Duare Daktar

সম্পাদক সমীপেষু: অকাজের শিবির

কলকাতার হাসপাতালগুলির সাজানো-গোছানো পরিবেশে অনেক ভাল পরিষেবাও যেমন রোগীরা পান, ঘুরে হয়রান হওয়ার ছবিও ধরা পড়ে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১০ মার্চ ২০২৩ ০৫:৩৮
Picture of Hospital.

ফাইল চিত্র।

সম্পাদকীয় ‘অপচয়ের নীতি’ (২১-২) বিশ্লেষণাত্মক ও যুক্তিগ্রাহ্য। পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশিয়াড়িতে ‘দুয়ারে ডাক্তার’ প্রকল্পে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসক দল ‘দুয়ারে সরকার’ ধাঁচের চিকিৎসা দেবেন ওই প্রান্তিক অঞ্চলের অধিবাসীদের। এই রোগীদের কলকাতার বড় হাসপাতালের পরিষেবা নিতে হলে, সাধারণত আগের দিন রাতে এসে পর দিন লাইন দিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে ফিরে যেতে হয়। প্রশ্ন হল, যে কোনও রোগের চিকিৎসা একটি নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া, যেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ওষুধ লিখে দেওয়া, ইত্যাদি পর্যায়ক্রমে চলে। তা হলে এক দিন মেডিসিন, শিশুরোগ, ত্বক, নাক-কান-গলা প্রভৃতি বিভিন্ন বিভাগের বিশেষজ্ঞরা একটা শিবিরে গিয়ে রোগীদের প্রতি কতটুকু সুবিচার করতে সমর্থ হবেন?

কলকাতার হাসপাতালগুলির সাজানো-গোছানো পরিবেশে অনেক ভাল পরিষেবাও যেমন রোগীরা পান, ঘুরে হয়রান হওয়ার ছবিও ধরা পড়ে। চিকিৎসকের অভাবে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের নেফ্রোলজির বহির্বিভাগ বন্ধ রাখতে হচ্ছে, কিডনি সমস্যায় ভর্তি-থাকা রোগীদের চিকিৎসা নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে। দুয়ারে ডাক্তার কর্মসূচি নিয়মিত হলে মেডিক্যাল কলেজ এবং সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালগুলিও অচিরে অচল হবে। চিকিৎসক বদলি করার সময় সমূহ বিষয়টি নিয়ে ভাবনাচিন্তা করলে, এক পক্ষকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে আর এক পক্ষকে সমস্যায় পড়তে হত না।

Advertisement

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উপর ভরসা করে উত্তর শহরতলির উত্তর ২৪ পরগনা, নদিয়া (বাংলাদেশ সীমান্ত অবধি) এবং দক্ষিণ শহরতলির অনেকটা অংশ। সকাল থেকে এসে স্বল্প ব্যয়ে সুচিকিৎসা পাওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়ান ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তাঁদের কী হাল হবে! সমস্ত হাসপাতালে চিকিৎসক সংখ্যা পর্যাপ্ত রেখে, পরিকাঠামো উন্নত করলে রোগীর পরিবারকে এত দূর আসতে হয় না মুমূর্ষু রোগীকে সঙ্গে নিয়ে।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বরং জেলার সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে গিয়ে ওখানকার ডাক্তারবাবুদের সঙ্গে কাটিয়ে এলে, তাঁরা এক-আধ দিনের চিকিৎসা শিবির না করে নিরবচ্ছিন্ন পরিষেবা দেওয়ার উৎসাহ পাবেন। দূর দূর অঞ্চলে দুয়ারে ডাক্তার পৌঁছতে পারল— এর বিজ্ঞাপনী মূল্য থাকলেও আসল চিকিৎসার সুবিধে কতটা মেলে?

সৌম্যেন্দ্রনাথ জানা, কলকাতা-১৫৪

অভাব অন্যত্র

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নতুন চমক ‘দুয়ারে ডাক্তার’। অভিনব পদক্ষেপ! ভোটের দিকে চেয়েই কি এই ব‍্যবস্থা? এ দেশের মানুষ এক জন ডাক্তারের স্পর্শটুকু পেলেই ধন‍্য হয়ে যান। এমনকি ভিডিয়ো কল মারফত পরামর্শ পেলেও তাঁরা কৃতার্থ বোধ করেন। যে কারণে আজ সুস্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলি থেকে কেবলমাত্র ভিডিয়ো কলের মাধ্যমে ডাক্তারের সংস্পর্শে মানুষকে নিয়ে আসা হচ্ছে। সরাসরি ডাক্তারের পরিষেবা থেকে মানুষকে বঞ্চিত করা সত্ত্বেও তো মানুষ দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করছে! তা হলে ঘরের দুয়ারে মেডিক্যাল কলেজের বড় ডাক্তারবাবুর দর্শন মিললে মানুষ যারপরনাই আহ্লাদিত হবেন, সে কথা ভেবেই কি সরকারের এই পরিকল্পনা?

সারা বিশ্বেই স্বাস্থ্যব‍্যবস্থায় ত্রিস্তরীয় একটি পরিষেবা ব‍্যবস্থা রয়েছে। একেবারে নীচে প্রতিরোধমূলক ব‍্যবস্থা রয়েছে। যেখানে স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে বিভিন্ন রোগ নির্ণয় করেন, দরকারে রোগীকে হাসপাতালে পাঠানোর পরামর্শ দেন, এবং তার ব‍্যবস্থা করেন। বিভিন্ন রোগ ও মহামারির বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব‍্যবস্থা করা ও পরিষেবা দেওয়া হয়। এর পরবর্তী স্তরে রোগীর অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মধ‍্যম স্তর ও উচ্চতম (টার্শিয়ারি) স্তরে রেফারের ব‍্যবস্থা করা হয়। দুঃখের হলেও এ কথা সত‍্য যে, এই প্রতিটা স্তরেই পরিকাঠামো এবং প্রশিক্ষিত লোকবলের অভাব রয়েছে। জনসংখ্যার নিরিখে একেবারে গ্রাম স্তরে প্রতি ৫০০০, এবং পার্বত‍্য ও জনজাতি অধ্যুষিত এলাকায় প্রতি ৩০০০ মানুষ পিছু একটি করে উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকার কথা, বর্তমানে ৬০০০-১৬,০০০ মানুষ পিছু রয়েছে একটি। অর্থাৎ, বতর্মান পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার নিরিখে শহর এবং গ্রাম মিলে ২০ হাজারের বেশি উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকার কথা ছিল, যেখানে শহরাঞ্চলে সংখ্যাটা মাত্র ২০০, গ্রামাঞ্চলে রয়েছে ১০,৩৫৭। শহর এবং গ্রাম মিলে ৪৬৬১টি নতুন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরির কথা থাকলেও, এখনও পর্যন্ত তার পরিকাঠামো সম্পূর্ণরূপে তৈরিই করা হয়নি। অথচ ভোটের চমক দেওয়ার জন‍্য এর মধ্যে বেশ কিছু উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র চালুও করে দেওয়া হয়েছে। নতুন স্বাস্থ্যকর্মী না দিয়ে, পাশের উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে স্বাস্থ্যকর্মী পাঠিয়ে কাজ চালু করা হচ্ছে। ফলে যেখানে পুরনো উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলি এমনিতেই অর্ধেক স্বাস্থ্যকর্মী নিয়ে কোনও ক্রমে খুঁড়িয়ে চলত, সেখানে নতুন এই ব‍্যবস্থায় কি আরও বিপর্যয় হবে না? এর ঠিক উপরের স্তর, অর্থাৎ প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র ক্ষেত্রে সব মিলিয়ে ঘাটতি রয়েছে ১৩৫৬ (৬৪%)। এর উপরের স্তরে গ্রামীণ হাসপাতাল থাকার কথা কমপক্ষে ১০০০, রয়েছে মাত্র ৩৪৮ (ঘাটতি ৬৫%)। ইন্ডিয়ান পাবলিক হেলথ স্ট‍্যান্ডার্ড ধরলে ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা রয়েছে অর্ধেকেরও কম।

