RSS

সম্পাদক সমীপেষু: হিন্দুত্বের মানে কী

সঙ্ঘের মতে, হিন্দুত্ব একটি জীবন পদ্ধতি। হিন্দুদের মধ্যে বিভিন্ন উপাসনা পদ্ধতি রয়েছে। কেউ শিবের উপাসক, কেউ শাক্ত, কেউ কৃষ্ণের উপাসনা করেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০২২ ০৪:৪৭
সঙ্ঘ প্রধান মোহন ভাগবত।

সঙ্ঘ প্রধান মোহন ভাগবত। ফাইল চিত্র।

অমিতাভ গুপ্তের যুক্তির সঙ্গে সহমত পোষণ করতে না পারায় এই পত্রের অবতারণা (‘সহাবস্থান, কিন্তু আধিপত্য’, ৯-১১)। যে কোনও সংগঠনের মূল্যায়ন তখনই করা সম্ভব, যখন তার ইতিহাস, আদর্শবাদ, লক্ষ্য ও সাংগঠনিক কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকবে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘকে অনেকেই কেবল বাইরে থেকে জানেন, অপপ্রচারও কম নয়। তবে এটা বলাই যায় যে, সঙ্ঘের দীর্ঘ ৯৭ বছরের ইতিহাসে কাজে ও কথায় কোনও ফারাক নেই। সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত বলেছেন যে, ভারতবর্ষের সকলের ডিএনএ এক। সেই হিসেবে সকলেই হিন্দু, এবং হিন্দুত্বই ভারতের রাষ্ট্রীয়ত্ব— এই তত্ত্বে সঙ্ঘ বিশ্বাসী।

সঙ্ঘের মতে, হিন্দুত্ব একটি জীবন পদ্ধতি। হিন্দুদের মধ্যে বিভিন্ন উপাসনা পদ্ধতি রয়েছে। কেউ শিবের উপাসক, কেউ শাক্ত, কেউ কৃষ্ণের উপাসনা করেন। কেউ সাকার বা নিরাকার সাধনা করে থাকেন। কেউ ঈশ্বরে বিশ্বাসী, কেউ তা নন। সুতরাং, হিন্দু ধর্মে কোনও গোঁড়ামি বা সঙ্কীর্ণতার স্থান নেই। হিন্দুরাই বলতে পেরেছে ‘বসুধৈব কুটুম্বকম্’। সকলকে আপন করে নেওয়ার সংস্কৃতি এখানে রয়েছে। সঙ্ঘের মতে, মুসলমানরা এই সনাতন সংস্কৃতির অংশ হিসেবে ভারতকে মাতৃভূমি, পিতৃভূমি ও কর্মভূমি মনে করে ভারতীয় হলে, দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হওয়ার প্রশ্ন অবান্তর। হিন্দুদের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য। কিন্তু এও ঠিক, ভারতের বাসিন্দা হয়ে পাকিস্তানকে নিজেদের প্রকৃত দেশ বলে আনুগত্য প্রকাশ করলে এ দেশে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে থাকতে হবে, এটাই সঙ্ঘের মত। স্বাভিমানসম্পন্ন সকল দেশেরই কি নিজের দেশের নাগরিকত্ব সম্পর্কে এই সচেতনতা থাকে না?

Advertisement

অবশ্যই বলব, বহু মুসলিম ভারতবাসী এই শ্রেণির মধ্যে পড়েন না। তাঁরা জাতীয়তাবাদী। এবং সে ক্ষেত্রে হিন্দু আধিপত্য বিস্তারের দুশ্চিন্তা থাকার প্রশ্নই উঠে না।

সুতরাং লেখকের আশঙ্কা অমূলক বলেই আমি মনে করি। হিন্দুত্বের দর্শনে মক্কা-মদিনা ত্যাগ করতে হবে, সঙ্ঘ-দর্শনে এমন কোথাও বলা হয়নি। আরবি ভাষা ভুলে যাওয়ার কথাও শোনা যায়নি।

