১৫ নভেম্বর প্রকাশিত পর পর দু’টি সম্পাদকীয় (‘পায়ে ঠেলার ব্যাধি’, ‘নূতন রোগ’) পরস্পরবিরোধী। প্রথমটিতে ডেউচা-পাঁচামির যে কর্মোদ্যোগকে বিপুল সম্ভাবনাময় বলা হয়েছে, সেই কাজ যে পরোক্ষ ভাবে আগামী প্রজন্মের জন্য বিষম ক্ষতিকারক, সে কথা দ্বিতীয়টিতে প্রকারান্তরে স্বীকৃত হয়েছে। গ্লাসগোর জলবায়ু সম্মেলনের আলোচনায় বিশ্বের কয়লা-বিরোধী মতামত জ্বলজ্বল করছে যখন, ঠিক সেই সময় পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে নতুন কয়লাখনি শুরু করার কাজকে স্বাগত জানানো ভবিষ্যৎ-বিরোধী। বিশ্বে এখন ‘গ্রিন এনার্জি’ ব্যবহারের উপর নির্ভর করে সুস্থায়ী অর্থনীতি তৈরি করা হচ্ছে, যার ফলে নতুন রুজি-রোজগারের রাস্তা খুলে যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে তার নানা সম্ভাবনা একটু সরকারি সমর্থন পেলে প্রচুর ফল ফলাতে পারে। অনেকের মধ্যে মাত্র একটা উল্লেখ করা যায়, সৌরশক্তি দিয়ে চাষের খেতে শ্যালো পাম্প চালানো। এতে চাষির খরচ কমা, নতুন কর্মসংস্থান এবং জলবায়ু দূষণ কমানো, তিনটে আশা-জাগানো কাজ হতে পারে। এই রকম আরও বহু সম্ভাবনা আছে।
২৩ মার্চ রয়টার্স-এর সংবাদ জানাচ্ছে, কোল ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান প্রমোদ আগরওয়াল বলছেন, আগামী দু’দশকের মধ্যে কয়লা তার ব্যবসা হারাবে সৌরশক্তি ও অন্যান্য নতুন জ্বালানির কাছে। তাঁরা সেই দিকে ব্যবসা পরিবর্তন করতে শুরু করেছেন। এই পরিস্থিতিতে নতুন কয়লাখনি খুলে আশা জাগানো
হচ্ছে, না ধ্বংসের আশঙ্কা, সেটা সহজেই অনুমেয়।
সুব্রত দাশগুপ্ত
কলকাতা-১৫৭
সিঙ্গুরের শিক্ষা
‘এখনও যদি সহমতে কাজ হত, আক্ষেপ সিঙ্গুরের’ (১১-১১) প্রসঙ্গে কিছু কথা। সিঙ্গুরের প্রেক্ষিতে জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে ‘সকলের’ আস্থা এবং সম্মতি আদায় ছিল সোনার পাথরবাটি। ৯৯৭ একরের বহুধাবিভক্ত জমির কয়েক সহস্র মালিকের ঐকমত্য এক আকাশকুসুম কল্পনা। তা সত্ত্বেও তদানীন্তন সরকার বর্ধিত ক্ষতিপূরণের অঙ্কে ৮০ ভাগেরও বেশি জমির মালিককে চেক প্রদানে সমর্থ হয়েছিল। ২০ শতাংশের কম অনিচ্ছুক জমির মালিকরা টাটা গোষ্ঠীকে বাধ্য করেছিলেন, এত বড় এক প্রকল্পকে ‘পরিত্যক্ত’ ঘোষণা করাতে। তাঁরা তখন পাশে পেয়েছিলেন বিরোধী রাজনৈতিক দলকে। বিরোধী দল, সরকার পক্ষ, অনিচ্ছুক কৃষক, তখন অনমনীয় অবস্থানে অনড় সবাই। সে দিনের সরকার আজ ইতিহাসে, সে দিনের বিরোধী প্রবল পরাক্রমে সরকারে অধিষ্ঠিত। আর এই বঙ্গে অন্য সব বিরোধীপক্ষ নিশ্চিহ্নপ্রায়। তাই বলা যায়, ভয়ে হোক বা ভক্তিতে, ১০০ শতাংশ সহমত শুধু সময়ের অপেক্ষা। বিচালি আর আগাছার জঙ্গলে পরিবৃত সেই ৯৯৭ একর আজ শ্মশানের মতো জেগে। ডেউচা-পাঁচামিতে সহমত হওয়া গেলে তা হবে এই পোড়া রাজ্যের কাছে রুপালি
আলোর মতো।
মধুসূদন দাশঘোষ
হরিপাল, হুগলি
অভিশাপ
ডেউচা-পাঁচামিতে জমি অধিগ্রহণের জন্য রাজ্য সরকারের কাছে রাষ্ট্র ক্ষমতা ব্যবহারের সওয়াল করে লেখা সম্পাদকীয় (‘পায়ে ঠেলার ব্যাধি’) বিস্মিত ও উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। ‘সিঙ্গুরের কালান্তক ব্যাধি’ যাতে ডেউচা-পাঁচামিতে পুনরাবৃত না হয়, তার জন্য ‘তিক্ত ঔষধের’ অপরিহার্যতার কথাও বলা হয়েছে। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে হাড় হিম-করা সন্ত্রাস ও ‘টাটার কেশাগ্র স্পর্শ করতে দেব না’ গোছের নির্লজ্জ দমনের হুমকি সত্ত্বেও সিঙ্গুরের ‘কালান্তক ব্যাধির’ উপশম ঘটেনি। আরও ঠিক কোন মোক্ষম ও তিক্ত ঔষধ প্রয়োগ করলে সিঙ্গুরের ন্যানো কারখানার বোধন হত, তা সম্পাদকীয় নিবন্ধে অনুচ্চারিত থেকে গেল। তবে কি উন্নয়নের রথের চাকাকে ডেউচা-পাঁচামিতে সচল রাখতে আরও তীব্র কোনও রাষ্ট্রীয় হিংসার সপক্ষে পরামর্শ দিচ্ছে এই নিবন্ধ?
ভুললে চলবে না, গুজরাতের সানন্দে ন্যানো প্রকল্পকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তা মুখ থুবড়ে পড়ে। খোদ টাটাই বলেছিলেন ওই প্রকল্পটি ছিল তাঁদের এক ‘ক্রিটিক্যাল মিসটেক’। কিন্তু আজও তার জন্য কী বিরাট মাসুল গুনে যেতে হচ্ছে সিঙ্গুরকে! শিল্পের সাধনায় তছনছ করে ফেলা হল বহুফসলি উর্বর কৃষি জমিকে। নাভিশ্বাস-ওঠা রাজ্যের কোষাগারকে প্রায় নিংড়ে কর্পোরেট স্বার্থবাহী এই শিল্প প্রকল্প যে রাজ্যের পক্ষে ভাল হবে না, তা অশোক মিত্র-সহ অনেক অর্থশাস্ত্রীই বলেছিলেন। যে নব্য উদারবাদী অর্থনীতির পৃষ্ঠপোষকরা সমস্ত ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে সরকার ও রাষ্ট্রকে বহু যোজন দূরে থাকার পরামর্শ দেন, তাঁরাই আবার নতুন নতুন শিল্প স্থাপনে সরকারি কোষাগার থেকে উদার হস্তে আর্থিক সাহায্যের (‘ইনসেন্টিভ’-এর জামা পরিয়ে) কথা বলেন, এবং পাশাপাশি শিল্পস্থাপনে রাষ্ট্রকে দানবীয় পন্থা অবলম্বনের জন্য নানা যুক্তির অবতারণা করেন। এই সবটাই হয় উন্নয়নের বস্তাপচা স্লোগানের আড়ালে। ‘ঈশান কোণে’ উৎখাত হয়ে যাওয়া স্থানীয় অধিবাসীদের প্রতিবাদ-প্রতিরোধের আশঙ্কা দেখতে পাচ্ছে সম্পাদকীয় নিবন্ধটি। জনস্বার্থের অজুহাতে এই প্রকল্প যাতে বানচাল না হয়ে যায়, তাই বলা হয়েছে, ‘গণতান্ত্রিক দেশে তর্কবিতর্ক, আলাপ আলোচনা, প্রতিবাদ ইত্যাদি সকলই চলিতে পারে, কিন্তু কাজে বাধা নহে।’ উচ্ছেদের পূর্বে ন্যায্য ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের পূর্বশর্ত সুনিশ্চিত না করেই ‘আলাপ আলোচনা’ করার গণতান্ত্রিক প্রসাধনীর পাশাপাশি, প্রকল্প রূপায়ণের কাজকে অগ্রাধিকার দেওয়ার এই পরামর্শ অগণতান্ত্রিক ও অন্যায্য। দেখা গিয়েছে, সমস্ত প্রকল্পের ক্ষেত্রেই ক্ষতিগ্রস্ত অধিবাসীদের আস্থা-বিশ্বাস আদায় ও জনগণকে সঙ্গে নিয়ে চলার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া উপেক্ষা করে, নাম-কা-ওয়াস্তে প্যাকেজ ঘোষণা করেই সরকার প্রকল্প রূপায়ণের পথে পা বাড়িয়েছে নির্দয় মনোভাব নিয়ে, যা পরিণতিতে ডেকে এনেছে বিক্ষোভ, সামাজিক উত্তেজনা।
একই দিনে এই সংবাদপত্রেই প্রকাশিত হয়েছে খুবই জীবন্ত এক প্রতিবেদন, ‘কয়লা আছে, তাই আমলারা আসছেন।’ তুলে ধরা হয়েছে পাঁচামির বিস্তীর্ণ অঞ্চলে অধিবাসীদের চরম বঞ্চনা, অনুন্নয়নের কাহিনি। যে ঘরগুলোর দুয়ারে পৌঁছয় না সরকারি কর্মসূচি, জনজাতি অধ্যুষিত সেই গ্রামগুলির মাটির নীচে পাওয়া গেছে কয়লার বিপুল ভান্ডার। আর বহু চিন্তাশীল বুদ্ধিজীবী এই ‘সম্পদের অভিশাপ’-এর (‘রিসোর্স কার্স’) বিচিত্র পরিঘটনার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। নোবেলজয়ী অর্থশাস্ত্রী জোসেফ স্টিগলিটস তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘মেকিং ন্যাচারাল রিসোর্সেস ইনটু আ ব্লেসিং রাদার দ্যান আ কার্স’-এ দেখিয়েছেন বিশ্বের অনেক দেশ বা সমৃদ্ধিশালী অঞ্চল মানব উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে নিদারুণ পিছিয়ে রয়েছে। দারিদ্র, ভগ্নপ্রায় স্বাস্থ্য পরিষেবা, উচ্চহারে শিশু মৃত্যু, তলানিতে নেমে আসা শিক্ষার মান, জনগোষ্ঠীর সিংহভাগ মানুষ আক্রান্ত অপুষ্টিতে। ভারতের ২৩ শতাংশ লৌহ আকরিকের ভান্ডার রয়েছে ছত্তীসগঢ়ে। সেখানে মাটির নীচে রয়েছে বিপুল পরিমাণ কয়লা। কিন্তু মানব উন্নয়নে সমস্ত সূচকে রাজ্যটি পিছিয়ে। ২০০৮ সালে যোজনা কমিশনের বিশেষজ্ঞ গোষ্ঠী এক রিপোর্টে জানিয়েছে, ১৯৫১ আর ১৯৯০ সালের মাঝে ৮০ লক্ষ ৫০ হাজার তফসিলি জনজাতির মানুষ উৎখাত হয়েছেন নানা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য। তাঁদের মধ্যে পুনর্বাসিত হতে পেরেছেন মাত্র ২৫ শতাংশ! ওই রিপোর্ট লিখেছে, “ভারতের বিকাশের গতিপথ স্থায়ী ভাবে বসবাসকারী মানুষের জীবনযাত্রায় তৈরি করেছে চূড়ান্ত অস্থিরতা। কয়েক দশক ধরে ভারতীয় রাষ্ট্র এই সমস্ত উচ্ছেদ-হওয়া মানুষদের রুটি রুজির বিকল্প কোনও পথ দেখাতে পারেনি।”
উন্নয়নকে বিরোধিতা করার অর্থ ঘড়ির কাঁটাকে জবরদস্তি পিছন দিকে ঘোরানো। কিন্তু উন্নয়ন হবে কোন পথে? অধিকাংশ মানুষকে তার বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে, না কি তাঁদেরকে সহযাত্রী করে? মানবিক মূল্যবোধ ও সহমর্মিতাকে পাথেয় করে?
অতনু চক্রবর্তী
সভাপতি, অল ইন্ডিয়া সেন্ট্রাল কাউন্সিল অব ট্রেড ইউনিয়নস