Communal harmony

সম্পাদক সমীপেষু: শেষ কথা জনগণই

হরিয়ানায় যা ঘটেছে, স্বাভাবিক ভাবে মুসলমান তো বটেই, যে কোনও শান্তিপ্রিয় নাগরিক তাতে আতঙ্কিত বোধ করবেন। একই মুদ্রার উল্টো পিঠ মণিপুর।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৫:৫৮

তাজুদ্দিন আহ্‌মেদের লেখা ‘এই সর্বব্যাপী ভয়’ (২২-৮) শীর্ষক প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে উল্লেখ্য, লেখকের মতো অনেকেই হয়তো কেন্দ্রের বর্তমান শাসকের ধর্মনিরপেক্ষতার মূলে কুঠারাঘাতের অপচেষ্টায় ‘ভারতবর্ষ’ নামক ধারণার অপমৃত্যুর আশঙ্কা করছেন। কিন্তু ইতিহাসের শিক্ষা, শাসক নয়, জনগণই শেষ কথা বলেন। সিংহভাগ ভারতবাসী স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রত‍্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে শামিল হওয়ায় ব্রিটিশ ভারত ছাড়তে বাধ‍্য হয়েছিল। হাতের কাছেই আর এক জ্বলন্ত উদাহরণ বাংলাদেশ।

Advertisement

হরিয়ানায় যা ঘটেছে, স্বাভাবিক ভাবে মুসলমান তো বটেই, যে কোনও শান্তিপ্রিয় নাগরিক তাতে আতঙ্কিত বোধ করবেন। একই মুদ্রার উল্টো পিঠ মণিপুর। দু’টি স্থানে অশান্তির প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও সাধারণ মানুষ কি তাতে স্বস্তি বোধ করবেন? ভারতবর্ষের ইতিহাস থেকে মুসলিম পর্ব মুছে ফেললে অনুসন্ধিৎসু পাঠকের কাছ থেকে খাজা মইনুদ্দিন চিশতির দরগা, জিটি রোড, তাজমহল বা লাল কেল্লার রূপকারকে কি আড়াল করা যাবে?

বাড়ি ভাড়া খুঁজতে গিয়ে, ট্রেনে, বাসে বা অন্যান‍্য ক্ষেত্রে মুসলিমদের যে সব অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার কথা লেখক উল্লেখ করেছেন, তা নতুন নয়। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সঙ্কীর্ণমনা কিছু মানুষ আছেন, সমাজের পরিবর্তন বা অগ্ৰগতি তাঁদের তেমন ভাবে স্পর্শ করেনি। জাতীয়তাবোধ তাঁদের মনে সম্ভবত অনুপস্থিত। এই হতাশাজনক চিত্রের মধ্যেও ইদ বা দুর্গাপুজোয় উভয় সম্প্রদায়ের শামিল হওয়া, কোভিডে অনাথ হওয়া মুসলিম শিশুকে হিন্দু প্রতিবেশীর প্রতিপালন বা মুসলিম তরুণদের স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে হিন্দু ব‍্যক্তির দেহ সৎকারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়ার মতো ঘটনা ‘ভারত’ নামক ধারণার বহমানতা সম্পর্কে কি আশাভরসা জাগায় না?

বিক্রম সারাভাইয়ের যোগ‍্য উত্তরসূরি মিসাইলম্যান এ পি জে আবদুল কালামের মতো ব‍্যক্তিত্বের রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হওয়ায় কোনও পক্ষ থেকে বিরোধিতার সুর শোনা যায়নি। তাঁকে ভারতরত্ন সম্মান প্রদান ‘ভারত’ নামক ধারণার ভিতটি মজবুত করেছে, তাকে লালন করায় শাসক ব‍্যর্থ হলে জনগণই উপযুক্ত ব‍্যবস্থা করবেন বলে বিশ্বাস।

