ঈশা দাশগুপ্ত তাঁর “প্ৰতিবাদের ‘আমরা-ওরা’” (১৬-৯) শীর্ষক প্রবন্ধে যথার্থই বলেছেন যে, আমরা, অর্থাৎ সুপ্রতিষ্ঠিত মানুষজন থেকে শুরু করে সুন্দরবনের নৌকার উপর দাঁড়িয়ে থাকা মহিলারা পর্যন্ত, সমগোত্রীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে সমান ভাবে গর্জে উঠি না। তিনি দেখিয়েছেন, আর জি কর কাণ্ডের সমসময়ে বিভিন্ন রাজ্যে ঘটে যাওয়া দলিত মেয়েদের উপর ধর্ষণ বা তাঁদের হত্যার বিরুদ্ধে আমরা কোনও প্রতিবাদই সংগঠিত করতে পারিনি। প্রথমোক্ত ঘটনায় চিকিৎসক মেয়েটির মতো তথাকথিত ‘ভাল মেয়ে’-র বিরুদ্ধে সংঘটিত অন্যায়ের বিরুদ্ধেই কেবল সরব হয়েছি। এই বক্তব্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ সহমত হয়েই আমি আরও দু’-একটা কথা উত্থাপন করতে চাই।
শুধু যে শ্রেণিগত তারতম্যের ফলেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদের চেহারাটা বদলে যাচ্ছে, তা কিন্তু নয়। লিঙ্গভেদেও এর তারতম্য পরিলক্ষিত হয়। ‘মেয়ে’র জায়গায় যদি কোনও ‘ছেলে’ নৃশংসতার শিকার হন, সে ক্ষেত্রেও সমাজকে সমান ভাবে সরব হতে দেখা যায় না। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, বছরখানেক আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের এক ছাত্র যে ভাবে র্যাগিং-এর শিকার হয়ে নিহত হয়েছিল, তাতে জনরোষ তৈরি হলেও, তার মাত্রা কিন্তু আজকের মতো ছিল না। র্যাগিংও ধর্ষণের মতো একটা সামাজিক ব্যাধি। তবে, আজকের আন্দোলন অন্তত একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সমর্থ হয়েছে। তা এই যে, কোনও রাজনৈতিক দলের সাহায্য ছাড়াই সাধারণ মানুষও পারে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে তাদের সংগ্রাম এত দীর্ঘ দিন ধরে জিইয়ে রাখতে।
প্রতিবাদের ধরন-ধারণ নিয়ে সমাজমাধ্যমে ভেসে ওঠা বেশ কিছু বিরক্তিকর পোস্টও এ বিষয়ে আলোচনার দাবি রাখে। যেমন, কেউ কেউ এমনও ভাবেন যে প্রতিবাদ যদি সরব না হয়, তবে তার কোনও মূল্যই নেই। তাঁদের কাছে এঁকে, লিখে কিংবা মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রতিবাদ অর্থহীন। আবার কেউ কেউ নিজেদের সামাজিক সচেতনতা তুলে ধরতে তাঁদের ঘরের পাঁচ-ছয় বছরের, এমনকি, তার চেয়েও ছোট শিশুদের, বিশেষ করে কন্যাসন্তানদের মিছিলে নিয়ে এসে তাঁর ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে শেয়ার করেছেন। অনেক সময় স্লোগানের ‘র্যাপ’ গাইছেন, নাচছেন। এই সবই খুব দৃষ্টিকটু। মাথায় রাখতে হবে, আমাদের প্রতিবাদ কোনও চমক সৃষ্টির জন্য নয়। অন্যায়ের প্রতি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে। এর রকমফের থাকতে পারে, তবে তার কোনওটিতেই যেন ফাঁক না থাকে। তার গুরুত্ব যেন হারিয়ে না যায়।
গৌতম নারায়ণ দেব, কলকাতা-৭৪
ওরাই আমরা
“প্রতিবাদের ‘আমরা-ওরা’” প্রবন্ধ পড়ে বিস্মিত হয়েছি। প্রবন্ধকার কী কারণে অসময়োচিত, বিভ্রান্তিকর এই প্রবন্ধটি লিখলেন? যত তথ্যই পরিবেশিত হোক, তাতে বোঝানো যাবে না মানুষের মনের গহন কোণটিকে। নারীবাদী আন্দোলন কেন দানা বাঁধছে না তার কারণ খুঁজতে প্রবন্ধকার ‘ভাল মেয়ে’-‘খারাপ মেয়ে’র প্রসঙ্গ এনেছেন। নারীবাদী আন্দোলন যে শতধাবিভক্ত, সেই বিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যা করে গিয়েছেন অনুরাধা গান্ধী। তিনি মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী বিপ্লবী এবং (অরুন্ধতী রায়ের মতে) এক জন খাঁটি নারীবাদী। ‘আমরা’ শব্দটির মধ্যে ‘ওরা’ নেই, এটা প্রবন্ধকার কেন ভাবলেন, স্পষ্ট হল না। কেন তিনি বাড়ির পরিচারিকাকে প্রশ্ন করতে পারবেন না তিনি আন্দোলনে শামিল হচ্ছেন কি না? আমার স্ত্রীকে ১৫ অগস্ট সকালে আমাদের বাড়ির পরিচারিকা জানান যে, ১৪ অগস্ট সন্ধ্যার মিছিল দেখে তিনি সেই মিছিলে পা মিলিয়েছেন এবং নির্যাতিতার স্মরণে প্রতিবাদী মোমবাতি জ্বালিয়েছেন। আমার স্ত্রী ওঁকে বাহবা জানিয়েছেন। ১৩ সেপ্টেম্বর আমি অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ক কর্মচারীদের আন্দোলনে শামিল ছিলাম। রাস্তার পাশে দাঁড়ানো দুই ঠেলাওয়ালা আমাদের মাঝে মিশে গেলেন এবং আমরা ওঁদের সঙ্গে নিয়ে ছবিও তুললাম। মানববন্ধনের কর্মসূচির সময়ে আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করে অটোচালকরা স্বেচ্ছায় গাড়ি সরিয়ে নিলেন।
দিল্লির ‘নির্ভয়া’ কাণ্ড নিয়ে যেমন স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন হয়েছিল, তেমনই হয়েছিল কামদুনি এবং হাথরস কাণ্ডে। শেষের দুই আন্দোলন কি ‘ওদের’ জন্য হয়নি? গত এক দশকের মধ্যে ঘটা এই তিনটি আন্দোলনের মাধ্যমে আমজনতার চেতনা নারী-নির্যাতনের বিরুদ্ধে অনুপ্রাণিত হয়েছে এবং তার পরিণতি আর জি কর আন্দোলন। সবাই স্বীকার করছেন স্বাধীনতার পর এমন স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন আর হয়নি। রাজনীতি ব্যতিরেকে অন্য সব সংগঠন গড়ে ওঠে পেশা বা জীবিকার ভিত্তিতে পৃথক ভাবে, এবং তাই সেই পেশার মানুষেরা আন্দোলনে শামিল হন পৃথক ভাবে। এর মধ্যে ‘আমরা-ওরা’র গন্ধ কোথায়? আর ‘রাতদখল’ করেছিল কি শুধু তথাকথিত ‘আমরা’-রা?
‘আমরা’-র মধ্যে সবাই আছে এবং থাকবে। অন্তত আর জি কর আন্দোলনকে সামনে রেখে প্রতিবাদের ‘আমরা-ওরা’ খুঁজতে না যাওয়াই ভাল।
পঙ্কজ কুমার চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা-১১৬
ভদ্র-বৃত্ত
ঈশা দাশগুপ্তের প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর পল্লীসমাজ উপন্যাসে ‘রমেশ’ চরিত্রের মধ্যে দরিদ্র, প্রান্তিক মানুষের জন্য যে সংবেদনশীলতা দেখিয়েছিলেন, তাকে অনুভব করতে অপারগ আমরা, অর্থাৎ আজকের ভদ্রলোক শ্রেণি। আমরা যার যার মতো করে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেষ্টা করে যাচ্ছি। সেই প্রতিবাদ সকলের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠতে পারছে না। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত নাগরিক সমাজ নিজেদের মধ্যে গড়ে তুলেছেন একটি সুরক্ষা বলয়, যার চৌহদ্দির মধ্যে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। ভদ্রলোক গোষ্ঠীই সমাজের স্বঘোষিত চালিকাশক্তি হিসেবে পরিচিতি লাভে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এর বাইরে সমাজের বৃহৎ পরিসরে যে অজস্র মানুষের বসবাস, তাঁদের দৈনিক চাহিদার, প্রতি দিনের লড়াইয়ের যে পরিসর, সে সম্পর্কে কণামাত্র খবরাখবর না রেখেই, তাঁদের সম্পর্কে নানাবিধ আপত্তিকর মন্তব্য করে দিচ্ছেন। এই আত্মম্ভরিতা, যা ক্রমে একটা অভ্যাসে দাঁড়ায়, তা তথাকথিত ভদ্রলোকদের থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে বৃহত্তর জনগণকে।
সমাজের অবক্ষয় শুরু হলে তা যে একটি নির্দিষ্ট বৃত্তে আবর্তিত হয় না, বরং সমাজের প্রতিটি স্তরে সংক্রমিত হয়, এই সহজ সত্যটা বুঝতে চাননি ভদ্রলোক গোষ্ঠী। বিপদ যখন নিজের দেওয়াল ভেঙে ভিতরে ঢুকে পড়ার উপক্রম করছে, সেই সঙ্কটময় মুহূর্তে তাঁরা চাইছেন সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে। সব সুর এক সুরে মেলাতে। আর জি কর ঘটনার আবহে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে কলকাতার যে নাগরিক সমাজ, তা ওই ভদ্রলোকদের প্রতিনিধি। যদিও অটো রিকশা চালক, হকার-বিক্রেতারাও এর মধ্যে রয়েছেন, তবুও এ কথা ঠিক যে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এই অংশটি এখনও দ্বিধাগ্রস্ত। এর অর্থ কিন্তু এটা নয় যে, তাঁরা এই নারকীয় ঘটনা সমর্থন করেন। বরং তাঁরা এমন ঘটনাকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করেন।
এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, তা হলে তাঁরা স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করছেন না কেন? উত্তরটা খুব সহজ। কলকাতা নগরীর ফুটপাত জুড়ে কিছু দিন আগেই হকার উচ্ছেদে যাঁরা রুটি-রুজি হারিয়েছেন, অজস্র গরিবের পেটে সস্তায় খাবার পৌঁছে দেওয়ার স্টলগুলো যখন একের পর এক উচ্ছেদ হয়েছে, তখন ফুটপাত প্রশস্ত হচ্ছে বলে তথাকথিত ভদ্রলোকেরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন। তাঁদের জন্য সুসজ্জিত রেস্তরাঁ, বিলাসবহুল ফুডমার্ট থাকায় পরোক্ষ ভাবে এই উচ্ছেদের প্রতি তাঁরা সমর্থন জানিয়েছেন।
আজ তা হলে কোন শর্তে প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ এই আন্দোলনের অংশীদার হবেন?
রাজা বাগচী, গুপ্তিপাড়া, হুগলি