নোটবন্দির পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়া নিয়ে ‘পাঁচ বৎসর পর’ (৯-১১) শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রসঙ্গে সহমত পোষণ করে কিছু বলতে চাই। ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর। দূরদর্শনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নোটবন্দি ঘোষণা করেছিলেন। মাঝরাত থেকে দেশে পুরনো ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল। সবাই নোট নিয়ে ছুটেছিলেন ভাঙিয়ে নিতে। সে এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। একটা তুঘলকি সিদ্ধান্তে গোটা দেশের মানুষকে মোদীজি রাস্তায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল সারা ভারতে।
নোট বাতিলের উদ্দেশ্য বলা হয়েছিল কালো টাকা নির্মূল, জাল নোটের কারবার বন্ধ করা এবং দেশে ‘ক্যাশলেস’ পদ্ধতি চালু করা। আদৌ কি তেমনটা হয়েছে? রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্য অনুযায়ী, ১৫.৪১ লক্ষ কোটি টাকা বাতিল নোটের ৯৯% বা ১৫.৩১% লক্ষ কোটি টাকা ফিরে আসে। অর্থাৎ, কালো টাকা উদ্ধারে এটা কোনও কাজ দেয়নি। যে বছর নোট বাতিল ঘোষণা করা হয়েছিল, সেই সালে সারা দেশে ৬.৩২ লক্ষ জাল নোট উদ্ধার হয়। সেই থেকে গত বছর অবধি ১৮.৮৭ লক্ষ জাল নোট উদ্ধার হয়েছে। অর্থাৎ, এই উদ্দেশ্যটিও ব্যর্থ।
ডিজিটাল লেনদেন বাড়লেও, ২০১৬ সালে নোট বাতিলের আগে দেশের ব্যাঙ্কব্যবস্থায় মোট নোটের জোগান (কারেন্সি ইন সার্কুলেশন) ছিল ১৭.৭৭ লক্ষ কোটি টাকা। এ বছর মার্চ মাসে তা বেড়ে হয়েছে ২৪.২ লক্ষ কোটি টাকা। অর্থাৎ, দেশের মানুষের এখনও নগদেই বেশি ভরসা। নোট বাতিল না করেও তো ডিজিটাল লেনদেন বাড়ানো যেত। মোদী সরকার যতই নোটবন্দির সাফল্যের ঢাক পেটাক, অধিকাংশ অর্থনীতিবিদ নোটবন্দিকে ব্যর্থ বলে মনে করছেন, ও দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সঙ্কোচনকে ওই অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের ফল বলে মনে করছেন।
অভিজিৎ ঘোষ
শ্যামনগর, উত্তর ২৪ পরগনা
সম্পূর্ণ ব্যর্থ
মাত্র চার ঘণ্টার নোটিসে (ব্যাঙ্ক বন্ধ থাকায় সেটাও কার্যকর নয়) দেশের অর্থনীতির ইতিহাসে সব চাইতে বড় সর্বনাশ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ঘটনার আকস্মিকতায় বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল গোটা দেশ। তাঁর পেটোয়া গণমাধ্যমগুলি ২০০০ টাকার নতুন নোটে মাইক্রো চিপের গল্প প্রচার করে মোদীর কাজটা সহজ করে দিয়েছিল। মোদী নোটবন্দিকে ‘বেইমান’দের বিরুদ্ধে দেশের ‘ইমানদার’ মানুষের লড়াই বলে চিহ্নিত করেছিলেন। কালোবাজারি, দুর্নীতি, ঘুষের প্রতি মানুষের ঘৃণাকে জেহাদের মতো ব্যবহার করেছিলেন। টাকা পাওয়ার লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে অনেকেই মারা গিয়েছেন, কিন্তু হাসিমুখে আমজনতা সব সয়েছেন শুধুমাত্র এই বিশ্বাস নিয়ে যে, ধনীদের কালো টাকা সব ‘কাগজের টুকরো’ হয়ে যাবে। বালিশের নীচে, বিছানার নীচে, মাটির তলায় পুঁতে রাখা কালো ধন এ বারে গেল! ২০০০ টাকার নোটে মাইক্রো চিপ লাগানো আছে। মাটির ২০০ ফুট নীচে সেটা পুঁতে রাখলেও মোদী ঠিক গন্ধ শুঁকে বার করে দেবেন!
মূলত তিনটে ঘোষিত লক্ষ্য ছিল নোট বাতিলের— কালো টাকা উদ্ধার, জাল টাকা ধরা আর সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করা। পরে যখন গোটা বিষয়টা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে লেজেগোবরে, তখন বার বার গোল পোস্ট পাল্টেছেন নরেন্দ্র মোদী। তখন বলা হল, নোট বাতিলের আসল উদ্দেশ্য নগদ অর্থের ব্যবহার কমিয়ে ফেলা, দেশবাসীকে ডিজিটাল লেনদেনে উৎসাহিত করা, এবং আরও বেশি মানুষকে করের আওতায় নিয়ে আসা।
নোট বাতিলের পাঁচ বছর পার করার পর কোন লক্ষ্যগুলি পূরণ হল? কালো টাকা শেষ পর্যন্ত উদ্ধার হল কি?
এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) বেশ কয়েক বছর আগেই জানিয়েছিল আমাদের দেশের মোট ‘কালো ধন’-এর ৯৩ শতাংশই বেনামী জমি-বাড়ি, সোনা, মূল্যবান ধাতু, আর বিদেশি অ্যাকাউন্টে থাকে। মাত্র ৭ শতাংশ রয়েছে নগদ অর্থে। তাই প্রথম থেকেই নোট বাতিল লক্ষ্যভ্রষ্ট! নরেন্দ্র মোদীও তেমনটা জানতেন। ৮ নভেম্বর ২০১৬ তারিখে বাজারে ছড়িয়ে থাকা ৫০০ আর ১০০০ টাকার নোটের মোট মূল্য ছিল ১৫.৪৪ লক্ষ কোটি টাকা। মাত্র ৮ মাস পর ৩০ জুন ২০১৭ তারিখে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া জানায়, সেই নোটের ৯৮.৯৬ শতাংশ, অর্থাৎ ১৫.২৮ কোটি টাকা ব্যাঙ্কের সিস্টেমে ফিরে এসেছে। বাকি কিছু টাকা এখনও নেপালের সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক আর কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্কগুলিতে পড়ে আছে। অর্থাৎ, প্রায় পুরো টাকাটাই সাদা হয়ে ফিরে এল।
জাল নোট ধরা পড়ল কি? ২০১৬-১৭ অর্থবর্ষে, অর্থাৎ নোট বাতিলের আগে মোট ৬ লক্ষ ৩২ হাজার জাল নোট বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। নোট বাতিলের পরের চার বছরে মোট ১৮ লক্ষ ৮৭ হাজার জাল নোট উদ্ধার হয়েছে। জাল নোট দেশের অর্থনীতির জন্য এত বড় সমস্যা ছিল না, যার জন্যে এত বড় ক্ষতি স্বীকার করা যায়।
সন্ত্রাসবাদ নির্মূল হল কি? উরি, নাগরোটা, পাঠানকোট, গুরুদাসপুর, আর সবশেষে পুলওয়ামা, একের পর এক সন্ত্রাসবাদী হামলায় কেঁপেছে ভারত। এর সবই নোট বাতিলের পরের ঘটনা। ২০১৫ সালে ১০৮৯, ২০১৬ সালে ১০৪৮, ২০১৭ সালে ৯০৮, আর ২০১৮ সালে ৮৩৩টি মাওবাদী হামলার ঘটনা ঘটেছে ভারতে।
