Raja Rammohan Roy

সম্পাদক সমীপেষু: পথিকৃৎ রামমোহন

গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় যেমন যেমন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা পাবে, তেমনই দূর হতে থাকবে দুর্নীতির প্রবণতা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১২ মার্চ ২০২২ ০৭:১০

মল্লারিকা সিংহ রায়ের ‘অপ্রমত্ত সত্যসন্ধানী’ (১৯-২) শীর্ষক প্রবন্ধ সূত্রে কিছু কথা। রামমোহন রায় ছিলেন দৃপ্ত সমাজ-বিপ্লবী। সেই সঙ্গে নারী জাগরণেরও পথিকৃৎ। এক সময়ে বিধবাদের জন্য ধনভান্ডার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সম্বাদ কৌমুদী’র পাতায় ধনীদের কাছে আহ্বান জানিয়েছিলেন। নারীজাতির কল্যাণে বহুবিবাহ এবং কন্যা বিক্রয়ের প্রথার বিরোধিতা করেছিলেন। তাঁর লেখা সতীদাহ নিবারণ বিষয়ক প্রবন্ধ নিয়ে সম্বাদ কৌমুদী-র (১৮২১) দৃপ্ত আত্মপ্রকাশের কথা তো আমরা সবাই জানি। সাধারণের হিতসাধনের উদ্দেশ্যে এই পত্রিকা সামাজিক ও রাজনৈতিক নানা বিষয়ে সেই সময় সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করত।

১৮১২ সালে রামমোহন চোখের সামনে দেখেছিলেন বৌদি অলকমঞ্জরীর সতীদাহ হওয়ার ঘটনা। ১৮১১-১২ সাল থেকেই তিনি এই কলঙ্কজনক প্রথার বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন। মিস কলেট লিখেছেন, রামমোহন নিজে কলকাতার শ্মশানে গিয়ে সতীদাহ আটকানোর জন্য অনুরোধ-উপরোধ করতেন। এই অমানবিক ও নৃশংস দেশাচার তিনি মেনে নিতে পারেননি। কলকাতায় এসে তিনি সহমরণ বিষয়ে তিনটি বই লিখেছিলেন। ইতিমধ্যে তিনি সংস্কার কাজকে সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে করার জন্য মানিকতলার বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘আত্মীয় সভা’ (১৮১৫), যেখানে নিয়মিত পরিবেশিত হত ব্রহ্মসঙ্গীত ও বেদপাঠ। এ সব তথাকথিত অনাচারে দেশ খেপে উঠেছিল। রামমোহনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার জন্য রাধাকান্ত দেব-সহ ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, গৌরীকান্ত ভট্টাচার্য প্রমুখ নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। নানাবিধ কটূক্তি করা থেকে প্রাণে মারার ষড়যন্ত্র পর্যন্ত করেছিলেন।

Advertisement

অজস্র নিন্দা সত্ত্বেও রামমোহন তাঁর কাজ থেকে সরে দাঁড়াননি। “নিজের মহত্বে তাঁহার কী অটল আশ্রয় ছিল, নিজের মহত্বের মধ্যেই তাঁহার হৃদয়ের কী সম্পূর্ণ পরিতৃপ্তি ছিল, স্বদেশের প্রতি তাঁহার কী স্বার্থশূন্য সুগভীর প্রেম ছিল!” (চারিত্রপূজা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)। শিক্ষাবিস্তার ছাড়া প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয় জেনে রামমোহন ডেভিড হেয়ারের পরামর্শে আধুনিক শিক্ষালয়ের প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়েছিলেন। অবশ্য হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠায় বিরোধীদের চক্রান্তে রামমোহন তাঁর অধ্যক্ষতা থেকে সরে এসে কলেজ প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছিলেন। তবে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার (১৮১৭) আগেই ১৮১৬ সালে তিনি হেদুয়ার কাছে শুঁড়িপাড়ায় একটি ইংরেজি বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন নিজ ব্যয়ে। এর পরে নিজের বাড়িতে আরও একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। সেই সঙ্গে পাশ্চাত্য বা আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারে হেদুয়ার উত্তরে ১৮২২ সালে নিজস্ব ব্যয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘অ্যাঙ্গলো হিন্দু স্কুল’। পাশাপাশি তিনি দেশীয় ভাষা প্রয়োগের উপরও জোর দিয়েছিলেন। বাংলা ভাষার উন্নতিতেও তাঁর উদ্যোগ ও অবদান ছিল অপরিসীম। ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ’ রচনা তাঁর এক অবিস্মরণীয় কাজ।

