Education

সম্পাদক সমীপেষু: বিস্মৃত সোপান

দেশের যে সমস্ত সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ‘স্বশাসিত’ তকমা রয়েছে, তাদের শীর্ষেও বসে আছেন শাসক দলের প্রতিনিধিরাই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৩ অগস্ট ২০২২ ০৫:২৭

সুগত মারজিতের “আমাদের ‘মাথাব্যথা’ নেই” (২৭-৭) শীর্ষক প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিছু কথা। শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ করে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটির বিষয়টি সম্পর্কে দেশের অধিকাংশ মানুষ উদাসীন। শিক্ষাকে রাজনৈতিক পরিমণ্ডল থেকে দূরে রাখার সদিচ্ছা এ দেশের কোনও শাসক দেখাননি। দেশের যে সমস্ত সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ‘স্বশাসিত’ তকমা রয়েছে, তাদের শীর্ষেও বসে আছেন শাসক দলের প্রতিনিধিরাই। কোন শর্তে তা হলে শিক্ষা রাজনীতিমুক্ত হবে? প্রয়াত শিক্ষাবিদ রবিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায় এক বার মনে করিয়েছিলেন, শিক্ষা থেকে মধ্যমেধার মানুষগুলোকে সরিয়ে না দিলে কোনও শিক্ষাই সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছতে সক্ষম হবে না! অথচ, এখন শিক্ষায় মধ্যমেধার চাষ হয়, সেই চাষে পুষ্টি জোগানো হয়, দলের প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা নিযুক্ত হন। এই ব্যবস্থা আমরা স্বেচ্ছায় মেনে নিয়েও শিক্ষার অবমূল্যায়ন নিয়ে আসর মাতাই। রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের আরও বেশি সুযোগ করে দিই শিক্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করতে।

স্বাধীনতার পরবর্তী সময় থেকে যতগুলি শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়েছে, সেই কমিশন যে রিপোর্ট পেশ করেছে, তাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে প্রয়োগের ইচ্ছা আদৌ দেখা যায়নি। দেখা হয়েছে রাজনৈতিক লাভের অঙ্কের দিকটি। ফলত শিক্ষার মান ক্রমাগত নিম্নমুখী হয়েছে, সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিযোগী হিসেবে উঠে এসেছে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এখন তো অবস্থা আরও কাহিল। প্রাথমিক স্তর থেকেই মধ্যবিত্তের ভরসা নেই সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপর। এক দিনে ঘটেনি এই অনিষ্ট, খানিকটা ইচ্ছে করেই আহ্বান জানানো হয়েছে।

Advertisement

শেষ করব শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ পেশাতে সারা ভারতে সমস্ত সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খুঁটির জোরে চাকরি পাওয়া মানুষদের কথা বলে। কর্মজীবনের প্রারম্ভিক লগ্নেই অসততার পথ অনুসরণ করলে কোনও উত্তরণের পথই প্রশস্ত হয় না, এটুকু বোধের অভাব সমগ্র দেশের শিক্ষাকে, বিশেষ করে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংসের মুখোমুখি এনে ফেলেছে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের নিম্ন আয়ের মানুষ। অথচ, সমস্ত রাজনীতিটাই তাঁদের নিয়ে। তাঁরা না পারেন অর্থ খরচ করে উচ্চশিক্ষার সুযোগ নিতে, না পারেন অর্থ দিয়ে বাঁকা পথে শিক্ষক শিক্ষিকা হয়ে যেতে। দেশ জুড়ে গড়ে ওঠে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সাধারণ শিক্ষা থেকে কারিগরি শিক্ষা, এমনকি চিকিৎসক হওয়ার সুযোগ জুটে যায় মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে। পিছিয়ে পড়া মানুষেরা ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে যান, উত্তরণের স্বপ্ন দেখেন, কিন্তু ঘুম ভাঙে না নিয়ামকদের। একটা বড় অংশের মানুষের মধ্যে সচেতনতা আনার মূল সোপান যে শিক্ষা, তা বোধকরি রাষ্ট্র বিস্মৃত হয়েছে।

রাজা বাগচী, গুপ্তিপাড়া, হুগলি

নেই-রাজ্য

সীমান্ত গুহঠাকুরতা লিখিত “এর মধ্যে ‘আনন্দময়’ শিক্ষা?” (২-৮) প্রবন্ধটি রাজ্যের শিক্ষা পরিকাঠামো সম্পর্কে কতকগুলো মৌলিক প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। মাটির দেওয়াল ঘেরা টালির চাল দেওয়া প্রাথমিক স্কুল বা প্লাস্টারহীন ইটের দেওয়ালে টিনের ছাউনির মাধ্যমিক স্কুলের আজ অত্যন্ত প্রান্তিক গ্ৰামেও দেখা মেলে না। বিদ্যুৎ সংযোগহীন স্কুলও সচরাচর দেখা যায় না। শেষ সাত-আট বছর ধরে আইনি জালে স্কুল সার্ভিস কমিশন জড়ানোর এবং সাম্প্রতিক অতীতে বদলি নীতি কার্যকর হওয়ার আগে পর্যন্ত প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুলেও পর্যাপ্ত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের উপস্থিতি দেখা যেত। বাইরে থেকে এখন এক নজরে বিদ্যালয়গুলোর তুলনামূলক উন্নত যে পরিকাঠামো দেখতে পাওয়া যায়, তার সৌজন্যে সর্ব শিক্ষা মিশন। আমরা যারা মাটির দেওয়াল, টিনের ছাউনি দেওয়া স্কুলে বাড়ি থেকে চটের বস্তা নিয়ে মেঝেতে পেতে পড়াশোনা শিখেছি, যাদের কাছে ইলেকট্রিসিটি বা ফ্যান রূপকথার দেশের বস্তু ছিল, তাদের কাছে রাজ্য সরকারি স্কুলের বর্তমান পরিকাঠামো অনেক ক্ষেত্রেই ছাত্রজীবনে আমাদের স্বপ্নে দেখা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো।

হয়তো গুটিকয়েক কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ের মতো অত্যাধুনিক নয়, তবুও রাজ্য সরকারি স্কুলের বর্তমান বাহ্যিক পরিকাঠামো কোনও অংশে ফেলনা নয়। আমার নবম শ্রেণিতে পড়া মেয়ে শহরের তথাকথিত সেরা বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী। কিন্তু সে স্কুলে যেতে চায় না। ভাল শিক্ষিকা আছেন, সহপাঠিনী আছে, আলো আছে, পাখা আছে, লোডশেডিং সামাল দিতে বড় জেনারেটর আছে। তবুও তার স্কুলে যেতে ভীষণ অনীহা। কারণ, ভয়ানক অপরিচ্ছন্ন টয়লেট। আসলে ইট, কাঠ, পাথর দিয়ে তৈরি সুবৃহৎ সব ইমারত এক বার তৈরি করতে পারলেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঠিক পরিকাঠামো তৈরি হয়ে গেল— এই জাতীয় ধারণা ত্যাগ করতে হবে। বাহ্যিক পরিকাঠামো তৈরি ও তাকে সঠিক ভাবে রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বজায় রাখতে হবে।

সর্বোপরি বদলে যাওয়া পৃথিবীর সঙ্গে খাপ খাইয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সঠিক অনুপাত রক্ষা করে উপযুক্ত পড়াশোনার পরিবেশ সৃষ্টি করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিষয়। অথচ, শিক্ষা সংক্রান্ত পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে ‘মানসিক দেউলিয়াপনা’র কারণে স্কুলগুলোতে ‘নেই নেই’ রব। কাজেই অতিরিক্ত কল্যাণমূলক প্রকল্পের নামে অপরিকল্পিত ভাবে যথেচ্ছ অর্থ ব্যয় করার আগে সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্ৰহণ করা দরকার। প্রকৃত অর্থেই নিয়মিত ট্রেনিং, রিফ্রেশার কোর্স ইত্যাদির মাধ্যমে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করে তোলার কাজে এখনই হাত লাগানো প্রয়োজন। অন্যথায় অপরিচ্ছন্ন টয়লেটের অ্যামোনিয়ার দুর্গন্ধে শিক্ষা ক্ষেত্রের স্বাস্থ্য পুরোপুরি ভেঙে পড়তে আর বেশি দিন বাকি থাকবে না।

তন্ময় মণ্ডল, গোবরডাঙা, উত্তর ২৪ পরগনা

শিক্ষাসঙ্কট

প্রায় দীর্ঘ দু’বছর পরে স্কুলে পঠনপাঠন শুরু হয়েছে। কিন্তু মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিভাগে ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতির হার উল্লেখযোগ্য ভাবে কম। এর কারণ অতিমারির সময়ে অষ্টম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির অনেক ছাত্র জীবিকার তাগিদে ভিনরাজ্যে পাড়ি দিয়েছে। সোনার কাজ, জরির কাজ, নির্মাণ শিল্পে কাজ করতে গিয়েছে মহারাষ্ট্র, কেরল, গুজরাতের মতো রাজ্যে। আবার মেয়েদের অনেকেরই বিয়ে হয়ে গেছে।

গ্রামের দিকের মূল সমস্যা এগুলো হলেও শহরের স্কুলগুলোতে অনুপস্থিতির কারণ সম্পূর্ণ ভাবেই অন্য। শহরের স্কুলের অধিকাংশ ছাত্র করোনাকালে পড়াশোনায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে অনলাইন ব্যবস্থার মাধ্যমে। স্কুলের বাইরে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অনলাইনের মাধ্যমে কোচিংয়ের ব্যবস্থা করেছে। ফলে, ঘরে বসে পড়তে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে ছাত্রছাত্রীরা। অনলাইন ক্লাসের চাপে তারা স্কুলের পঠনপাঠনকে গুরুত্বহীন বলে মনে করছে এবং স্কুলের পড়া ভবিষ্যতে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার পক্ষে সহায়ক হবে না বলে মনে করছে। এই ভয়ঙ্কর প্রবণতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন এক শ্রেণির অভিভাবক এবং শিক্ষক। ঘরে বসে পড়াশোনা করলে অনেক সময় বাঁচবে। ফলে, তারা বাড়িতে পড়াশোনার জন্য বাড়তি সময় দিতে পারবে বলে মনে করছেন অভিভাবকরা।

টিউটোরিয়াল ও অনলাইন সংস্থাগুলোর আকর্ষণীয় প্রচার দক্ষতায় আকৃষ্ট হয়ে অভিভাবকরা শিক্ষকদের যোগ্যতা না দেখেই, শুধুমাত্র সংস্থার নাম দেখে প্রচুর টাকা দিয়ে ছেলেমেয়েদের ভর্তি করছেন। স্কুলের সময়ের বাইরে কোনও ছাত্র প্রাইভেট টিউশন নিতেই পারে, কিন্তু স্কুলের ক্লাসকে উপেক্ষা করে নয়। সেই দিন আসতে হয়তো বেশি দেরি নেই, যে দিন সরকার মনে করবে উচ্চমাধ্যমিক বিভাগে বিশেষত বিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের প্রয়োজন নেই এবং এক জন কো-অর্ডিনেটর বা এডুকেটর নিয়োগ করেই সরকার প্রয়োজনীয় কাজ সেরে নেবে।

শীর্ষেন্দু দত্ত, সুভাষপল্লি, পূর্ব বর্ধমান

আরও পড়ুন
Advertisement