ডিজিটাল লেনদেনে দেশবাসীকে উৎসাহিত করার দাবিই বা কতটুকু গ্রহণযোগ্য? ৮ নভেম্বর ২০১৬ তারিখে জনগণের হাতে থাকা নগদ অর্থের (কারেন্সি ইন সার্কুলেশন) পরিমাণ ছিল ১৭.৭৪ লক্ষ কোটি। আজ নোট বাতিলের পাঁচ বছর পূর্তিতে বাজারে নগদের জোগান ৬৫% বৃদ্ধি পেয়ে ২৯ লক্ষ কোটি টাকা ছুঁয়েছে। ডিজিটাল লেনদেনেরও একই অবস্থা। নোট বাতিলের এক বছর পর ডিজিটাল লেনদেন মাত্র ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়, যেটা স্বাভাবিক; এর জন্যে নোট বাতিলের কোনও প্রয়োজন ছিল না।
২০১৭-১৮ সালে আয়কর ফাইল করার সংখ্যা বাড়ে, এটা ঠিক কথা। কিন্তু তার মধ্যে একটা বড় অংশকে কোনও ইনকাম ট্যাক্স দিতে হয়নি। এ ক্ষেত্রেও সরকারের ঘোষিত লক্ষ্য পূরণ হয়নি।
কথা ছিল, নোট বাতিলের জালে রাঘব বোয়ালরা ধরা পড়বে। বাস্তবে ফল হয়েছিল উল্টো। দেশের অর্থনীতির চাকা স্তব্ধ হল, অসংগঠিত ক্ষেত্র মূলধনের অভাবে ডুবে গেল। পাঁচ কোটি মানুষ সরাসরি কাজ হারালেন। ২০১৭-১৮ অর্থবর্ষেই ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বেকারত্বের হার লজ্জার রেকর্ড গড়ে। ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের নাভিশ্বাস ওঠে। দেশের জিডিপি বৃদ্ধির হার ২ শতাংশ বিন্দু নামে। ভারত সর্বাধিক বৃদ্ধির হারের দেশের তকমা হারায়। সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয় গরিব ও নিম্নবিত্ত মানুষ। এক সমীক্ষায় প্রকাশ পায়, দেশের মানুষের দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্যের চাহিদা ১০ শতাংশ কমে যায়।
এ সবই হয়েছে গরিবের ঘর লুটের বিনিময়ে। তখনও আশা ছিল, প্রধানমন্ত্রী এ বার হয়তো রাঘব বোয়ালদের শিকার করবেন। নোট বাতিলের পর রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক হিসাব দেয়, ১৭.৯২ লাখ অ্যাকাউন্টে ২.৫ লাখের বেশি নগদ টাকা জমা পড়েছে। অর্থমূল্যে ৪.২ লক্ষ কোটি টাকা। কিন্তু এখনও পর্যন্ত এক জনও সাজা পাননি। পাওয়ার কথাও নয়। নরেন্দ্র মোদীর লক্ষ্য ছিল উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনে জয়, সেই লক্ষ্যে তিনি সফল। আমজনতার হাতে রইল পেনসিল আর মোদীর ভাষণ!
স্বর্ণেন্দু সিংহ
নবদ্বীপ, নদিয়া
শূন্যের কম
‘পাঁচ বৎসর পর’ সম্পাদকীয়ের শেষ লাইন, “বহু মানুষকে কর্মহীন করিল যে ডিমনিটাইজ়েশন, পাঁচ বৎসরে তাহার সাফল্যের ঘরে মহাশূন্য।” মূল্যায়নে একটু কমতি আছে। মহাশূন্য নয়, ওটা ঋণাত্মক হবে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তথা অর্থনীতিবিদ মনমোহন সিংহ বলেছিলেন, নোটবন্দির ফলে জিডিপি ২ শতাংশ বিন্দু হারে কমবে। মিলে গিয়েছে। বেকার মানুষে দেশ ছেয়ে গিয়েছে।
সঞ্জয় চৌধুরী
খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর