Aadhaar Cards

সম্পাদক সমীপেষু: বিপদের আধার

আধার-এর তথ্য হাতিয়ার করে সাইবার আর্থিক জালিয়াতির ক্ষেত্রে এ কথা আজ দিনের আলোর মতো স্পষ্ট।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০২৩ ০৪:১৭

—ফাইল চিত্র।

‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ (২৫-৯) শিরোনামে সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, “অভিজ্ঞতাকে যদি সাক্ষী মানা হয়, তা হলে বলতেই হবে যে, জালিয়াতরা সচরাচর কর্তৃপক্ষের চেয়ে এক বা একাধিক কদম এগিয়ে থাকে।” আধার-এর তথ্য হাতিয়ার করে সাইবার আর্থিক জালিয়াতির ক্ষেত্রে এ কথা আজ দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। এর উপলব্ধি ‘আধার ব্যবস্থার জনক’ নন্দন নিলেকানি মহাশয়ের ছিল না, ভাবাই যায় না। তবু কেন জন্ম-মৃত্যু, স্কুল-কলেজে ভর্তি, স্কলারশিপ, মিউচুয়াল ফান্ডে লেনদেন, যাবতীয় পেমেন্ট সিস্টেম, ডিজিলকার, রেশন কার্ড-সহ নানাবিধ গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে আধার সংযুক্তি বাধ্যতামূলক হয়ে উঠল? অথচ, আধার ঐচ্ছিক! বিভিন্ন সরকারি আর্থিক ভর্তুকি, সুবিধা ও পরিষেবা দেওয়ার জন্য একটা পরিচয়জ্ঞাপক সংখ্যাই আধার। আর আজ আধার হয়ে উঠেছে সর্বব্যাপী! ভারতে তথ্য চুরি আজ এক ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছেছে। যদিও যতটা ধরা পড়েছে, তারই পরিসংখ্যান আমাদের হাতে রয়েছে। তথ্য চুরির বহু ঘটনা এখনও ধরা পড়েনি বলে আমার অনুমান। শুধুমাত্র আধারভিত্তিক পেমেন্ট সিস্টেম এইপিএস-এর মাধ্যমে আঙুলের ছাপ নকল করেই জালিয়াতি ঘটছে না। সম্প্রতি এমপ্লয়িজ় প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে জালিয়াতদের দল আধার কার্ড ব্যবহার করে ১১টা পিএফ অ্যাকাউন্ট থেকে ১.৮৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

Advertisement

আরও আতঙ্কের খবর, ২০১৫ সালে জাতীয় জনসংখ্যা পঞ্জি আপডেটের সময় আধার তথ্য যুক্ত করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ২০২১-২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে এই বিষয়টি রয়েছে। এনপিআর-এর উদ্দেশ্য জাতীয় নাগরিক পঞ্জি বা এনআরসি তৈরি করা। ২০১৯-২০ সালে এর বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে আন্দোলন হয়েছে। এনপিআর-এর সঙ্গে আধার যুক্ত করা মোটেই আইনসম্মত নয়। আধার নিয়ে গবেষণামূলক গ্রন্থ ডিসেন্ট অন আধার-এর সম্পাদক রীতিকা খেরা ২০১৯ সালে লিখেছিলেন যে, কোনও কেন্দ্রীকৃত তথ্যভান্ডারই সুরক্ষার দিক থেকে সম্পূর্ণ ভাবে নির্ভরযোগ্য হতে পারে না। আর ‘আধার’-এর মতো প্রকল্পে তো অনন্য পরিচয়জ্ঞাপক সংখ্যা (ইউআইডি)-র মাধ্যমে যেন শতাধিক তালা খোলার ক্ষমতাসম্পন্ন একটা চাবিকাঠি কারও হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।”

আজ কি পদে পদে সেই কথাই প্রমাণ হচ্ছে না?

