football

সম্পাদক সমীপেষু: পুঁজির খেলা?

এই ‘মোহনবাগান’ বনাম ‘ইস্টবেঙ্গল’ বা ‘ঘটি’ বনাম ‘বাঙাল’ এই তরজা লাগিয়ে রাখার পিছনে অনেক ব্যবসায়িক স্বার্থও লুকিয়ে থাকে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০২২ ০৪:৪৬
একমাত্র খেলাই পারে সব বিভেদ ঘুচিয়ে দিতে।

একমাত্র খেলাই পারে সব বিভেদ ঘুচিয়ে দিতে। ফাইল চিত্র।

বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কে জেতে কে হারে’ (১৬-১১) শীর্ষক লেখাটি মন ছুঁয়ে গেল। দেশ ভাগ, ভিটেমাটি হারানো, প্রাণের দায়ে চোদ্দো পুরুষের স্মৃতি বিজড়িত বাড়িঘর, নিজের পেশা, রুটিরুজি সব ছেড়ে রাতারাতি পরবাসী হয়ে যাওয়া মানুষকে যে কী অপমান আর যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে যেতে হয়েছে, সেটা অনুভব করার জন্য যে হৃদয়ের প্রয়োজন, তা মনে হয় বহু মানুষের নেই। তাই, বার বার এই ধরনের লেখার অবতারণা করতে হয়। যখন নদী বা সমুদ্রের ভাঙনে চোখের সামনে ভিটেমাটি, মন্দির, মসজিদ, চাষের জমি তলিয়ে যেতে দেখা সব হারানো মানুষের হাহাকারের ছবি সামনে আসে, তখন কোথায় যেন সেই মুখগুলো আর দেশভাগের বলি হয়ে যাওয়া মানুষের মুখের ছবি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।তখন কোথায় ‘বাঙাল’ আর কোথায় ‘ঘটি’! এই প্রসঙ্গে আরও একটিকথা না বলে পারছি না, এই ‘মোহনবাগান’ বনাম ‘ইস্টবেঙ্গল’ বা ‘ঘটি’ বনাম ‘বাঙাল’ এই তরজা লাগিয়ে রাখার পিছনে অনেক ব্যবসায়িক স্বার্থও লুকিয়ে থাকে। সংবাদমাধ্যম থেকে খেলা সম্প্রচারকারী টিভি চ্যানেল— কেউই এর বাইরে নয়। কিন্তু বিষয়টা যত ক্ষণ মজার থাকে, তত ক্ষণ পর্যন্ত মেনে নেওয়া যায়। মাত্রা ছাড়ালেই মুশকিল। একমাত্র খেলাই পারে সব বিভেদ ঘুচিয়ে দিতে।

আমি মোহনবাগানের সমর্থক হলেও ইস্টবেঙ্গল যখন অন্য কোনও দলের সঙ্গে খেলে, তখন তাকেই সমর্থন করি। সেটা মহমেডান বা বাংলার অন্য কোনও দলের ক্ষেত্রেও ঠিক। তবে প্রতিবেদকের লেখার সঙ্গে সহমত পোষণ করেও একটা বিষয়ে একমত হতে পারলাম না— ‘…পরাজয় বৃহৎ পুঁজির কাছে অল্প পুঁজির’। ইস্টবেঙ্গলের সমর্থক পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে আছে। ফুটবলের পরম্পরা বা ঐতিহ্যেও কিন্তু দলটা পিছিয়ে নেই। কিন্তু ইস্টবেঙ্গলকে গোঁড়ামি ছেড়ে বাজারের সঙ্গে তাল মেলাতে হবে। ঐতিহ্য আঁকড়ে থাকলে স্পনসর জুটবে না। বাজেট না বাড়ালে ভাল টিমও তৈরি করা যাবে না। সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারলে অন্য বহু ঐতিহ্যশালী প্রতিষ্ঠানের যে হাল হয়েছে, এরও তাই হবে। শেষে বলি, খেলাটা খেলার মাঠেই থাক, সমাজজীবনে এর প্রভাব যত কম পড়ে ততই মঙ্গল।

Advertisement

তুলসী প্রসাদ দাস মহাপাত্র, মৈতনা, পূর্ব মেদিনীপুর

সেই দ্বৈরথ

২৯ অক্টোবর টানা সাত বার ডার্বি জিতে নৈশালোকে যুবভারতী যখন সবুজ-মেরুন ঝড়ে মাতোয়ারা, তখন চির-প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে স্বাভাবিক ভাবেই বাঁধনহারা উল্লাস এবং হারের হতাশা দুই ছবিই এক সঙ্গে দেখা যায়। এ বারেও ভরপুর স্টেডিয়াম সমর্থকদের উল্লাসে যথারীতি জমজমাট ছিল। খেলা শেষে পরাজিত দলের সমর্থকদের অশ্রুসিক্ত চাউনি এবং জয়ী দলের হর্ষধ্বনিতে সেই চিরায়ত বাঙাল-ঘটির দ্বৈরথের চেনা ছবি, ইতিহাস সমেত পরিপূর্ণ ভাবে ফুটে উঠেছে বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্তর-সম্পাদকীয় নিবন্ধে।

টানা সাত বার ডার্বি জিতে মোহনবাগানিরা আনন্দে মেতে উঠবে, জানা কথা। ম্যাচের পর দিন শ্যাম থাপা-র প্রতিবেদনে (‘বুমোসদের গতির কাছেই ফের আত্মসমর্পণ’, ৩০-১০) পাওয়া গেল জুয়ান ফেরান্দোকে নির্দেশ, যদি গোল না হয়, মাঠে অজস্র পাশ খেলা অর্থহীন। চ্যাম্পিয়ন হতে গেলে, জেতার অভ্যাস বজায় রাখতে হলে, পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন, যে কোনও সুযোগকে গোলে পরিণত করতে হবে। অন্য দিকে, স্টিভন কনস্ট্যান্টাইনের অধীনে ইস্টবেঙ্গল দল পায়ের নীচে জমি খুঁজে পেলেও ফুটবলারদের মধ্যে মনের জোর, ক্লাবের প্রতি ভালবাসা ও আনুগত্যবোধ, লড়াকু মানসিকতা এবং জেদ ধরে রাখার অভাব পরিলক্ষিত হয়েছিল। ১৯৭৭ সালের কলকাতা লিগের উদাহরণ দিয়ে তিনি লিখেছিলেন, উক্ত মরসুমে সেরা ফুটবলারদের সকলেই মোহনবাগানে চলে গেলেও ইস্টবেঙ্গল জিতেছিল ২-০ গোলে।

তার পর চার দশক অতিক্রান্ত। পাল্টেছে ফুটবলের সংজ্ঞা এবং দলের সামগ্রিক দর্শন। গত বছর তিনেক ধরে মোহনবাগান দল শক্তিশালী এবং নিখুঁত হয়ে উঠেছে। কিন্তু, এ বারের ডার্বি উপভোগ্য হয়নি বলে তাঁর বিশ্বাস। দ্বৈরথে উঠে আসেনি শোরগোল ফেলে দেওয়া মনের মতো কোনও ফুটবলার।

সমর্থক এবং ভক্তবৃন্দ দু’টি দল নিয়ে যে আবেগে ভাসেন, তাতে মোহনবাগান মানেই ‘ঘটি’ এবং ইস্টবেঙ্গল দল তার নামেই নিজের পরিচয়বাহী। সমর্থকরাও দুই ভাগে বিভক্ত স্বভাবতই। কিন্তু, দু’টি দলেই তো মেরেকেটে পাঁচ জন বঙ্গতনয়। তা হলে ‘ঘটি’ ‘বাঙাল’ নিয়ে এত রঙ্গ-রসিকতা, কদর্য বিদ্রুপ কেন? ‘খণ্ডিত বাংলা’য় বঙ্গভঙ্গ উত্তর কালে যাঁরা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তু হয়ে এ বঙ্গে আসেন, দুর্বিষহ রিফিউজি-ক্যাম্পের বিভীষিকাময় জীবনযাপনের গ্লানি সত্ত্বেও তথাকথিত ‘বাঙাল’ তকমায় গর্ব অনুভব করেন তাঁরা। কিন্তু, তাঁদের উত্তর পুরুষ, যাঁরা হয়তো কখনও বাংলাদেশে যাননি, তাঁরাও রন্ধ্রে রন্ধ্রে পূর্বপুরুষদের দেশত্যাগজনিত দুঃখানুভূতিতে জর্জরিত হয়ে আবেগ বশে ‘ইস্টবেঙ্গল’ দলকে সমর্থন করেন। মহমেডান স্পোর্টিং দলের নামেই দলটির পরিচিতি হলেও খেলার ক্ষেত্রে স্পর্শকাতর ধর্মীয় বোধ একান্ত ভাবেই আরোপিত হবে, এমন তো নয়! আসলে, খেলোয়াড়ের একটাই পরিচয়, তিনি খেলোয়াড়। জাত-ধর্ম-বাংলাদেশ-পশ্চিমবঙ্গ-বিদেশ সব বিভাজন মুছে যায় চোখের সামনে বিশ্ব ফুটবলের মহারথীদের দ্বৈরথ দেখে। বিশ্বকাপের মৌতাতে যখন তামাম বাঙালি মেতে ওঠেন তখন এক বারের জন্যও কি এই হাহুতাশ প্রাধান্য পায় যে, ভারত কবে ক্রীড়াজগতে ‘শ্রেষ্ঠ আসন লবে’?

