Letters to the editor

সম্পাদক সমীপেষু: সাধু এবং চলিত

সাধুভাষা হইল ধ্রুপদী বৈশিষ্ট্যের ভাষা, যাহার বাক্যরীতি বেশ কিছুটা সুনির্ধারিত। সেই সঙ্গে ইহাতে তৎসম শব্দের প্রয়োগ বেশি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৭ মার্চ ২০২২ ০৬:০৯

গত ১৮ মার্চ, ২০২২ একশত বৎসর বয়সে সাধুভাষা সম্বলিত দুইটি ভিন্ন সম্পাদকীয় আনন্দবাজার পত্রিকা-র চার নম্বর পৃষ্ঠা হইতে চিরবিদায় লইল। এমন নহে যে, সেই বৃদ্ধের দন্তসমূহ পড়িয়া গিয়াছিল, বা তাহার চর্ম শারীরিক কাঠামো হইতে ঝুলিয়া পড়িয়াছিল। তবু তাহাকে মরিতে হইল। সাধুভাষার বৈশিষ্ট্য বজায় রাখিয়া সম্পাদকীয়ের ছিল এক ধরনের স্বাভাবিক আভিজাত্য ও ঋজুতা। প্রাচীনের মৃত্যু হইবে, তাহাতে আশ্চর্যের কী-ই বা আছে। কাহারও প্রয়াণ ঘটিলে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা সচরাচর বলেন, “যে কোনও মৃত্যুই দুঃখের”। আমরা পাঠকগণ বরং তাহাই বলিয়া থাকিব।

সাধুভাষা হইল ধ্রুপদী বৈশিষ্ট্যের ভাষা, যাহার বাক্যরীতি বেশ কিছুটা সুনির্ধারিত। সেই সঙ্গে ইহাতে তৎসম শব্দের প্রয়োগ বেশি। ইহাতে সর্বনাম, ক্রিয়াপদ মৌখিক ভাষার রূপ অপেক্ষা অধিক পূর্ণতর। চলিত ভাষা অনেক চটুল, সাধুভাষা গাম্ভীর্যপূর্ণ। তাহা সত্ত্বেও, রম্যরচনা বা ব্যঙ্গাত্মক রচনায় সাধুভাষার ব্যবহার রচনাগুলিকে প্রাণবন্ত করিয়া তুলিয়াছিল। বর্তমান চলিত ভাষা আব্রুবিহীন, অভিভাবকহীন এক বিদঘুটে ভাষা, যাহা খুশি লিখিয়া দিলেও বলিবার বা দেখিবার কেহ নাই। আমরা জানিতাম, সাধু ও চলিত ভাষা উভয় রীতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য বিদ্যমান। তাই একই রচনায় সাধু ও চলিত ভাষার সংমিশ্রণ অসঙ্গত ও অশুদ্ধ। ভাষারীতির এই অশিষ্ট প্রয়োগকে গুরুচণ্ডালী দোষ বলা হইয়া থাকে। সাধু ও চলিত ভাষার এই অশুদ্ধ মিশ্রণের ফলে ভাষা প্রকৃতিগত ভাবে বৈশিষ্ট্য হারাইয়া কলুষিত হইয়া পড়ে। বর্তমানে দেখিতেছি চলিত ভাষার সহিত ইংরিজি শব্দের যত্রতত্র এবং ভুলে-ভরা প্রয়োগ। ইহাকে কী দোষ বলিয়া উল্লেখ করা যাইবে, তাহা লইয়া মাথা ঘামাইবার জন্য বোধ করি কেহ আর বাঁচিয়া নাই। অতএব সব মিলাইয়া বাংলা ভাষার সর্বাঙ্গীণ মৃত্যু এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। এখন হইতে প্রতি দিন চতুর্থ পৃষ্ঠার বাম স্তম্ভের সম্পাদকীয় দুইটি কিছুটা ধূসর লাগিবে, তবু পড়িতে থাকিব।

