকে জুনিয়র ডাক্তাররা ভবিষ্যতেও সরে আসবেন বলে মনে হয় না। মনে রাখা দরকার যে, মৃতার বাবা-মায়ের অনুরোধেই তাঁরা আমরণ অনশন প্রত্যাহার করেছিলেন। আর, অনশন তুলে নেওয়ার পরেও জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন কিন্তু চালু আছে। ইতিমধ্যেই সিবিআই দফতরে অভিযান হয়েছে। দেরি হওয়ার চিঠি লেখা হয়েছে রাজ্য সরকারকেও। বোঝাই যাচ্ছে যে, জুনিয়র ডাক্তাররা সহজে রাজপথ ছাড়বেন না।

Advertisement

আর একটি বড় অর্জন হল, এই আন্দোলন পশ্চিমবঙ্গের মানুষের ভয় অনেকাংশে ভাঙতে পেরেছে। এ রাজ্যের কোণে কোণে দীর্ঘ দিন ধরে সযত্নে লালিত হুমকি সংস্কৃতিকে প্রকাশ্যে এনেছে। ঝড়, জল ও নানা ধরনের চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করে দিনের পর দিন এক ঝাঁক মেধাবী ছেলেমেয়ে রাস্তায় পড়ে থেকেছেন, নিছক ব্যক্তিগত কোনও লাভের আশায় নয়, বরং এক সহপাঠীর মর্মান্তিক মৃত্যুর বিচার চেয়ে। পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক পরিসরটিকে পুনর্জীবিত করা এই আন্দোলনের সবচেয়ে বড় দান। বিগত কয়েক বছরে দলীয় রাজনীতির বাইরে বিশুদ্ধ ‘অরাজনৈতিক’ নাগরিক পরিসর নামক কোনও ক্ষেত্রের অস্তিত্ব পশ্চিমবঙ্গে ছিল না।

তৃণমূল কংগ্রেসের প্রবল সমর্থকও নানা ভাবে জুনিয়র ডাক্তারদের এই আন্দোলনের পাশে থেকেছেন। সাধারণ মানুষের এই সাড়া জাগানো অংশগ্রহণ ছাড়া জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনটি সাফল্যের পথে এগোতে পারত না।

প্রদীপ কুমার সেনগুপ্ত, ব্যান্ডেল, হুগলি

ব্যর্থ সিবিআই

আর জি কর নিয়ে আন্দোলন প্রসঙ্গে অভিরূপ সরকারের লেখা ‘কে ভাই কে দুশমন’ প্রবন্ধটি একটি প্রাসঙ্গিক বিশ্লেষণ। প্রবন্ধকারের মত, বড়সড় আন্দোলন করার আগে ঠিক করতে হয় শত্রুপক্ষ কারা। ঠিক কথা। কিন্তু এই আন্দোলনটিকে কি তেমন নির্দিষ্ট ছাঁচে ফেলা যায়? সেই আন্দোলন শুধুই বিরোধীরা বা শুধুই বামেরা করেছিলেন এটাও কি খুব সরলীকরণ নয়? তা ছাড়া, এই আন্দোলন যদি শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়ে না পড়ে থাকে, তা হলে তা-ই বা কেন হল না— এই বিশ্লেষণগুলিও জরুরি।

সিবিআই তদন্তের প্রসঙ্গে একটি কথা মনে করিয়ে দিই। সারদা, নারদা কাণ্ড, রবীন্দ্রনাথের নোবেল চুরি-সহ বহু তদন্তের ফলাফল আজও একই জায়গায় দাঁড়িয়ে। সেখানে দোষীর শাস্তির বিষয়টিও ধুলোর স্তূপের আড়ালে কেন রয়ে গেল, তার উত্তরই বা কে দেবে? সিবিআই কি এ সব ক্ষেত্রেও রহস্যভেদ করতে পেরেছিল?

সুদীপ মাইতি, কাঁথি, পূর্ব মেদিনীপুর

আন্দোলন চলবে

‘কে ভাই কে দুশমন’ প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা। রাজনৈতিক দলগুলি এমন ভাবে প্রচার করছে, যেন আন্দোলনে কোনও সাফল্যই আসেনি। সেটা ঠিক নয়। আন্দোলনের চাপে শেষ পর্যন্ত প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ ও টালা থানার ওসিকে সিবিআই গ্রেফতার করতে বাধ্য হয়। স্বাস্থ্য ভবনের সামনে আন্দোলনকারীদের কাছে এসে তাঁদের কথা শুনতে বাধ্য হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। ইতিপূর্বে কোনও মুখ্যমন্ত্রী এমন করেননি। মুখ্যমন্ত্রীকে তাঁর অবস্থান পরিবর্তন করে কলকাতার পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলকে অপসারণ করার সিদ্ধান্ত নিতে হয়। স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিকর্তা, স্বাস্থ্য অধিকর্তা ও ডিসি নর্থকেও অপসারণ করতে বাধ্য হন। হাসপাতালের অভ্যন্তরে ডাক্তার নার্স স্বাস্থ্যকর্মীদের, বিশেষত মেয়েদের সুরক্ষার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিকা মেনে টাস্ক ফোর্স গঠন করে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করার প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য হয় সরকার। সর্বোপরি জুনিয়র ডাক্তারদের এই আন্দোলন অভূতপূর্ব জনজাগরণ ও গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়েছে, যা আগামী দিনের গণআন্দোলনগুলিকে শক্তিশালী করবে। বড় কথা হল, আন্দোলনকারীদের স্বার্থ এবং শাসক রাজনৈতিক দল এমনকি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো, যারা কোনও না কোনও সময় ক্ষমতায় ছিল বা এখনও অন্যত্র ক্ষমতায় রয়েছে, তাদের উদ্দেশ্য আর আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্য এক নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর লক্ষ্য শাসকের গদি। কিন্তু আন্দোলনকারীদের আকাঙ্ক্ষা জনগণের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা, দুর্নীতি দূরীকরণ, হাসপাতালের পরিকাঠামোর উন্নতি, হুমকি-প্রথার অবসান, প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বার করে কঠোর শাস্তি প্রদান, যাতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে। ফলে দুই পক্ষের স্বার্থ একেবারেই আলাদা। কিন্তু প্রবন্ধকার কার কতখানি লাভ এই অঙ্ক মেলাতে গিয়ে বলেছেন আন্দোলন থিতিয়ে গিয়েছে। তাও ঠিক নয়।

স্বদেশি আন্দোলনের পর আজ পর্যন্ত কোনও গণআন্দোলনে নারীসমাজের এমন ঐতিহাসিক ভূমিকা দেখা যায়নি। এই অধ্যায়ও আগামী দিনের গণআন্দোলনগুলিকে অনুপ্রাণিত করবে। এমন কোনও ক্ষেত্র বাকি ছিল না যে অংশের মানুষ এই আন্দোলনে যোগ দেননি। গ্রামেও কিন্তু প্রভাব পড়েছিল। প্রবন্ধকারের কলমে এই দিকগুলি নিয়ে বিশেষ বিশ্লেষণ মিলল না। প্রকৃত আন্দোলন আজও জারি আছে। শাসক দল যদিও চায় না, আর জি কর নিয়ে আর কোনও আন্দোলন হোক। কথায় কথায় বলে— আর কেন, সব দাবি তো মেনে নেওয়া হয়েছে। সিবিআই তদন্ত করছে, সুপ্রিম কোর্টে বিচার চলছে। এই ভাবেই খানিকটা হাত ঝেড়ে ফেলতে চাইছে।

বিদ্যুৎ সীট,জগদল্লা, বাঁকুড়া

ক্ষোভ জমছে

অভিরূপ সরকারের মতে, প্রশাসনের প্রতি মধ্যবিত্তরা অসন্তুষ্ট, তাই আর জি করের ঘটনাকে সামনে রেখে এই ক্ষুব্ধ নগরবাসীরা তৃণমূলের বিরুদ্ধে একটা প্রতিবাদ, একটা বড়সড় আন্দোলন খাড়া করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, আমার মনে হয়, মধ্যবিত্তরা এই উদ্দেশ্য থেকে আন্দোলনে নামেননি, তাঁরা চেয়েছিলেন নারী নির্যাতনকারীদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তি দেওয়া হোক, যাতে ভবিষ্যতে মেয়েদের নৃশংস ভাবে জীবন দিতে না হয়। আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তাররাও এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই দীর্ঘ লড়াই করে যাচ্ছেন।

কিছু রাজনৈতিক দল অবশ্য ক্ষমতা থেকে বর্তমান শাসককে সরানোর উদ্দেশ্য থেকেই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু আন্দোলনকারী ডাক্তাররা তাদের সে সুযোগ দেয়নি। আন্দোলনে রাজনৈতিক রং ছিল না বলেই এত মানুষ প্রতিবাদে পথে নেমেছিলেন। রাজনৈতিক দলগুলির প্রতি মানুষের আস্থা ক্রমাগত চলে যাচ্ছে। আর একটি বিষয় হল, দুর্নীতি এবং নারী-নির্যাতনের মতো ঘটনা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যেই ঘটছে, সেখানে অন্য দল শাসনক্ষমতায় ছিল বা আছে। সকলেই রাজনৈতিক স্বার্থে প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করে যাচ্ছে। আর জি কর আন্দোলন এই পরিস্থিতির পরিবর্তন করতে চেয়েছিল, বিচারব্যবস্থার উপর কিছুটা আস্থাও রেখেছিল। কিন্তু এখন হতাশা ফিরছে।

ক্ষমতাসীনরা যে কোনও ভাবে আন্দোলনের বিস্তার কমিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। বিচারে দীর্ঘসূত্রতার মাধ্যমে সে কাজে তাঁরা অনেকটাই সফল হতে পেরেছেন। বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদছে। এ নিয়ে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ জমা হয়ে আছে, পরিস্থিতি পেলে কিন্তু তা আবার ফেটে পড়বে।

অনুরূপা দাস, পাঁশকুড়া, পূর্ব মেদিনীপুর

Advertisement
আরও পড়ুন