Small Rivers

সম্পাদক সমীপেষু: বেঁচে থাক নদীরা

কেলেঘাই নদীর ডান তীরের উপনদী বাগুই। কম দৈর্ঘ্যের কারণে বাগুই খাল নামে পরিচিত। এই নদীর গতিপথ‌ও বর্তমানে রুদ্ধ।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০২৪ ০৬:১৬

—ফাইল চিত্র।

অনিতা অগ্নিহোত্রীর প্রবন্ধ ‘একেই কি বলে উন্নয়ন’ (৩১-৩) নদী ভাবনার এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল। দক্ষিণবঙ্গের ছোট্ট নদী কেলেঘাইয়ের বর্তমান অবস্থা এবং পরিবেশ ও মানুষের উপর তার প্রভাব সম্পর্কে তথ্যসমৃদ্ধ ব্যাখ্যা। একটি নদী শুধুমাত্র তার প্রবাহিত অঞ্চলে জলের জোগান দেয় না, ওই অঞ্চলের মানুষের জীবন, জীবিকা, খাদ্যাভ্যাসের উপর‌ও গভীর প্রভাব ফেলে। পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু নদীর অবস্থাও কেলেঘাইয়ের মতোই। তাৎক্ষণিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন ভাবে নদীর চলার পথ আটকে দেওয়া, তীরবর্তী অঞ্চলে প্রয়োজনের অতিরিক্ত জল সংগ্রহ করা— সব‌ই নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে ছন্দপতন ঘটায়।‌ তবে হ্যাঁ, সুদূরপ্রসারী উন্নয়ন পরিকল্পনা সঠিক ভাবে প্রয়োগ করা গেলে নদীর উপর কর্তৃত্ব ফলানো যেতে পারে। যেমন‌— দামোদর নদী উপত্যকা পরিকল্পনা। সে এক বৃহৎ অঞ্চল, তাই সেটা সম্ভব হয়েছে। ছোট ছোট নদীর ক্ষেত্রেও দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের লক্ষ্যে ক্ষুদ্র পরিসরে পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে। তার জন্য চাই নদী-মানুষ-পরিবেশ বিষয়ক ভাবনা। কিন্তু এই ভাবনা ভাববে কে!

Advertisement

কেলেঘাই নদীর ডান তীরের উপনদী বাগুই। কম দৈর্ঘ্যের কারণে বাগুই খাল নামে পরিচিত। এই নদীর গতিপথ‌ও বর্তমানে রুদ্ধ। গ্রীষ্মকালে ক্ষীণ প্রবাহ হলেও বর্ষাকালে দু’কূল‌ ছাপিয়ে এর ভয়াবহ রূপ নজরে আসে। দাঁতন-২ ব্লকের খাকুড়দা প্রতি বছর‌ই বন্যা-কবলিত হয় বাগুই নদীর কারণে। শোনা যায়, এক সময় এই বাগুই নদীতে চলত নৌকা। জলপথের মাধ্যমে চলত ব্যবসা-বাণিজ্য। এখন সে সব অতীত।‌

বেশির ভাগ মানুষ যদি তাঁদের তাৎক্ষণিক লোভের স্বার্থে নদীর উপর বছরের পর বছর ধরে আঘাত হানতে থাকে, তার ফল মারাত্মক হতে পারে। শিক্ষিত মুষ্টিমেয় মানুষের ভাবনা বার বার হার মানে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও অধিক সংখ্যক মানুষের ভুল ভাবনার কাছে। জলসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক, পরিবেশ বিভাগ ও জীববৈচিত্র সংরক্ষণ বিভাগ যদি এই বিষয়গুলো নিয়ে না ভাবে, তা হলে কয়েক জন মানুষের পক্ষে একটা নদীর গুরুত্ব জনসমাজের কাছে তুলে ধরা খুবই কঠিন। উন্নয়ন মানে নতুন রাস্তাঘাট নির্মাণ, জীবনের স্বাচ্ছন্দ্যবোধ, আর্থিক সহায়তা ইত্যাদি নয়। উন্নয়ন তখন‌ই সম্ভব, যখন পরিবেশকে সুস্থ রেখে জীবনের মানোন্নয়ন করা যাবে। এ ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিসরে পরিবেশ বিষয়ক আইন, জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা খুব প্রয়োজন।