Advertisement

সোমনাথ মুখোপাধ্যায়

কলকাতা-৫৭

পরিবর্তন কেন

‘সাধু থেকে চলিত’ (সম্পাদকীয়, ১৮-৩) শিরোনামটি যদি ‘সাধু হইতে চলিত’ হইত, তাহা হইলে কি পাঠকের বোধগম্যতাকে তাহা অতিক্রম করিয়া যাইত? বর্তমান উল্কা গতির দৈনন্দিন জীবনে সংবাদপত্রে সাধুভাষার ব্যবহার বিলাসিতা মনে হইতেই পারে। বিশেষ করিয়া সম্পাদকীয় স্তম্ভের মতো একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ অংশে। এই অংশে সংবাদপত্রের নিজস্ব প্রাতিষ্ঠানিক মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি তুলিয়া ধরিবার মাধ্যমে জনমতের অন্ধকার অংশকে আলোকিত করিবার প্রচেষ্টা নিহিত থাকে। এইরূপ প্রচেষ্টা সমস্ত সংবাদপত্রের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্যও বটে।

সদাব্যস্ত মানুষের হাতে যখন সময় প্রায় নাই বলিলেই চলে এবং না চাহিতেই যখন সংবাদ আপনা হইতেই শ্রবণ ও দৃষ্টিগোচর হইয়া যায়, তখন প্রায় বিলুপ্ত ও দুর্বোধ্য সাধুভাষা প্রয়োগ দ্বারা সেই কর্তব্য পালনে কোনও পক্ষই অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাইতে পারে কি না তাহা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নহে, এই কথা সত্য। কিন্তু সেই ব্যর্থতার দায় কি কেবল সাধুভাষার? চাল, ডাল ও হরেক রকম আনাজ অল্প মশলা সহযোগে একত্রে সুসিদ্ধ করিয়া প্রস্তুত খিচুড়ি অপেক্ষা কি নামী কোম্পানির দামি কৌটোবন্দি শিশুখাদ্য অধিক পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যকর?

গণশিক্ষা (মাস এডুকেশন) ও গুণগত শিক্ষা (কোয়ালিটি এডুকেশন)-র দ্বন্দ্ব চিরকালীন। কিন্তু এই দ্বন্দ্ব শিক্ষার সুস্বাস্থ্যের স্বার্থেই জারি থাকা জরুরি। গণশিক্ষা কোনও যুক্তিতেই গুণগত শিক্ষার পরিপূরক নহে, বিকল্প তো নহেই। দুইয়ের মধ্যকার সীমারেখা মানিয়া লইয়াই সময় অগ্রবর্তী হয়। ইহা কেবল সময়ের দাবি নহে, সময় রচিত হইবার আবশ্যক উপাদান। সময়ের দাবি যুগে যুগে পাল্টাইয়া যায়। কখনও তাহা ‘কাইফের ক্যাচে করাচি কব্জায়’-এর মতো শিহরন জাগানো শিরোনামের দ্যোতনায় সমৃদ্ধ, কখনও আবার ‘কাঁচা বাদাম’-এর চটুল উল্লাসে উন্মত্ত। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সময়ের দাবি স্বীকার করিয়া লইলে সময় অভিভাবকহীন হইয়া পড়ে। তখন লাগামহীন সময় অকালপক্ব বালকের ন্যায় স্রোতে ভাসিয়া যায়। আত্মদাবি মূল্যায়নের বা সংশোধনের কোনও প্রচেষ্টাই তাহার মধ্যে পরিলক্ষিত হয় না। ইহাতে সময় অপেক্ষা বেশি বিকৃত ও লাঞ্ছিত হয় ইতিহাস।

ইতিহাস কেবল অতীত খুঁড়িয়া আবিষ্কৃত ঘটনাবলিই নহে, তাহা ভবিষ্যৎকে উন্নত করিবার নিষিক্ত ভ্রূণও বটে। ভাষা সেই ভ্রূণের মধ্যস্থিত প্রাণকে মুক্ত করিবার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। আর এই প্রয়াসেই সময় বিবর্তিত হয়, ইতিহাস গৌরবান্বিত হয়। সমাজ দর্পণের সম্মুখে দাঁড়াইতে বাধ্য হয়। ভাষার ওজন এই প্রচেষ্টাকে আরও ক্ষুরধার করে। চলিত গদ্য চলতি বলিয়াই তাহার সেই ক্ষমতা সীমিত। সকল কর্তৃক ব্যবহৃত ভাষা ও ভঙ্গি এক কর্ণে প্রবেশ করিয়া অপর কর্ণ দিয়া বাহির হইয়া যায়। ভিন্নতর ভঙ্গিমায় বার্তা প্রদান কর্ণমূলে আঘাত করে। শতাব্দী প্রাচীন আনন্দবাজার পত্রিকা এই ভিন্নতর ভঙ্গিমাতেই সমাজকে আলোকিত রাখিবার প্রয়াস নিরন্তর করিয়া আসিয়াছে। সহসা সেই জায়গা হইতে সরিয়া আসিলে তাহা হইবে অত্যন্ত বেদনাদায়ক, হৃদয়বিদারক। ইহাতে উল্লসিত সমাজ আরও উচ্ছন্নে যাইবে। তাহাকে শাসন করিবার মতো আর কেহ উপস্থিত থাকিবে না।

সাধুভাষায় লিখিত সম্পাদকীয় ভাষাগত দূরত্বের কারণে যাঁহারা পড়িবার উৎসাহ পান না, তাঁহারা কি চলিত ভাষায় লিখিত আনন্দবাজার-এর সম্পাদকীয়ের মর্মবাণী উদ্ধারে সক্ষম হইবেন? অপর দিকে শুধুমাত্র সাধুভাষায় লিখিত দুইটি সম্পাদকীয়ের জন্যই যাঁহারা আনন্দবাজার প্রতি দিন ক্রয় করেন (আমার ধারণা তাঁহাদের সংখ্যাই অধিক), তাঁহাদের কী হইবে? কেবল সংবাদের জন্য তো দৈনিক সংবাদপত্রের অভাব নাই।

তাই আনন্দবাজার পত্রিকা-র সম্পাদকমণ্ডলীর নিকট এই পাঠকের বিনীত প্রার্থনা, সম্পাদকীয় ভাষা পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করুন। প্রসঙ্গত মনে রাখা প্রয়োজন, কোনও কোনও ক্ষেত্রে স্থিতাবস্থা অগ্রগতিরই বাহক।

তাপস মণ্ডল

নতিবপুর, হুগলি

সাবর্ণ আধিপত্য

গত ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ তারিখে আনন্দবাজার পত্রিকা-র শতবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত ক্রোড়পত্রে বাঙালির পরিচিতি ও বাঙালি জীবনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কিছু প্রবন্ধ সঙ্কলিত হয়। প্রথম প্রবন্ধটিতে বাঙালি ‘ভদ্রলোক’ পরিচিতির নির্মাণের পিছনে তফসিলি জাতি, অন্যান্য পশ্চাৎপদ বর্গের বাঙালি এবং বাঙালি মুসলমান সমাজের বঞ্চনা ও উপেক্ষার যে কাহিনি লুকিয়ে আছে, সে সম্বন্ধে ইতিহাসবিদ সুমিত সরকার আলোকপাত করেছেন।

কিন্তু এই ক্রোড়পত্রের লেখক তালিকার নামগুলির মধ্যে দিয়ে যেন সেই একই সাবর্ণ আধিপত্য ও আত্মম্ভরিতা প্রতিফলিত হয়েছে। লেখকদের মধ্যে আমরা একটিও মুসলমান, দলিত অথবা আদিবাসীর নাম খুঁজে পেলাম না। এই ধরনের ‘জ্ঞানমূলক নিপীড়ন’ (‘এপিস্টেমিক ভায়োলেন্স’) নিয়ে তত্ত্বালোচনা করা সত্ত্বেও প্রকৃতপক্ষে সে বিষয়ে কোনও পদক্ষেপ না করা ও নিপীড়ন অব্যাহত রাখা বাঙালি সাবর্ণ বুদ্ধিজীবীর এক কলঙ্কময় ঐতিহ্য। শিক্ষা, চাকরি এবং অন্যান্য সম্পদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে সাবর্ণ হিন্দু বাঙালিদের এই একপেশে আধিপত্য অন্য সকল বাঙালির এবং সমগ্র বাঙালি সমাজের অগ্রগতির পক্ষে ক্ষতিকর। দুই বাংলা এবং বিশ্ব জুড়ে বাঙালি পাঠকের কাছে আপনাদের প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখার জন্য অবিলম্বে আনন্দবাজার পত্রিকা-য় বিভিন্ন জাতির ও ধর্মের বাঙালির কণ্ঠ অন্তর্ভুক্ত করা বিশেষ প্রয়োজন।

‘বাঙালি কারা’— এই প্রশ্নের উত্তর যেন বহু বাঙালির বঞ্চনা ও উপেক্ষার সঙ্গে জড়িয়ে না থাকে,
সেই পরিবর্তন আনার দায় অনেকাংশেই বর্তায় আপনাদের সম্পাদকমণ্ডলীর উপর।

আদিল হোসেন

ইমেল মারফত

গত ১৮ মার্চ, ২০২২ একশত বৎসর বয়সে সাধুভাষা সম্বলিত দুইটি ভিন্ন সম্পাদকীয় আনন্দবাজার পত্রিকা-র চার নম্বর পৃষ্ঠা হইতে চিরবিদায় লইল। এমন নহে যে, সেই বৃদ্ধের দন্তসমূহ পড়িয়া গিয়াছিল, বা তাহার চর্ম শারীরিক কাঠামো হইতে ঝুলিয়া পড়িয়াছিল। তবু তাহাকে মরিতে হইল। সাধুভাষার বৈশিষ্ট্য বজায় রাখিয়া সম্পাদকীয়ের ছিল এক ধরনের স্বাভাবিক আভিজাত্য ও ঋজুতা। প্রাচীনের মৃত্যু হইবে, তাহাতে আশ্চর্যের কী-ই বা আছে। কাহারও প্রয়াণ ঘটিলে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা সচরাচর বলেন, “যে কোনও মৃত্যুই দুঃখের”। আমরা পাঠকগণ বরং তাহাই বলিয়া থাকিব।

সাধুভাষা হইল ধ্রুপদী বৈশিষ্ট্যের ভাষা, যাহার বাক্যরীতি বেশ কিছুটা সুনির্ধারিত। সেই সঙ্গে ইহাতে তৎসম শব্দের প্রয়োগ বেশি। ইহাতে সর্বনাম, ক্রিয়াপদ মৌখিক ভাষার রূপ অপেক্ষা অধিক পূর্ণতর। চলিত ভাষা অনেক চটুল, সাধুভাষা গাম্ভীর্যপূর্ণ। তাহা সত্ত্বেও, রম্যরচনা বা ব্যঙ্গাত্মক রচনায় সাধুভাষার ব্যবহার রচনাগুলিকে প্রাণবন্ত করিয়া তুলিয়াছিল। বর্তমান চলিত ভাষা আব্রুবিহীন, অভিভাবকহীন এক বিদঘুটে ভাষা, যাহা খুশি লিখিয়া দিলেও বলিবার বা দেখিবার কেহ নাই। আমরা জানিতাম, সাধু ও চলিত ভাষা উভয় রীতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য বিদ্যমান। তাই একই রচনায় সাধু ও চলিত ভাষার সংমিশ্রণ অসঙ্গত ও অশুদ্ধ। ভাষারীতির এই অশিষ্ট প্রয়োগকে গুরুচণ্ডালী দোষ বলা হইয়া থাকে। সাধু ও চলিত ভাষার এই অশুদ্ধ মিশ্রণের ফলে ভাষা প্রকৃতিগত ভাবে বৈশিষ্ট্য হারাইয়া কলুষিত হইয়া পড়ে। বর্তমানে দেখিতেছি চলিত ভাষার সহিত ইংরিজি শব্দের যত্রতত্র এবং ভুলে-ভরা প্রয়োগ। ইহাকে কী দোষ বলিয়া উল্লেখ করা যাইবে, তাহা লইয়া মাথা ঘামাইবার জন্য বোধ করি কেহ আর বাঁচিয়া নাই। অতএব সব মিলাইয়া বাংলা ভাষার সর্বাঙ্গীণ মৃত্যু এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। এখন হইতে প্রতি দিন চতুর্থ পৃষ্ঠার বাম স্তম্ভের সম্পাদকীয় দুইটি কিছুটা ধূসর লাগিবে, তবু পড়িতে থাকিব।

সোমনাথ মুখোপাধ্যায়

কলকাতা-৫৭

পরিবর্তন কেন

‘সাধু থেকে চলিত’ (সম্পাদকীয়, ১৮-৩) শিরোনামটি যদি ‘সাধু হইতে চলিত’ হইত, তাহা হইলে কি পাঠকের বোধগম্যতাকে তাহা অতিক্রম করিয়া যাইত? বর্তমান উল্কা গতির দৈনন্দিন জীবনে সংবাদপত্রে সাধুভাষার ব্যবহার বিলাসিতা মনে হইতেই পারে। বিশেষ করিয়া সম্পাদকীয় স্তম্ভের মতো একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ অংশে। এই অংশে সংবাদপত্রের নিজস্ব প্রাতিষ্ঠানিক মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি তুলিয়া ধরিবার মাধ্যমে জনমতের অন্ধকার অংশকে আলোকিত করিবার প্রচেষ্টা নিহিত থাকে। এইরূপ প্রচেষ্টা সমস্ত সংবাদপত্রের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্যও বটে।