রাজস্বব্যবস্থা, ভূমিব্যবস্থা ও বিচারব্যবস্থা সম্পর্কেও রামমোহনের গভীর চিন্তার পরিচয় পাওয়া যায় ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সিলেক্ট কমিটির প্রশ্নের উত্তর লেখা থেকে। কৃষকদের আত্মনির্ভরতার জন্য তিনি চেয়েছিলেন জমিতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দেওয়া হোক চাষিদের। রায়তদের উন্নতি ও উন্নত প্রশাসনের কথা ভেবেছিলেন তিনি। বলেছিলেন প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থাকে পৃথক করতে। আসলে তাঁর সব চিন্তাতেই ছিল দেশবাসীকে উন্নততর আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা ও নৈতিক উৎকর্ষের পথে চালিত করার অদম্য প্রয়াস।

সুদেব মাল

খরসরাই, হুগলি

সাজানো স্বরাজ

‘এত পুকুর খুঁড়ব কোথায়?’ (১৫-২) প্রবন্ধে স্বাতী ভট্টাচার্য খুব প্রয়োজনীয় প্রশ্ন তুলেছেন। গ্রাম পঞ্চায়েতের কাজের দায়িত্বে কেন থাকবেন বিডিও? নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তবে কী করতে আছেন? তাঁদের কাজ কী? বিডিও, মহকুমা শাসক বা জেলা শাসক, সর্বস্তরের সরকারি আধিকারিকদেরই তো বরং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রশাসনিক কার্যনির্বাহী হিসাবে থাকা উচিত। নয়তো নির্বাচিতদের কার্যত মূল্যই থাকে না। প্রতিনিধিরাই জনগণের কাছে দায়বদ্ধ, তাঁদেরই জবাবদিহি করতে হয় জনগণকে। না হলে এত ঘটা করে নির্বাচনের কী প্রয়োজন?

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন জেলাস্তরে প্রশাসনিক বৈঠক করেন, তখন জনপ্রতিনিধিদের গুরুত্ব না দিয়ে ডিএমদের সঙ্গে কথা বলেন। জনপ্রতিনিধিরা নিধিরাম সর্দার হয়ে থাকেন। এখানেই রাষ্ট্রের চরিত্রটা স্পষ্ট হয়। রাষ্ট্র যেন চায় পঞ্চায়েত ব্যবস্থাটিকে ‘শো-কেস’-এ সাজিয়ে রাখার সামগ্রী করে তুলতে। ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থার সবচেয়ে নীচের স্তর, অর্থাৎ গ্রাম পঞ্চায়েতই তো আসল ক্ষমতার উৎস। কী কাজ প্রয়োজন, সে বিষয়ে তাদের সুপারিশকেই প্রধান গুরুত্ব দেওয়ার কথা উপরের স্তরগুলির। অথচ, উপর থেকে কাজ স্থির হয়ে আসে, নীচের তলা স্রেফ উপরতলার খিদমতগারি করে। এ যে গণতন্ত্র নয়, কে না জানে।

পঞ্চায়েতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি গুরুত্বহীন, কারণ মানুষই গুরুত্বহীন। জনপ্রতিনিধি কথা বললে সে তো মানুষই কথা বলবে। আর তাতেই যত ঝঞ্ঝাট। নীচের তলা থেকে ওঠা যে কোনও প্রশ্ন গোড়াতেই মুড়িয়ে দিতে হবে, যাতে তা মাথা তুলতে না পারে। নিরাপদ বরং আমলারা। তাঁরা প্রশ্নহীন ভাবে নির্দেশ অনুসারে কাজ করবেন, কারণ তাঁরা চাকরি করেন।

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, স্বরাজ গাছের ডালে টাঙিয়ে দেওয়ার জিনিস না, কারণ তা গাছের ফল। উন্নয়নও তো তেমনই চকমকি কাগজের চোখধাঁধানো সজ্জা নয়, তা আপন অন্তরের খুশিতেই উজ্জ্বল। সে কারণেই বুঝি কোথায় কী হল, তা কার কী কাজে লাগল, কত খরচ হল, সে সব কথা এলেবেলে হয়ে গিয়েছে।

লেখক যথার্থই বলেছেন, প্রকল্পের সঙ্গে প্রয়োজনের বিস্তর ফারাক। এই কারণেই ১০০ দিনের কাজ কেবল কর্মসংস্থানের, আর্থিক নিরাপত্তার প্রকল্প হয়ে রয়েছে। অথচ মহাত্মা গান্ধীর ভাবনায় তা শুধু স্বরোজগারের নয়, স্বরাজের, সক্ষমতা সৃষ্টির, সম্পদ নির্মাণের, মর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রকল্প। জীবন ধারণের ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য শ্রম। সুষ্ঠু ও পরিচ্ছন্ন সমাজ গড়ার জন্য গণতন্ত্রের নিয়মিত চর্চা ও আন্তরিক অনুশীলন ছাড়া কোনও বিকল্প নেই। চলতে চলতেই তার প্রাপ্তি ও পরিমার্জনা। তাই দুর্নীতি নিয়ে তত দুশ্চিন্তা হয় না। গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় যেমন যেমন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা পাবে, তেমনই দূর হতে থাকবে দুর্নীতির প্রবণতা। তত দিন সঙ্গ ছাড়বে না স্বজনপোষণ, ক্ষমতার জন্য হিংসা।

শিবপ্রসাদ দাস

আন্দুল-মৌড়ি, হাওড়া

ভুলেই থাকি

পঁয়ত্রিশ বছর আগে দেশে-গ্রামে অধিকাংশ বাড়িতে টিভি ছিল না, ইন্টারনেট, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন তো দূরের কথা। যে দু’চারটি বাড়িতে টিভি থাকত, তা-ও সাদাকালো। অধিকাংশ সময় লোডশেডিং, তাই ব্যাটারি আবশ্যক। বাড়ির ছাদে অ্যান্টেনা। চ্যানেল বলতে মাত্র দু’টি। বাঙালি বাড়িতে তখন বাংলা অনুষ্ঠান দেখারই রেওয়াজ ছিল। হিন্দি অনুষ্ঠান প্রায় কেউ দেখত না। কিন্তু সেই সময় দু’টি হিন্দি ধারাবাহিক ভাষার বাধা পেরিয়ে আসমুদ্রহিমাচল কাঁপিয়ে দিয়েছিল— রামানন্দ সাগর নির্মিত ‘রামায়ণ’ এবং বি আর চোপড়া-রবি চোপড়ার সৃষ্ট ‘মহাভারত’। রবিবার সকালে এক ঘণ্টা সারা ভারত টিভির সামনে নিশ্চল হয়ে যেত। অভিনেতারাও ছিলেন তুমুল জনপ্রিয়। এঁদেরই এক জন প্রবীণকুমার সোবতি সম্প্রতি প্রয়াত হলেন। ‘মহাভারত’-এ তিনি ভীমের চরিত্রে অভিনয় করেন।

সুঠাম চেহারা। গদা হাতে দাঁড়ালেই সবার মনোযোগ আকর্ষণ করতেন। তাঁর প্রয়াণের খবরে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে আছে (‘প্রয়াত অভিনেতা’, আনন্দ প্লাস, ৯-২)। ভদ্রলোক নাকি শেষ জীবনে আর্থিক কষ্টে ভুগছিলেন। যাঁরা আমাদের জীবনের একটা সময়কে এত মধুময় করে রেখেছিলেন, কত সহজেই না আমরা তাঁদের ভুলে যাই।

সুগত ত্রিপাঠী

মুগবেড়িয়া, পূর্ব মেদিনীপুর

আরও পড়ুন
Advertisement