নরসিংহ দাস, মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

প্রীতির বাঁধন

অনিতা অগ্নিহোত্রী তাঁর প্রবন্ধে প্রাকৃতিক সম্পদকে বিনষ্ট করার কারণ হিসাবে জনাকয়েকের লোভ ও শাসনব্যবস্থার উদাসীন মনোভাবকে দায়ী করেছেন। সংবিধান যতই শাসককে পরিবেশ সম্পর্কে যত্নশীল হওয়ার নির্দেশ দিক, শাসক সেই নির্দেশ অমান্য করছে। বরং শাসক দলের নেতা অনন্ত হেগড়ে সংবিধান বদলের পক্ষে সায় দিচ্ছেন। নদী বরাবর অবহেলায় থেকেছে। নদীকে নিয়ে রাজনীতি হয়েছে, তাতে নদী বা নদী-তীরবর্তী মানুষের জীবনের কিছুই বদল হয়নি। নদী গভীরতা হারিয়েছে, নদীর দখল নিয়েছে বালি মাফিয়া, অযত্নে থাকা নদীগর্ভে চলে গেছে বহু চাষের জমি। বর্তমানে নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে সঙ্ঘবদ্ধ দুর্নীতি। হাজার অভিযোগ থাকলেও সুরাহা মেলে না। উত্তরবঙ্গের নদীগুলোতে মিশছে পাহাড়ের বিষ। তাই আদালত ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি গঠন করেছে। গত বছর বন্যার পরে আপাতত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তিস্তা নদীর উপর আর নতুন করে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প চালু করা হবে না। শোনা যাচ্ছে, এ বারের লোকসভা ভোটে নদী একটা বড় বিষয় অসমের লখিমপুর অঞ্চলে। নদীর সঙ্গে জীবনের সম্পর্ক নিবিড়। কবি কুমুদ রঞ্জন মল্লিক অজয় নদ সম্পর্কে লিখেছিলেন, “অজয় আমার ভাঙবে গৃহ, হয়ত দুদিন বই/ তবুও তাহার প্রীতির বাঁধন টুটতে পারি কই?” নদীর গতিপথে যেমন তৈরি হচ্ছে বেআইনি নির্মাণ, তেমনই প্রবল বন্যায় ক্ষতি হচ্ছে নগরজীবনের। নদী আজ অসহায়, অসুস্থ। এখনও সময় আছে মানুষের জেগে ওঠার। ভবিষ্যৎ কিন্তু আতঙ্কের।

তন্ময় কবিরাজ, রসুলপুর, পূর্ব বর্ধমান

নদীর শব্দ

“আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে/ বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে...” বা “যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে/ সহস্র শৈবালদাম বাঁধে আসি তারে...”— দু’টি ভিন্ন কবিতার বাক্য স্কুলবেলায় প্রায় সকলেরই পড়া। সব বড় নদীই যখন ছোট হয়ে যায়, ছোট হতে হতে বিস্তীর্ণ তটভূমিতে চড়া পড়ে গোচারণ ক্ষেত্র বা জনপদ গজিয়ে ওঠে, বিশাল সেতু পার হয়ে যাওয়ার সময় ট্রেনে বসে বিস্ফারিত নেত্র আবিষ্কার করে, নদীতে জলই নেই। মানুষের লোভ, ‘উন্নয়ন’-এর জোয়ারে এক-একটা নদী চুরি হয়ে যায়। একেই কি বলে উন্নয়ন?

তথ্য বলছে, কেলেঘাই নদী উৎপন্ন হয়েছে ঝাড়গ্রাম জেলার কলসিডাঙা গ্রামে, তার পর ভগবানপুর ও সবং-এর নৈপুর ছাড়িয়ে জলপাই-এর কাছে কেলেঘাই কংসাবতীতে মিলিত হয়েছে। আদপে কেলেঘাই কংসাবতীর ডান তীরের উপনদী। ১২১ কিমি দীর্ঘ নদীটির নামকরণ করেছেন লোধারা। বর্ষায়, টানা বৃষ্টিতে কেলেঘাই উপচে পড়ে ভাসিয়ে দেয় গ্রাম, জনপদ, রাজ্য সড়ক। সে রূপ বড় ভয়ানক। আর বাকি সময়? চৈতন্যদেবের স্মৃতিবিজড়িত কেলেঘাইয়ের তীরের হিজলের বন এখন অদৃশ্য। তীরে ইউক্যালিপটাসের রাজত্ব, দ্রুত বৃদ্ধি যাদের, জলস্তরকে নীচে নামিয়ে দিতে যে বৃক্ষগুলির বিকল্প নেই। তবু, বন দফতর রোপণ করে তাদের। অনেক দিন আগে এক জন পরিবেশবিদ বলেছিলেন, হাইওয়ের ধারে, নদীর তীরে আম-জাম-পেয়ারার মতো আদি-অকৃত্রিম বাংলার গাছ রোপণ করলে পক্ষিকুল বাঁচত। ফল পাকলে হতদরিদ্র মানুষ, গাঁয়ের ছেলেপিলেরা সানন্দে খেয়ে বাঁচত। নদীতট মজবুত হত। হায়! এত সব ভাবার সময় কোথায়?