ইতিহাস বলে, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন শুরুর পর্বে জাতীয়তাবাদী কল্পনাশক্তিকে জাগরিত করতে কলকাতার মিত্র এবং সেন পরিবারের সহায়তায় ও ভূপেন্দ্রনাথ বসুর সভাপতিত্বে ১৮৮৯ সালের ১৫ অগস্ট মোহনবাগান ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯১১ সালে শিবনাথ ভাদুড়ির নেতৃত্বে ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্টকে ২-১ গোলে পরাজিত করে ইতিহাস সৃষ্টি করে মোহনবাগান। অবিশ্বাস্য দৃঢ়তায় দলের প্রত্যেকে খালি পায়ে খেলেছিলেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে।

পুঁজির নিরিখে মোহনবাগান সব সময়ই ইস্টবেঙ্গলের থেকে এগিয়ে— এ সত্যও অস্বীকৃত হওয়ার নয়। তবে, বর্তমানে কোন দল কত কোটি টাকা খরচ করে ক’জন বিদেশি ফুটবলার এনে দল গড়ছেন, সেটি বিবেচ্য নয়। স্পনসরদের অর্থে এখন জয়-বিজয় নির্ণীত হয়। কোচ দলের সংগঠনে, মনোবল প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু, টাকার গর্বে বলীয়ান হয়ে, ডার্বি জিতে মাসলম্যানের মতো দানবীয় শক্তি অর্জিত হয় না। খেলায় হার-জিত আছে। তাই হেরোদের ‘বাঙাল’ তকমায় দেগে দিয়ে আত্মপ্রসাদ বা লঘু আনন্দ লাভ করা মূর্খামি। যদিও এটা বাঙালিদের সহজাত। প্রবন্ধকার ‘স্বাদেগন্ধে অতুলনীয়’ বাঙালদের রান্নার প্রসঙ্গ এনেছেন। ঘটিদের উক্তি এই প্রসঙ্গে ‘ওরা তো কচু-ঘেঁচু শাকপাতা খায়’। পরিচিতি প্রদানের এই দুর্ভেদ্য টিটকিরিতে যখন বাঙালিরাও জড়িয়ে পড়েন, তখন লজ্জা হয়। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের স্বীকৃতিপ্রদানে গর্ববোধ হওয়াই কিন্তু মানবজাতির পরিচয়।

ধ্রুবজ্যোতি বাগচি, কলকাতা-১২৫

পক্ষিনিধন

ইদানীং গ্রামের পুকুরগুলিতে পাখির হাত থেকে মাছ বাঁচাতে জাল টাঙানো হচ্ছে। এতে মাছ কত বাঁচছে জানা নেই, কিন্তু প্রচুর পাখি মারা পড়ছে। বিশেষ করে মাছরাঙা, বক, পেঁচা, পাতকো, কাঠঠোকরা, ছাতারে, বসন্তবৌরি প্রভৃতি। পরিবেশ-বিরোধী জাল টাঙানোর এই নতুন সংস্কৃতি বন্ধে প্রশাসন ও বন বিভাগ উদ্যোগী হোক। জাল না টাঙিয়ে লম্বালম্বি সুতো টাঙানো যেতে পারে। এতে পাখিও মারা পড়বে না, জলে পাখির উপদ্রবও কমবে। এমনিতেই পক্ষিকুল বিপন্ন। জালের মৃত্যু-ফাঁদ রচনা করলে তারা যাবে কোথায়?

প্রদীপ রঞ্জন রীত, আমতা, হাওড়া

আরও পড়ুন
Advertisement