জিতেন নন্দী, কলকাতা-১৮

প্রতারণার ছক

হোয়াটসঅ্যাপ-এ কিছু সাইবার অপরাধীর দল ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে। প্রবীণ মানুষরাই এদের লক্ষ্য। ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগের প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ মানুষের থেকে অসৎ উপায়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করছে এই প্রতারকরা। কিছু হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ বানিয়ে, নিজেদের বানানো লিঙ্ক শেয়ার করে সেই লিঙ্কের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করিয়ে, টাকা বিনিয়োগের প্রথম পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আবার বিশ্বস্ততা অর্জনের জন্য বিশেষ কোড পাঠানো হচ্ছে এবং প্রতারণার লক্ষ্য ব্যক্তিকে বলা হচ্ছে অন্যদের ওই কোডের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করালে তিনি টাকা উপার্জন করবেন। এটিকে সাইবার ক্রাইমে ‘ফিশিং’ বলা হয়, অর্থাৎ ভিক্টিম-এর বিশ্বাস অর্জন। এর পর এক বার টাকা বিনিয়োগ করলেই সেই টাকার অঙ্ক বৃদ্ধি পাচ্ছে এই সাইটে, এর পরের পর্যায়ে শিকারের কাছে চাওয়া হচ্ছে কেওয়াইসি সম্পর্কিত বিবরণ। সেটি দিলেই সাফ হচ্ছে পুরো ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট। আবার অনেকে কেওয়াইসি বিষয়ে তথ্য চাওয়ার বিষয়টি দেখে সন্দিহান হয়ে পূর্ব বিনিয়োগের টাকা তুলতে গেলেই আর পাওয়া যাচ্ছে না সেই টাকা, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ থেকে তাঁদের ব্লক বা বহিষ্কারও করা হচ্ছে।

এদের কাজকর্মের ধারাটি দেখে বোঝাই যাচ্ছে, এরা যথেষ্ট দক্ষ একটি অপরাধমূলক দল। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মোবাইল নম্বর ব্যবহার করেই এরা অসৎ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে চলেছে। হেনস্থা এবং দৌড়াদৌড়ির ভয়ে সাধারণ মানুষ পুলিশের শরণাপন্ন হতেও ইতস্তত বোধ করছেন। তাই মানুষকে আরও অনেক সতর্ক হতে হবে। দিনের পর দিন সাইবার ক্রাইমের এই বিস্তৃতি রুখতে হেল্পলাইন নম্বরগুলির কার্যকারিতা আরও বাড়ানো দরকার। সাইবার ক্রাইম রিপোর্টিং সাইটের নিয়মিত দেখভালের উপর বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন।

কৃষ্ণকলি মাইতি, পূর্ব মেদিনীপুর

অভয়ের পথ

ইতিহাসবিদ বেঞ্জামিন জ়াকারিয়ার ‘গান্ধী: মহাত্মারও আগে’ (২-১০) শীর্ষক প্রবন্ধটির জন্য ধন্যবাদ। ইতিহাসবিদ অশীন দাশগুপ্তকে অনুসরণ করে বলা যায়, চার রকমের সত্য গান্ধীজির জীবনদর্শন থেকে উপলব্ধি করা যায়। প্রথম হল বক্তব্যের সত্য। গান্ধী ছেলেবেলা থেকেই এই বিশেষ সত্যনিষ্ঠা অভ্যাস করেছিলেন। কেন করেছিলেন, তা বলা কঠিন। দ্বিতীয় হল আচরণের সত্য। সত্যরক্ষা বলতে আমরা এই আচরণের সত্যরক্ষার কথাই বলে থাকি। নীতিজ্ঞান বস্তুটি এই আচরণের সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। এই জ্ঞান গান্ধীর পুরোমাত্রায় ছিল। আধ্যাত্মিক জীবন গড়ে তোলা বা ঈশ্বর সম্পর্কে ভক্তি ও বিশ্বাস গড়ে ওঠার আগে থেকেই গান্ধী সত্যরক্ষা করতেন। যেমন— মায়ের কাছে কথা দিয়েছিলেন বলেই বিলাতে আমিষ খাবার বর্জন করেছিলেন। এই অভ্যাস থেকে পরবর্তী জীবনেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা গিয়েছিল। তৃতীয় হল সমতার সত্য। বাইরের জীবন ও পরিবেশ এবং অন্তর্জীবন ও চিন্তার ক্ষেত্রে সমতা আনতে পারলে মানুষ এক রকম ‘সত্য’-এ প্রতিষ্ঠিত হয়, যার ফলে জীবন সহজ ও আনন্দময় হয়ে ওঠে। গান্ধীর মধ্যে সেবাধর্মের প্রতি একটা স্বাভাবিক প্রবণতা ছিল। এক দিকে কায়িক পরিশ্রম ও অন্য দিকে সাত্ত্বিক জীবনযাপন তিনি অন্তর থেকেই উপলব্ধি করেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় যখন তিনি ফিনিক্স আশ্রম করলেন, সেই সময় থেকেই তিনি এই ভিতর-বাহিরের সমতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন ছিলেন।