ধীরেন্দ্র মোহন সাহা, কলকাতা-১০৭

ভয়কে জয়

‘এই সর্বব্যাপী ভয়’ প্রসঙ্গে কিছু কথা বলা আবশ্যক। প্রবন্ধকার তাঁর লেখাটিতে যে-ভাবে মুসলিম সম্প্রদায়ের ‘প্রাণের ভয়, সামান্য অবশিষ্ট আত্মসম্মানটুকু হারাবার ভয়’-এর কথা বিবৃত করেছেন, তা কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সঠিক বলেই মনে হওয়া স্বাভাবিক। ইদানীং ভয়ের পাশাপাশি ‘ঘৃণার সংস্কৃতি’-ও সৃষ্টি করা হচ্ছে। এ দেশের শাসকেরা পরিকল্পিত ভাবে ভুলিয়ে দিতে চাইছে মানুষের ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ইতিহাস, ভালবাসার সংস্কৃতি’। কিন্তু তা বলে, এ লেখার ছত্রে ছত্রে কেন এমন আত্মসমর্পণের আকুতি? এই দ্বিধাগ্রস্ত মনোভাবে এক দিকে যেমন ভয় ও ঘৃণার বাতাবরণ সৃষ্টিকারীরা উৎসাহিত হবে, অন্য দিকে উগ্র মৌলবাদী মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরাও আত্মরক্ষার অধিকারের কথা বলে পাল্টা প্রচারে লিপ্ত হওয়ার সুযোগ খুঁজবে। ইউটিউবে সেই প্রচারকদের উত্তেজিত ভাষণ শুনতে আগ্রহী দর্শক ও শ্রোতার সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাবে। আবার সেই ভাষণ শুনিয়েই ‘হিন্দু খতরে মে হ্যায়’ প্রচার শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা বেগবান হবে। নষ্ট হয়ে যাবে সম্প্রীতি আর গণতন্ত্রের বাতাবরণ। ভারতের স্বাধীনতার জন্য, গান্ধীর সঙ্গে সীমান্ত গান্ধী কিংবা সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে শাহনওয়াজ খানের ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের ঐতিহ্য ভূলুণ্ঠিত হবে। আশঙ্কা হয়, এ ভাবেই হয়তো হারিয়ে যাবে ভারতবর্ষ নামক ধারণাটি।

যে ‘সর্বব্যাপী ভয়’ এক জন ইসলাম ধর্মাবলম্বী অধ্যাপককে উত্তরপ্রদেশের ঐতিহ্যমণ্ডিত বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোচনাসভায় যোগদান করায় দ্বিধাগ্রস্ত করেছে, সেই ভয় কি শুধুই ইসলাম সম্প্রদায়ের মানুষের একার? এ দেশে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের দ্বারা বারে বারে আক্রান্ত হয়েছেন তথাকথিত নিম্নবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা। এক শ্রেণির উচ্চবর্ণের মানুষের প্রশ্রয়ে প্রকাশ্যে নিম্নবর্ণের মানুষের মুখে প্রস্রাব করে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটতে দেখেছেন এ দেশের মানুষ। হায়দরাবাদ ইউনিভার্সিটিতে নিম্নবর্ণের পড়ুয়া রোহিত ভেমুলার মতো মেধাবী গবেষকের বৃত্তি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তিনি আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন।

দেশ ভাগের কারণে পূর্ববঙ্গ থেকে আগত কয়েক কোটি ছিন্নমূল হিন্দু উদ্বাস্তুদের মধ্যে অনেকেই এনআরসি-র ভয়ে সিঁটিয়ে আছেন। বর্তমান শাসক গোষ্ঠীর নানা ধরনের কার্যকলাপে এই ভয় উদ্বাস্তুদের মনে উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। এঁদের অনেকের মনেই এখন বিদেশির তকমা সেঁটে যাওয়ার ‘ভয়’। অসমে এনআরসি প্রয়োগের পরবর্তী ছবিটা এঁরা অনেকেই ভুলতে পারছেন না। সেখানে শুধুমাত্র মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষকে বিদেশি বলে চিহ্নিত করা হয়নি। ওই রাজ্যে বহু দিন ধরে বসবাস করা হিন্দুরাও উপযুক্ত কাগজপত্রের অভাবে বিদেশির তকমা পেয়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে যেতে বাধ্য হয়েছেন। গুজরাত দাঙ্গা, হরিয়ানার দাঙ্গা, সেখানে অগ্নিসংযোগ এবং দূরপাল্লার ট্রেনে আরপিএফ জওয়ান যে ভাবে তিন মুসলিমকে হত্যা করেছে, তাতে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের হত্যা ও আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা বারে বারে ঘটেছে, এ কথা ঠিক। কিন্তু তার সঙ্গে এটাও ঠিক যে, আমাদের দেশের সংবিধানস্বীকৃত ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিকেও তো হত্যা করা হল। আক্রমণ করা হল এ দেশের নাগরিকদের যে কোনও রাজ্যে বসবাস করা ও জীবিকা নির্বাহের গণতান্ত্রিক অধিকার এবং সুস্থ মানবিক মূল্যবোধকে। ভয় দেখানোর এই কৌশল বর্তমান শাসক দলের লোকজনেরা সরকারে আসার অনেক আগে থেকে চালিয়ে যাচ্ছে। ওড়িশায় বজরং দলের জনৈক দারা সিংহ কর্তৃক খ্রিস্টান মিশনারি গ্রাহাম স্টেনকে তাঁর নাবালক দুই পুত্র-সহ জীবন্ত পুড়িয়ে মারার কথা ভারতবাসী ভুলতে পারবেন কি? সংবেদনশীল ভারতীয়রা ভুলতে পারবেন না স্পষ্টবক্তা সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশের নৃশংস হত্যার কথা, প্রতিবাদী কবি ও শিক্ষক ভারাভারা রাওয়ের লাঞ্ছনা কিংবা জনজাতিদের অধিকারের প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াইয়ের সেনাপতি স্ট্যান স্বামীর পরিণতির কথা। ভয় দেখিয়ে এঁদের কাউকে চুপ করানো যায়নি।

কলমের আঁচড়ে শহর, জনপদের নাম বদলে বা পাঠ্যসূচির পরিবর্তন ঘটিয়ে আপাতদৃষ্টিতে যে পরিবর্তন করা হচ্ছে, তা সাময়িক। এই পরিবর্তনে আতঙ্কিত হয়ে আমরা হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরা যদি দোল-দুর্গোৎসবে আনন্দ করা, ইদের সিমুই ভাগ করে খাওয়া কিংবা ‘লাভ জেহাদ’ বলে দাগিয়ে দেওয়ার ভয়ে হিন্দু বান্ধবীদের সঙ্গে সামলে কথা বলতে শুরু করি, তবে এ দেশের জনগণের জন্য শুধু গরলটুকুই বরাদ্দ থাকবে। যে ভূখণ্ডটুকুকে ভালবেসে কার্গিলের লড়াইয়ে ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রা শহিদ হলেন, প্রাণ দিলেন ক্যাপ্টেন হানিফুদ্দিন, তাঁদের আত্মত্যাগকে অসম্মান করার অধিকার আমাদের কে দিয়েছে?

পরিশেষে বলব, যত জন বাড়ি ভাড়া খুঁজতে গিয়ে নিজের মুসলিম পরিচয় দেওয়ার আগে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয় পেয়েছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যক মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ এখনও হিন্দু মহল্লায় সসম্মানে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকছেন এবং আগেও থেকেছেন। কিছু স্বার্থান্বেষী ধর্মান্ধ মানুষের ষড়যন্ত্রকে প্রশ্রয় দিতে ‘সর্বব্যাপী ভয়’-এর কথা বললে তো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাতাবরণটাই ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাবে। এটা কখনও আমাদের কাম্য হতে পারে না। হিন্দু-মুসলমান-জৈন-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ-শিখ’সহ সকল সম্প্রদায়ের মানুষ এক সঙ্গে থাকার অঙ্গীকার করেই স্বাধীন সার্বভৌম ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষ গড়া হয়েছে।

জাতপাতের ভেদাভেদ আর অন্ধ ধর্মীয় বিদ্বেষের ভয়কে জয় করেই আমাদের দেশকে সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছতে হবে।

রতন রায়চৌধুরী পানিহাটি, উত্তর ২৪ পরগনা

আরও পড়ুন
Advertisement