সদাব্যস্ত মানুষের হাতে যখন সময় প্রায় নাই বলিলেই চলে এবং না চাহিতেই যখন সংবাদ আপনা হইতেই শ্রবণ ও দৃষ্টিগোচর হইয়া যায়, তখন প্রায় বিলুপ্ত ও দুর্বোধ্য সাধুভাষা প্রয়োগ দ্বারা সেই কর্তব্য পালনে কোনও পক্ষই অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাইতে পারে কি না তাহা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নহে, এই কথা সত্য। কিন্তু সেই ব্যর্থতার দায় কি কেবল সাধুভাষার? চাল, ডাল ও হরেক রকম আনাজ অল্প মশলা সহযোগে একত্রে সুসিদ্ধ করিয়া প্রস্তুত খিচুড়ি অপেক্ষা কি নামী কোম্পানির দামি কৌটোবন্দি শিশুখাদ্য অধিক পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যকর?

গণশিক্ষা (মাস এডুকেশন) ও গুণগত শিক্ষা (কোয়ালিটি এডুকেশন)-র দ্বন্দ্ব চিরকালীন। কিন্তু এই দ্বন্দ্ব শিক্ষার সুস্বাস্থ্যের স্বার্থেই জারি থাকা জরুরি। গণশিক্ষা কোনও যুক্তিতেই গুণগত শিক্ষার পরিপূরক নহে, বিকল্প তো নহেই। দুইয়ের মধ্যকার সীমারেখা মানিয়া লইয়াই সময় অগ্রবর্তী হয়। ইহা কেবল সময়ের দাবি নহে, সময় রচিত হইবার আবশ্যক উপাদান। সময়ের দাবি যুগে যুগে পাল্টাইয়া যায়। কখনও তাহা ‘কাইফের ক্যাচে করাচি কব্জায়’-এর মতো শিহরন জাগানো শিরোনামের দ্যোতনায় সমৃদ্ধ, কখনও আবার ‘কাঁচা বাদাম’-এর চটুল উল্লাসে উন্মত্ত। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সময়ের দাবি স্বীকার করিয়া লইলে সময় অভিভাবকহীন হইয়া পড়ে। তখন লাগামহীন সময় অকালপক্ব বালকের ন্যায় স্রোতে ভাসিয়া যায়। আত্মদাবি মূল্যায়নের বা সংশোধনের কোনও প্রচেষ্টাই তাহার মধ্যে পরিলক্ষিত হয় না। ইহাতে সময় অপেক্ষা বেশি বিকৃত ও লাঞ্ছিত হয় ইতিহাস।

ইতিহাস কেবল অতীত খুঁড়িয়া আবিষ্কৃত ঘটনাবলিই নহে, তাহা ভবিষ্যৎকে উন্নত করিবার নিষিক্ত ভ্রূণও বটে। ভাষা সেই ভ্রূণের মধ্যস্থিত প্রাণকে মুক্ত করিবার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। আর এই প্রয়াসেই সময় বিবর্তিত হয়, ইতিহাস গৌরবান্বিত হয়। সমাজ দর্পণের সম্মুখে দাঁড়াইতে বাধ্য হয়। ভাষার ওজন এই প্রচেষ্টাকে আরও ক্ষুরধার করে। চলিত গদ্য চলতি বলিয়াই তাহার সেই ক্ষমতা সীমিত। সকল কর্তৃক ব্যবহৃত ভাষা ও ভঙ্গি এক কর্ণে প্রবেশ করিয়া অপর কর্ণ দিয়া বাহির হইয়া যায়। ভিন্নতর ভঙ্গিমায় বার্তা প্রদান কর্ণমূলে আঘাত করে। শতাব্দী প্রাচীন আনন্দবাজার পত্রিকা এই ভিন্নতর ভঙ্গিমাতেই সমাজকে আলোকিত রাখিবার প্রয়াস নিরন্তর করিয়া আসিয়াছে। সহসা সেই জায়গা হইতে সরিয়া আসিলে তাহা হইবে অত্যন্ত বেদনাদায়ক, হৃদয়বিদারক। ইহাতে উল্লসিত সমাজ আরও উচ্ছন্নে যাইবে। তাহাকে শাসন করিবার মতো আর কেহ উপস্থিত থাকিবে না।