নদী সংরক্ষণকারীরা বড় মায়ায় জড়িয়ে থাকেন। উত্তরবঙ্গের তিস্তা, মহানন্দা, বালাসন নদীর নামে কত ছোট পত্রিকা প্রকাশিত হত, এখনও হয় হয়তো। সমাজমাধ্যমে দেখেছিলাম, শিলিগুড়ি উত্তরের এক দঙ্গল কবিতা-পাগল ছেলেমেয়ে শিলিগুড়ি জংশন নামে এক পত্রিকা বার করে। প্রায়শই তাদের দ্বিপ্রাহরিক-সান্ধ্য জমায়েত হয় শাহু নদীর ধারে। ঘটনাচক্রে গত ডিসেম্বর শিলিগুড়ি যেতে হয়েছিল। ‘শাহু’ নামে এক ক্ষীণকায়া জলহীন নালা দেখতে পেলাম। আর শহর শিলিগুড়ির উত্তর-দক্ষিণকে জুড়েছে যে প্রাণের নদী মহানন্দা, চুরি হতে হতে তার তটভূমি এখন ঘন-জনবসতি। বর্ষায় ঘর-বাড়ি-জনবসতি তছনছ করে সে তার প্রকৃত রূপ দেখায়। জল নামলেই পুরনো দৃশ্য। বালাসন নদীর বালি চুরির সঠিক পরিমাণ হয়তো বলতে পারবেন পরিবেশবিদরা। কংক্রিটের জঙ্গলে ছয়লাপ শহর শিলিগুড়ি।

বিপন্ন কেলেঘাইয়ের কথা লিখেছেন প্রবন্ধকার। এই বঙ্গের কত কেলেঘাই যে মৃতপ্রায়, তার খবর রাখেন কিছু মানুষ। বালুরঘাটের প্রিয় নদীকে নিয়ে ‘আত্রেয়ী বাঁচাও আন্দোলন’ এখন খবর হয়েছে। স্বচক্ষে দেখেছি, শহরের দুই পাড়ের সঙ্গে যোগাযোগ মাধ্যম ছিল পূর্বে নৌকা। এখন ঝাঁ-চকচকে সেতু। ও দিকে জল ভাগাভাগি নিয়ে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে দ্বৈরথ।

বড় প্রিয় কয়েক ছত্র উদ্ধৃত করি। “ঘোর অন্ধকারে নদীবাঁধে কান রেখে নিমাই মাঝে মাঝেই শুয়ে থাকে। গাঁয়ের লোক বলে নিমাই একটা খ্যাপাটে মানুষ। ...গভীর রাতে বাহুডোর ছেড়ে এই নদীবাঁধের ওপর একটা কান পেতে ও শুয়ে থাকে। ...বাঁধের পাশে খরস্রোতা নদী বয়ে যাচ্ছে। সেই স্রোতের একটা কুলকুল কলকল শব্দ, জোয়ারের বা ভাটার টানে ঝুরঝুর করে মাটি ধসে পড়ার শব্দ, দূর দূর থেকে বয়ে আসা বাতাসের একটা অনুভূতি যা তার কাছে শব্দের রূপ নেয়।” (‘জীবনের খোঁজ’, তুষার কাঞ্জিলাল)।

সেই কুলকুল, ছলছল শব্দ হারিয়ে গিয়েছে অনেক নদী থেকেই।

ধ্রুবজ্যোতি বাগচী, কলকাতা-১২৫

আরও পড়ুন
Advertisement