লেখক হিন্দুদের জন্য কোনও শর্ত নেই বলে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। বস্তুত হিন্দুদের ক্ষেত্রেও একই শর্তের পূরণ বাধ্যতামূলক। কারণ সঙ্ঘ দর্শনে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে এই দেশকে মাতৃভূমি, পিতৃভূমি ও কর্মভূমি মনে করা আবশ্যক। তবু উল্লেখ করা ভাল যে, সঙ্ঘের আদর্শে দেশকে সর্বোচ্চ স্থানে রাখা হয়। ধর্মীয় আচার-আচরণের স্বাধীনতায় সঙ্ঘ বিশ্বাসী। সঙ্ঘ দর্শনে সকলকে যখন ভারতীয় সংস্কৃতির অঙ্গ হিসাবে স্বীকার করা হয়, তাই আধিপত্যের প্রসঙ্গ অনাবশ্যক। বিজেপি একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল। আরএসএস একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, যা হিন্দু সংগঠনের কাজ করে থাকে। বিজেপি রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বতন্ত্র সিদ্ধান্ত নেয়, এ বিষয়ে আরএসএস-এর হস্তক্ষেপের বিষয়টি একেবারেই কল্পনাপ্রসূত। উভয়ের দর্শন ও প্রয়োগের পথ পৃথক।

পরিশেষে বলা যায়, আরএসএস সর্বদা উপরিউক্ত বনিয়াদ শর্তের ভিত্তিতে ‘হিন্দু’ শব্দটি প্রয়োগে বিশ্বাসী, এবং হিন্দু হিসাবে আধিপত্যের পরিবর্তে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের উপর আস্থাশীল।

আনন্দ মোহন দাস, উত্তরপাড়া, হুগলি

বাম-কংগ্রেস

‘ইয়েচুরির প্রভাব কি কংগ্রেসেই বেশি’ (দিল্লি ডায়েরি, ২০-১১) প্রসঙ্গে এই পত্র। আরএসপি-র সর্বভারতীয় সম্মেলনে জাতীয় কংগ্রেসের বিশিষ্ট নেতা জয়রাম রমেশের বক্তব্য, “ইয়েচুরির প্রভাব কংগ্রেসেই বেশি, কখনও কখনও ইয়েচুরি একই সঙ্গে সিপিআই(এম) ও কংগ্রেসের সম্পাদক হয়ে যান।” মঞ্চে উপস্থিত কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব-সহ বাম নেতৃত্ব স্মিত হাস্যে কংগ্রেস নেতার বক্তব্যে প্রতিক্রিয়া জানালেও, পুনরায় দেশব্যাপী কংগ্রেস ও সিপিআই(এম)-এর বোঝাপড়া জাতীয় রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ সৃষ্টি করেছে। কংগ্রেসের নেতৃত্বেই বামপন্থীদের সমর্থনে ও অংশগ্রহণে কেন্দ্রীয় স্তরে বিজেপি বিরোধী মঞ্চ গঠনের গ্রহণযোগ্য সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। দেশের প্রধান বামপন্থী দলগুলিও মনে করে, এই সময় কংগ্রেসের সঙ্গে মিত্রতা গড়ে তোলাই বাস্তব সমাধান।

জাতীয় কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে রাজনৈতিক বোঝাপড়া গড়ে তোলার বিষয়ে তর্ক, বিতর্ক ও আলোচনা চলছে ৭০ বছরের বেশি সময় ধরে। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে তদানীন্তন কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক পি সি জোশী ছিলেন তত্ত্বগত ভাবে কংগ্রেসের সঙ্গে স্থায়ী মিত্রতার প‍ক্ষে। তাঁর বক্তব্য ছিল, “কমিউনিস্ট পার্টিকে হতে হবে কংগ্রেসের স্বাভাবিক মিত্র।” এই রাজনৈতিক তত্ত্বের কারণে পি সি জোশী কট্টরবাদী নেতাদের দ্বারা পার্টি থেকে অপসারিত হয়েছিলেন। কার্যত ৭০ বছর পরে কমিউনিস্ট পার্টি-সহ বামদলগুলি ফিরে এলেন পি সি জোশীর তত্ত্বে।

জোশী চেয়েছিলেন, কট্টরবাদ সরিয়ে রেখে ভারতীয় সংস্কৃতিকে আহরণ করে কমিউনিস্ট পার্টি জাতীয় মূলস্রোতের সঙ্গে যুক্ত হোক। উদারবাদ দিয়ে কট্টরবাদকে পরাস্ত করার কথা ভেবেছিলেন তিনি। চেয়েছিলেন কংগ্রেস-বাম ঐক্য। প্রায়ই ঠাট্টা করে বলতেন, “কংগ্রেস নামক হাতিটির মাহুত হব আমরা।” কিন্তু দলের অন্য নেতারা ভারতের স্বাধীনতাকে ‘ঝুটা’ আখ্যা দিয়ে নেহরু-বিরোধিতায় সরব হয়েছিলেন। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলেন সাম্রাজ্যবাদের ছুটন্ত সারমেয়। ফলে ‘প্রতিক্রিয়াশীল শোধনবাদী’ বলে তিরস্কার কুড়িয়েছিলেন জোশী।

বহু কাজের মধ্যে দিয়ে জোশী বার বার চেষ্টা করেছিলেন ভারতীয় দর্শনের সঙ্গে বাম আন্দোলনকে যুক্ত করতে। রবীন্দ্রনাথকে ‘বুর্জোয়া কবি’ বলতে চাননি তিনি। উপনিষদ-গীতা পড়তে বলতেন কমরেডদের। পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিকাশের ইতিহাসকে অস্বীকার না করে সেই পথ অতিক্রম করার কথা বলতেন তিনি।

স্তালিনের সোভিয়েট ইউনিয়নে এমনই অবস্থা হয়েছিল বুখারিনের। জীবদ্দশায় তাঁর দলে ফেরা হয়নি। মৃত্যুর পর বিংশ পার্টি কংগ্রেসে তাঁর ভাবনা স্বীকৃতি পেয়েছিল। আর জোশীকে ১৯৫৬ সালে দল ফিরিয়ে নিয়েছিল বটে, কিন্তু তাঁর ভাবনাকে ব্রাত্য করেই রেখেছিল। কলকাতার কিড স্ট্রিটে একটা ছোট্ট ঘরে বসে পড়াশোনা করতেন আর লিখতেন। এত দিন পর কি তিনি ঘরে ফিরছেন?

অশোক ঘোষ, কলকাতা-১২

নির্ভীক

ম্যাগসাইসাই পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক রবীশ কুমার সম্প্রতি মনে করিয়ে দিয়েছেন, নাগরিক না যন্ত্রমানব, গণতন্ত্র বা স্বৈরতন্ত্র, বেছে নেওয়ার দায় আমাদেরই। সামান্য কয়েকটি কথায় কি অনবদ্য ভাবেই তিনি গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোর শেষ কথাটি উচ্চারণ করে দিলেন! হ্যাঁ, এটাই অন্তিম সত্য যে কোনও শক্তি, যতই বিভাজনকারী, অসহিষ্ণু, স্বৈরাচারী, বিদ্বেষপূর্ণ, হোক না কেন; সাধারণ জনগণের সমর্থন ব্যতীত কখনওই ক্ষমতা অর্জন করতে পারে না, বা তা ধরে রাখতে পারে না। সুতরাং, প্রকৃতপক্ষে যে কোনও গণতান্ত্রিক দেশের ভবিষ্যৎ তার নাগরিকদের হস্তেই অর্পিত। এবং শাসনের বা শাসকের গুণমান, বা চরিত্র, কেমন হবে, তা-ও দেশের মানুষের উপরেই নির্ভরশীল।

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন রবীশ কুমার— সব যুদ্ধই জেতার জন্য লড়া হয় না। কিছু যুদ্ধ লড়তে হয় কেবল বিশ্বকে জানাতে যে, যুদ্ধের ময়দানে এক জন ছিল। রবীশ কুমারের এই উক্তি দেশের ধর্মনিরপেক্ষ বিবেকবান মানবিক অংশের জন্য অত্যন্ত অনুপ্রেরণাদায়ক। সাংবাদিক রবীশ কুমার প্রবল চাপের মুখেও কখনও মাথা নত করেননি। তাঁর কর্মকাণ্ড, মূল্যবোধ এবং আপসহীন সংগ্রাম নেতাজির সেই সুস্পষ্ট উচ্চারণে উদাত্ত আহ্বান স্মরণ করিয়ে দেয়— “মনে রেখো, সব চাইতে বড় অপরাধ হল অন্যায়ের সঙ্গে, ভ্রান্তির সঙ্গে বোঝাপড়া করা।”

কাজল চট্টোপাধ্যায়, সোদপুর, উত্তর ২৪ পরগনা

আরও পড়ুন
Advertisement