সাধুভাষায় লিখিত সম্পাদকীয় ভাষাগত দূরত্বের কারণে যাঁহারা পড়িবার উৎসাহ পান না, তাঁহারা কি চলিত ভাষায় লিখিত আনন্দবাজার-এর সম্পাদকীয়ের মর্মবাণী উদ্ধারে সক্ষম হইবেন? অপর দিকে শুধুমাত্র সাধুভাষায় লিখিত দুইটি সম্পাদকীয়ের জন্যই যাঁহারা আনন্দবাজার প্রতি দিন ক্রয় করেন (আমার ধারণা তাঁহাদের সংখ্যাই অধিক), তাঁহাদের কী হইবে? কেবল সংবাদের জন্য তো দৈনিক সংবাদপত্রের অভাব নাই।

তাই আনন্দবাজার পত্রিকা-র সম্পাদকমণ্ডলীর নিকট এই পাঠকের বিনীত প্রার্থনা, সম্পাদকীয় ভাষা পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করুন। প্রসঙ্গত মনে রাখা প্রয়োজন, কোনও কোনও ক্ষেত্রে স্থিতাবস্থা অগ্রগতিরই বাহক।

তাপস মণ্ডল

নতিবপুর, হুগলি

সাবর্ণ আধিপত্য

গত ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ তারিখে আনন্দবাজার পত্রিকা-র শতবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত ক্রোড়পত্রে বাঙালির পরিচিতি ও বাঙালি জীবনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কিছু প্রবন্ধ সঙ্কলিত হয়। প্রথম প্রবন্ধটিতে বাঙালি ‘ভদ্রলোক’ পরিচিতির নির্মাণের পিছনে তফসিলি জাতি, অন্যান্য পশ্চাৎপদ বর্গের বাঙালি এবং বাঙালি মুসলমান সমাজের বঞ্চনা ও উপেক্ষার যে কাহিনি লুকিয়ে আছে, সে সম্বন্ধে ইতিহাসবিদ সুমিত সরকার আলোকপাত করেছেন।

কিন্তু এই ক্রোড়পত্রের লেখক তালিকার নামগুলির মধ্যে দিয়ে যেন সেই একই সাবর্ণ আধিপত্য ও আত্মম্ভরিতা প্রতিফলিত হয়েছে। লেখকদের মধ্যে আমরা একটিও মুসলমান, দলিত অথবা আদিবাসীর নাম খুঁজে পেলাম না। এই ধরনের ‘জ্ঞানমূলক নিপীড়ন’ (‘এপিস্টেমিক ভায়োলেন্স’) নিয়ে তত্ত্বালোচনা করা সত্ত্বেও প্রকৃতপক্ষে সে বিষয়ে কোনও পদক্ষেপ না করা ও নিপীড়ন অব্যাহত রাখা বাঙালি সাবর্ণ বুদ্ধিজীবীর এক কলঙ্কময় ঐতিহ্য। শিক্ষা, চাকরি এবং অন্যান্য সম্পদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে সাবর্ণ হিন্দু বাঙালিদের এই একপেশে আধিপত্য অন্য সকল বাঙালির এবং সমগ্র বাঙালি সমাজের অগ্রগতির পক্ষে ক্ষতিকর। দুই বাংলা এবং বিশ্ব জুড়ে বাঙালি পাঠকের কাছে আপনাদের প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখার জন্য অবিলম্বে আনন্দবাজার পত্রিকা-য় বিভিন্ন জাতির ও ধর্মের বাঙালির কণ্ঠ অন্তর্ভুক্ত করা বিশেষ প্রয়োজন।

‘বাঙালি কারা’— এই প্রশ্নের উত্তর যেন বহু বাঙালির বঞ্চনা ও উপেক্ষার সঙ্গে জড়িয়ে না থাকে,
সেই পরিবর্তন আনার দায় অনেকাংশেই বর্তায় আপনাদের সম্পাদকমণ্ডলীর উপর।

আদিল হোসেন

ইমেল মারফত

আরও পড়ুন
Advertisement