টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ম্যাচে ভারত নিউ জ়িল্যান্ডের কাছে হারার পর ক্রিকেটারদের ব্যর্থতা নিয়ে কাটাছেঁড়া চলছে। সেই সঙ্গে এই হিসাবও চলছে যে, এর পরও আফগানিস্তান, স্কটল্যান্ড বা নামিবিয়া যদি নিউ জ়িল্যান্ডকে হারিয়ে দেয়, তা হলে ভারতের ভাগ্যে সেমিফাইনালে ওঠার শিকে ছিঁড়লেও ছিঁড়তে পারে।
কিন্তু কিছু অপ্রিয় সত্য সামনে আনা প্রয়োজন। প্রয়োজন, প্রশ্ন তোলার। প্রথমত, আইসিসি টি-টোয়েন্টি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট র্যাঙ্কিংয়ে এখন প্রথম দশ ব্যাটারদের তালিকায় ভারতের বিরাট কোহালি (পঞ্চম) এবং কে এল রাহুল (অষ্টম) ছাড়া আর কেউ নেই। প্রথম দশ বোলার বা অলরাউন্ডারের তালিকায় ভারতের এক জনও নেই। গায়কোয়াড় বা পৃথ্বী শ বা ময়াঙ্ককে সুযোগ না দিয়ে অসুস্থ হার্দিককে খেলানোর যুক্তি কোথায়? আসলে এ দেশে ফিল্মস্টার আর ক্রিকেটারদের ভগবানের কাছাকাছি বসানো হয়। তাঁদের নিয়ে মিডিয়া ও আমজনতার হ্যাংলামো সারা ক্ষণ লেগেই থাকে। ফলে কোহালি, হার্দিকরা খারাপ খেললেও কোটি কোটি টাকার অ্যাড পেয়ে যান। এয়ারপোর্ট বা মল দিয়ে হেঁটে গেলেই ভক্তরা তাঁদের ছেঁকে ধরেন। এবং তাঁরাও এই দেখে নিজেদের ভগবান ভাবতে শুরু করেন। বিশ্বমানের খেলায় ভারতের মান বাঁচানোর জন্য নিজেকে যে উজাড় করে দিতে হবে, সেটা মাথায় থাকে না। ফলে খেলার মাঠে শূন্য পেলেও এঁদের কিছু যায় আসে না।
এঁদের নিয়ে জনগণের এই বাড়াবাড়ি যত দিন শেষ না হবে এবং একটু নাম হলেই হাতে কোটি কোটি টাকার বিজ্ঞাপন আসা বন্ধ না হবে, হারের এই দৃশ্য তত ক্ষণ চলতেই থাকবে। আর জনগণও বোকা বনতেই থাকবেন।
অভিজিৎ মিত্র
বর্ধমান
অনভিপ্রেত
‘জয়ের পরে ভারতকে কটাক্ষ ইমরানের’ (৬-১০) সংবাদ প্রতিবেদনটির নিরিখে এই চিঠি। ভারতের বিরুদ্ধে জয় পাওয়ার পর দু’দেশের সম্পর্ক উন্নত করা একান্ত প্রয়োজন বলেও “রবিবার পাকিস্তান যে ভাবে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে হারিয়ে দিয়েছে ভারতকে, তার পরে পারস্পরিক আলোচনার জন্য এটা মোটেও ভাল সময় নয়” বলে ইমরান আরও বেশি উত্তেজনার সৃষ্টি করলেন কি না, প্রশ্ন রয়ে যায়।
যে কোনও খেলাকে কেন্দ্র করে রাজনীতি বা দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে কথা বলা যে কোনও রাষ্ট্রপ্রধানের থেকেই অনভিপ্রেত। আর এ ক্ষেত্রে মন্তব্যকারী শুধু প্রধানমন্ত্রী নন, এক জন বিশ্বকাপ-জয়ী প্রাক্তন অধিনায়ক। তাই তাঁর মন্তব্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। তিনি যদি চূড়ান্ত পরাজয়ের পরও ভারত অধিনায়ক বিরাট কোহালির চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দলের ক্রিকেটার রিজ়ওয়ান তথা বাবরদের প্রতি সৌজন্য প্রদান দেখে থাকেন, তবে নিশ্চয়ই পরবর্তীতে ক্রিকেট বা অন্য খেলার সঙ্গে রাজনীতিকে জড়ানো বা প্রতিবেশী দেশ সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করার আগে একটু ভাববেন। এক জন প্রাক্তন অধিনায়ক এক জন বর্তমান অধিনায়কের কাছ থেকে শিখতে পারবেন— ‘খেলা থাকুক খেলাতেই’।
উজ্জ্বল গুপ্ত
কলকাতা-১৫৭
গোঁড়ামি
বিশ্বকাপ ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় এই প্রথম আমাদের দেশ ভারত পাকিস্তানের কাছে পরাজিত হয়েছে। অবশ্যই তার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব পাকিস্তান ক্রিকেট দলের খেলোয়াড়দের। বিপক্ষ দলের তুলনায় আমরা সব বিভাগেই ব্যর্থ হয়েছি, যা এর আগে হয়নি। এই ব্যর্থতা দলগত, ব্যক্তিগত নয়। অথচ দেখা যাচ্ছে, তার পর থেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ধেয়ে আসছে বিরূপ মন্তব্য, বিশেষ করে ভারতীয় পেসার মহম্মদ শামির বিরুদ্ধে।
জাহির-নেহরা পরবর্তী যুগে মহম্মদ শামি ভারতীয় পেস বোলিং বিভাগের অন্যতম স্তম্ভ। একটা ম্যাচে খারাপ পারফরম্যান্স হলেই তাঁকে দেশদ্রোহী বলে দাগিয়ে দেওয়া গোঁড়ামিরই অন্য রূপ। শামি উত্তরপ্রদেশের নাগরিক হলেও অনেক বছর ধরে বাংলার ক্রিকেটের অবিচ্ছেদ্য সদস্য। তাঁর আগুনে বোলিং আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ভারতকে অনেক ম্যাচে দুর্দান্ত জয় এনে দিয়েছে। কিন্তু একটা ম্যাচে (হোক না তা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে) স্বভাবসিদ্ধ পারফরম্যান্স না করতে পারলেই কি তিনি দেশদ্রোহী? প্রত্যেক খেলোয়াড়, তিনি যে বিভাগেরই হন, যখন দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন তখন তিনি দেশের বা জাতির জন্য সব রকম আত্মত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকেন। তার পরেও যদি কোনও ক্ষেত্রে ফলাফল আশাব্যঞ্জক না হয়, সঙ্গে সঙ্গে কি তাঁকে বা তাঁদের দেশদ্রোহীর তকমা লাগিয়ে দিতে হবে? আসলে বর্তমানে কিছু সংখ্যক মানুষ সমালোচনা করতে গিয়ে অসভ্যতার পথ বেছে নেন। এঁরা বিরুদ্ধমত সহ্য করতে জানেন না। সেই সঙ্গে অন্ধ জাতীয়তাবাদ ও ধর্মান্ধতা তো রয়েইছে।
শামি, রাহুল, রোহিত-রা ভারতকে অনেক সাফল্য এনে দিয়েছেন এবং ভবিষ্যতেও এনে দেবেন। গোটা দলেরই ফর্ম ভাল যাচ্ছে না। এই অবস্থায় প্রিয় ক্রিকেট দলের পাশে না থেকে শুধুমাত্র সোশ্যাল মিডিয়ায় বিতর্ক তোলাটা অত্যন্ত অমানবিক।