চতুর্থ সত্যটি উপলব্ধির। গান্ধী একে ‘আত্মার আইন’ বলতেন। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সব কিছুর মধ্যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব উপলব্ধি করা— এই দর্শনের সত্যতা সম্পর্কে গান্ধী সজাগ ছিলেন। এই সত্যই গান্ধীর ঈশ্বর। তাঁর বক্তব্যের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ‘সমতার সত্য’। দক্ষিণ আফ্রিকার আশ্রমে এবং হিন্দ স্বরাজ রচনার মধ্যে গান্ধীর এই ভাবনা প্রকাশিত হয়। মূল কথা হল, আধুনিক সভ্যতা বস্তুবাদী এবং ভোগের উপর প্রতিষ্ঠিত। মানুষ ভোগের পথে তীব্র প্রতিযোগিতায় মত্ত। এই ভোগবাসনার কোনও নিবৃত্তি নেই। এই পথে মানুষের আত্মসমীক্ষারও কোনও উপায় নেই। প্রতিযোগিতা যেমন প্রতি দিন বাড়বে, হিংসাদ্বেষও বাড়বে। গান্ধী মনে করেন, এই অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় নিজের প্রদীপ নিজে জ্বালানো। এই বিকল্প জীবনের বিকল্প উপায় সত্যাগ্ৰহ। ভয় থেকে মুক্তি সত্যাগ্ৰহের প্রধান লক্ষ্য। মানবিক পরিবেশকে বিকৃত করে রাখে ভয়। হিংসা আসে ভয় থেকে। সত্যাগ্ৰহী মৃত্যুভয়কেও জয় করবে। তাঁর অহিংসা তাই মানুষের শ্রেষ্ঠ সাহস।

গান্ধী মনে করতেন পুণ্যভূমি ভারতবর্ষ সত্যাগ্ৰহের প্রকৃষ্ট প্রয়োগক্ষেত্র। ভারতকে ভালবাসা নিশ্চয়ই গান্ধীর একটা আবেগ, কিন্তু শুধু এই জন্যই তিনি স্বাধীনতার সংগ্ৰামে রাজনীতির ময়দানে নামেননি। আসলে তিনি দেশের মানুষকে এই অভয়ের পথে টানতে চেয়েছিলেন। ভোগ ও ভয় থেকে মানুষকে মুক্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যেই তাঁর সত্যাগ্ৰহের বিকল্প পথের সাধনা। ১৮৯৩ সালে ডারবান থেকে প্রিটোরিয়া যাওয়ার পথে গান্ধীর অহিংসা জন্ম নেয়। ট্রেন থেকে সাহেব গান্ধীকে নামিয়ে দিলেন। গান্ধী প্রতিবাদে যেখানে বসেছিলেন, সেখানেই বসে থাকলেন। সাহেব মেরেও কিছু করতে পারলেন না। গান্ধী আত্মরক্ষার জন্য হাত ওঠালেন না।

অত্যাচারীকে ভালবাসার অহিংসা এখান থেকেই এল।

সন্দীপ সিংহ, হরিপাল, হুগলি

আরও পড়ুন
Advertisement