ফলে বাধ্য হয়ে মানুষ প্রাথমিক ও মধ‍্যম স্তরে না গিয়ে খুব সাধারণ রোগের জন্যেও মেডিক্যাল কলেজগুলোতে যেতে বাধ‍্য হন। সেই ভিড়ের মুখে মেডিক্যাল কলেজগুলোর অব‍্যবস্থা আরও প্রকট হতে থাকে। এই স্তরে চিকিৎসক-শিক্ষককে একাধারে রোগীর চাপ সামলাতে হয় এবং মেডিক্যাল, নার্সিং, প্যারামেডিক্যাল ছাত্রছাত্রীদের পড়ানোর কাজও করতে হয়। ফলে রোগীর পরিষেবার চেয়েও বেশি করে বিঘ্নিত হয় ছাত্রদের প্রশিক্ষণ। ভবিষ্যতে এ দেশ কী ভাবে উন্নত মানের চিকিৎসক পাবে, সে প্রশ্নটা আজ ভাবিয়ে তুলছে।

এই সঙ্কট কাটানোর ব‍্যবস্থা না করে চটকদার রাজনৈতিক ঝোঁকে সরকার প্রাথমিক স্বাস্থ্যক্ষেত্রের চাপ সামলানোর নাম করে আর একটি ভেঙে-পড়া স্বাস্থ্যক্ষেত্র মেডিক্যাল কলেজগুলো থেকে চিকিৎসকদের গ্রামে পাঠাচ্ছে। এতে ডাক্তাররা অপারেশন করতে পারবেন না, বা জটিল রোগের চিকিৎসা করতে পারবেন না। এমনকি এক দিন বড় ডাক্তার যাওয়ার ফলে মানুষের রোগ সেরে ওঠা তো দূর অস্ত্, রোগ নির্ণয়ও সম্ভব হবে না। অন‍্য দিকে, তিনি ওই সময়ে মেডিক্যাল কলেজে থাকলে যতগুলি অপারেশন বা জটিল রোগের চিকিৎসা করতে পারতেন, রোগীরা সেই সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হবেন। ছাত্ররা বঞ্চিত হবে তাদের প্রশিক্ষণ থেকে। সরকারের এই ধরনের অপরিণামদর্শী পদক্ষেপের তীব্র বিরোধিতা করছি, এবং চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে পরিকাঠামো এবং লোকবলের ঘাটতি পূরণের দাবি জানাচ্ছি।

সজল বিশ্বাস, সাধারণ সম্পাদক, সার্ভিস ডক্টর’ফোরাম

শিশুর অসুখ

রাজ্য জুড়ে চলছে শিশুদের নিয়ে ছোটাছুটি। অ্যাডিনোভাইরাসে আক্রান্ত অনেক শিশু। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে শিশু-ওয়ার্ডে রোগীর চাপ বেড়েছে, বিশেষত আইসিইউ-তে। জ্বর, সর্দি, কাশি-সহ নানা উপসর্গ দেখা যাচ্ছে। কয়েক দিন আগেও বি সি রায় শিশু হাসপাতাল, কলকাতার বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শিশু-ওয়ার্ডে সব বেড ভর্তি ছিল। এখন পরিস্থিতি কিছু পাল্টালেও শিশুমৃত্যু রোধে আগাম কার্যকর ব্যবস্থা করার ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা যথেষ্ট ছিল কি না, তা ভাবতে হবে। হাসপাতালগুলোর পরিকাঠামো উন্নত করা, বেডের সংখ্যা বাড়ানো, জরুরি পরিষেবা দিতে আইসিইউ ও সিসিইউ-এর বেডের সংখ্যা বাড়ানো দরকার। এই মুহূর্তে ‘দুয়ারে চিকিৎসক শিবির’ না করে সব হাসপাতালে শিশুদের চিকিৎসায় প্রাধান্য দেওয়া উচিত।

বিদ্যুৎ সীট, জগদল্লা, বাঁকুড়া

আরও পড়ুন
Advertisement