স্বস্তিক দত্ত চৌধুরী
শান্তিপুর, নদিয়া
বিরাট হৃদয়
মহম্মদ শামিকে যখন দেশ জুড়ে অশালীন ভাষায় আক্রমণ করা হচ্ছে, তখন অন্য মেরুতে অবস্থান করছেন বিরাট কোহালি, যিনি অপরাজিত ৭৯ রানের ম্যাচ জেতানো ইনিংস খেলা পাকিস্তানি ওপেনার মহম্মদ রিজ়ওয়ানকে জড়িয়ে ধরেন। কোহালির সৌজন্যমূলক আচরণ অত্যন্ত দৃষ্টিমধুরই শুধু নয়, উগ্র ধর্মান্ধ সমর্থকদের প্রতি এক কড়া বার্তাও— তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা সত্ত্বেও পারস্পরিক শ্রদ্ধাকে জলাঞ্জলি দেওয়া যায় না। দুবাইয়ের মাঠে পাকিস্তান ভারতের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ম্যাচে জিতেছে; কিন্তু দিনের শেষে জিতেছে অবশ্যই ক্রিকেটের সেই সনাতন ভদ্রতা ও স্পিরিট।
এই চূড়ান্ত অসহিষ্ণু উত্তপ্ত সময়ে এক ‘বিরাট’ হৃদয় প্রদর্শন করার জন্য ভারতীয় অধিনায়ক কোহালিকে অজস্র ধন্যবাদ। পৃথিবীর বুক থেকে যুদ্ধ, সংঘর্ষ এবং সন্ত্রাসকে পুরোপুরি নির্মূল করা যখন সভ্যতার দাবি, তখন এক শ্রেণির তথাকথিত ক্রিকেট অনুরাগী, স্পনসর ও মিডিয়ার একাংশ খেলাধুলার মতো মহৎ একটি অঙ্গনকে ‘যুদ্ধ’-এর পূর্ণাঙ্গ থিয়েটারে রূপান্তরিত করার জন্য সদা ব্যস্ত। বিশেষ করে যখন ক্রিকেটের ময়দানে ভারত-পাকিস্তান মুখোমুখি হয়। হ্যাঁ, পাসপোর্ট অনুযায়ী বিরাট কোহালি এক জন ভারতীয় এবং মহম্মদ রিজ়ওয়ান পাকিস্তানি। কিন্তু, সবচেয়ে বড় সত্য এই যে, কোহালি এবং রিজ়ওয়ান মনুষ্যত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। তাঁরা একই বিশ্বের নাগরিক। আমাদের নিজ নিজ দল বা দেশ জিতলে নিশ্চয়ই তা আনন্দদায়ক। কিন্তু যদি তা না হয়, তা হলেও আমাদের বিপক্ষ দল বা দিনের সেরা দলকে সাধুবাদ জানাতে শেখা উচিত। এর নামই হল সভ্যতা। কেন আমরা রাষ্ট্র ও ধর্মের নামে মানুষে মানুষে ফাটল সৃষ্টি করে অন্ধকার যুগের দিকে পিছিয়ে যেতে উদ্যত হচ্ছি? আসিফ ইকবাল তাঁর জীবনের শেষ টেস্ট ইনিংসে খেলার পর যখন প্যাভিলিয়নে ফিরছিলেন (জানুয়ারি, ১৯৮০), তখন সমগ্র ইডেন গার্ডেনস উঠে দাঁড়িয়ে সেই পাকিস্তানি কিংবদন্তিকে শেষ দেখা পর্যন্ত আন্তরিক ভাবে করতালি দিয়ে বিদায় জানিয়েছিল।
সাম্প্রদায়িক মনের উগ্র জাতীয়তাবাদীদের নিশ্চিহ্ন করে ১৯৮০-র ইডেনের দর্শক ও ০১-এর বিরাট কোহালির মানবিক ভ্রাতৃত্বের পথে ‘ভদ্রলোকের খেলা’ ক্রিকেট অগ্রসর হতে থাকুক।
কাজল চট্টোপাধ্যায়
সোদপুর, উত্তর ৪ পরগনা