সম্পাদকীয় ‘বর্ণপরিচয়’ (৮-১২)-এর পরিপ্রেক্ষিতে জানাই, বাংলা ভাষার সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় কলকাতা পুরসভা দোকানপাটের নাম-ফলক বা বিজ্ঞাপনী প্রচারলিপিতে বাংলা ব্যবহার আবশ্যিক করার যে উদ্যোগ করেছে, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। অতীতে এ ব্যাপারে সাফল্যের হার কম বলে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকাও কোনও কাজের কথা নয়। অন্য দিকে, এ কথাও ঠিক যে, কেরিয়ার-সর্বস্ব পড়াশোনায় আজ ছাত্র-ছাত্রী অভিভাবকবৃন্দ বাংলা ভাষা বিষয়ে অনেকটাই উদাসীন। সেই সঙ্গে উপযুক্ত পরিভাষার অভাব-সহ নানা কারণে আজও উচ্চশিক্ষায় বাংলা পুস্তক অপ্রতুল। ভাবতে অবাক লাগে আজ শিক্ষিত বাঙালিও বাংলা ভাষাকে জ্ঞান চর্চায় প্রয়োগে অনীহা প্রকাশ করছেন। অথচ, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দাবি উঠেছিল রাজ্যের ভাষাই হোক প্রশাসনের ভাষা। এক সময় (১৯৪৭) পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষকে তাঁর মুখ্যসচিব সুকুমার সেন বাংলা ভাষায় নোট দিতেও শুরু করেন। আবার ২৫ বৈশাখ, ১৩৮৬, তৎকালীন সরকার জানিয়েছিল, “এ দিন থেকে রাজ্য সরকারের সমস্ত কাজকর্মে বাংলা ভাষা চালু হয়েছে।” ২২ বছর পর ১৪০৮-এর ১ বৈশাখ একই ঘোষণা হয়। কয়েক বছর আগে বর্তমান সরকারও একই ঘোষণা করেছে। কিন্তু কাজের কাজ তেমন কিছু হয়নি। অতি সম্প্রতি ভাষার ধ্রুপদী অবয়ব অর্থবহ করে তুলতে বর্তমান শিক্ষামন্ত্রীও বেসরকারি বিদ্যালয়স্তরে বাংলা পড়ানোর অনুরোধ করেছেন।
অনুরোধ নয়, মহারাষ্ট্র, ওড়িশার মতো বাধ্যতামূলক করা দরকার। বাংলা ভাষাকে সর্বক্ষেত্রে সহজে ব্যবহার করতে না পারলে বাংলা ভাষা তার অতীত ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারবে না। আজ অনেক শিক্ষিত বাঙালি মাতৃভাষায় কথা বলতে দ্বিধাবোধ করেন, হয়তো বাংলা বলতেও পারেন না। অনেক সময় ইংরেজি মেশানো বাংলা বলে এক ধরনের আত্মশ্লাঘা অনুভব করে থাকেন। মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার্থে যা বড়ই দুর্ভাগ্যের বিষয়।
অথচ, সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধিসম্পন্ন ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা বংশ থেকে জাত আধুনিক ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষা পৃথিবীতে প্রাধান্য লাভ করেছে আগেই। সেখানে ইংরেজি, জার্মান, ফরাসি, ইটালীয় ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষার নাম একই সঙ্গে উচ্চারিত হয়। বাংলা ভাষা সাহিত্য সৃষ্টিতে এত বেশি সমৃদ্ধ যে, বাংলার কবি-সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথের অবদান এখন কোনও ভাষাবিশেষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, সমগ্র বিশ্বসাহিত্যেরই সম্পদ হিসাবে বিবেচিত। বাংলা ভাষার এই বংশগৌরবের কথা স্মরণ করেই প্রতিষ্ঠিত এক ভাষাতত্ত্ববিদ সিদ্ধান্ত নেন, “সম্প্রতি হয়তো বাংলা ভাষা হাজার বছরে পা দিয়েছে..., কিন্তু বংশ-কৌলীন্যে তা পৃথিবীর এক মহান ভাষা পরিবারের উত্তরাধিকার অর্জন করেছে।” (ড.পরেশচন্দ্র মজুমদার, বাংলা ভাষা পরিক্রমা, ১ম খণ্ড, ১৩৮৩)। আমাদের এই বাংলা ভাষা চর্যাগীতি, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য, চৈতন্য জীবনী কাব্য, সহজধর্মের পদাবলির ধারক। আবার নানা পল্লিগাথা ও গীতির প্রকাশক, যেগুলি বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির এক ঐতিহাসিক দলিল।
কাজেই আজ অতীত ঐতিহ্যকে মনে রেখে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় প্রয়োজন সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রয়োগে কার্যকর ভূমিকা পালন করা। এবং সেই দায়িত্ব শুধুমাত্র প্রশাসনের নয়, আমাদেরও।
সুদেব মাল, তিসা, হুগলি
রাজনীতির ঊর্ধ্বে
অশোক সরকারের ‘অদলীয় রাজনীতির পথ’ (১৬-১২) শীর্ষক প্রবন্ধটি পড়ে কয়েকটি কথা না বলে পারছি না। প্রবন্ধকার ‘একতা পরিষদ’, ‘মজদুর কিসান শক্তি সংগঠন’, ‘নর্মদা বচাও’ আন্দোলনের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, “যতটুকু সাংগঠনিক ক্ষমতা থাকলে প্রশাসন ও নেতারা কথা শুনতে বাধ্য হন, তা এদের আছে।” এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমেই জানাতে চাই যে, এদের ‘অদলীয়’ রূপে আখ্যায়িত করাটাই হল সত্যের এক প্রকার অপলাপ। কারণ, এরা রীতিমতো এক-একটা সংগঠন। দ্বিতীয়ত, এদের মূল কাজটা প্ৰতিবাদ, প্রতিরোধ আর বিভিন্ন দাবি আদায়ের মধ্যেই সীমিত। অর্থাৎ, নীতি প্রণয়নে সরাসরি অংশগ্রহণ না করে অদলীয় ‘রাজনীতির সঙ্গে সরকারের কথোপকথনের সেতু’ হিসেবেই এরা মুখ্যত কাজ করে। এরা যদি দলীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করত, তা হলে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে প্রত্যক্ষ ভাবে সেই সব মানুষের অভাব-অভিযোগ নিয়ে আইনসভায় সরব হতে পারত। আইন-প্রণয়নে আরও সক্রিয় ভূমিকা নিতে পারত। সেটা হয়তো বেশি লাভজনক হত।
কিন্তু, এই ‘অদলীয় রাজনীতি’র পথচারীরা এই পথে হাঁটতে চাইবেন না, কারণ, দলীয় রাজনীতিতে একটা দায়বদ্ধতার ব্যাপার থাকে জনগণের কাছে। কাজ না করলে মানুষের কাছে পরিত্যাজ্য বা সমালোচিত হওয়ার ঝুঁকি সেখানে থেকে যায়। সে ক্ষেত্রে অনন্তকাল ধরে ‘প্রতিবাদী’ হয়ে থাকাটা একটু কঠিনই হয়ে পড়বে তাঁদের পক্ষে। উদাহরণ হিসেবে যোগেন্দ্র যাদবের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। আলোচ্য প্রবন্ধেও পেসা-অরণ্যের অধিকার আইন রূপায়ণে অগ্রণী ভূমিকা নেওয়ার সুবাদে তাঁর নামটি উল্লিখিত। কিন্তু তাঁরই তৈরি ‘স্বরাজ ইন্ডিয়া’ দল ভোটের রাজনীতিতে সম্পূর্ণতই ব্যর্থ। উল্টো দিকে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ‘মিড-ডে মিল’ বা ‘একশো দিনের কাজ’-এর মতো যুগান্তকারী প্রকল্পগুলোর সাফল্যের আলো দেখার মূলে ছিল সেই সমস্ত রাজনৈতিক দল, যারা হয় সরকারে আসীন ছিল কিংবা বাইরে থেকে সরকারকে সমর্থন জুগিয়েছিল।
আসলে, গঠনমূলক রাজনীতিরই এখন বেশি প্রয়োজন। নির্বাচনকেন্দ্রিক বা ক্ষমতাসর্বস্ব রাজনীতি পরিহার করে মূল্যবোধের রাজনীতির দৃষ্টান্তই স্থাপন করতে হবে, যার এখন বড়ই অভাব। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে, যেখানে রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি আর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব প্রকট, সেখানে সৎ ও সনিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের গুরুত্ব অপরিসীম, যারা সঠিক নীতি প্রণয়নে ও দুর্নীতি দমনে নতুন দিশার সন্ধান দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে।
গৌতম নারায়ণ দেব, কলকাতা-৭৪
আশঙ্কা রইল
‘আপাতত কোনও সমীক্ষা নয় ধর্মস্থানে’ (১৩-১২) শীর্ষক সংবাদ এবং ‘স্বস্তি, আপাতত’ শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রতিবেদন (১৮-১২) নিয়ে এই চিঠি। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খন্নার নেতৃত্বাধীন বিশেষ বেঞ্চ জানিয়েছে ১৯৯১ সালের উপাসনাস্থল আইন অনুযায়ী উপাসনাস্থলের চরিত্র বদল চেয়ে আর কোনও মামলা দায়ের করা যাবে না। তা ছাড়া, যে সব মামলা আগেই দায়ের হয়েছে, সেখানেও আদালত কোনও কার্যকর বা চূড়ান্ত রায় দিতে পারবে না। ফলে, সম্ভলের মতো প্রাণঘাতী হিংসা কিংবা ‘বাবরি মসজিদ’ ভাঙার মতো অনভিপ্রেত ঘটনা, আশা করা যায়, এর ফলে আপাতত বন্ধ হবে।
তবে, এই স্বস্তি দীর্ঘায়িত হতে পারে কেন্দ্রের ইতিবাচক ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে। কেন্দ্র কি সেই ভূমিকা পালন করবে? ভুললে চলবে না, বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে রাম জন্মভূমি পত্তনের অনভিপ্রেত ইতিহাস এই আইন প্রবর্তিত হওয়ার পরেই ঘটেছিল। এই আইন জারি থাকা সত্ত্বেও পরবর্তী পর্যায়ে এ জাতীয় বহু ঘটনা ঘটেছে। শাসক দলের ইচ্ছার বাস্তবায়ন যাতে কোনও ভাবেই বাধাপ্রাপ্ত না হয়, তাই তারা ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ এবং ‘সমাজতান্ত্রিক’— এই দু’টি শব্দ সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে উড়িয়ে দেওয়ার জন্য আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিল। শীর্ষ আদালত এই দু’টি শব্দের অস্তিত্ব মেনে নেওয়ার পক্ষে রায় দিলেও শাসক দল নীতিগত ভাবে যে এই রায় মেনে নেয়নি, তা তাদের নানা কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে পরিস্ফুট হয়েছে এবং হচ্ছে। ফলে, ১৯৯১ সলের ধর্মস্থানের চরিত্র বদল নিষিদ্ধ করার আইন প্রয়োগ করার ক্ষেত্রেও তারা যথাযোগ্য ভূমিকা পালন করবে কি না, প্রশ্ন থাকছেই।
গৌরীশঙ্কর দাস, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর