CPIM

সম্পাদক সমীপেষু: বিলম্বে বোধোদয়

বামেরা সরকারে এসে কয়েক বছরের মধ্যেই বিদ্যালয়ের প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি তুলে দিয়ে সাধারণ মানুষের কয়েক প্রজন্মের মেরুদণ্ড ভেঙে দিলেন। কিন্তু নিজেদের সন্তানদের তাঁরা ইংরেজি মাধ্যমেই পড়ালেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৯:৪৫

প্রেমাংশু চৌধুরী ‘শ্যাম রাখা, না কি কুল রাখা’ (১৪-১১) শীর্ষক প্রবন্ধে একটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক কথা বলেছেন যে, রাজনীতির গতিপ্রকৃতি সিপিএম দেরিতে টের পায়। কিন্তু এই দেরিতে টের পাওয়ার ‘সুফল’ ভোগ করে তারা পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘ ৩৪ বছর রাজত্ব করেছে, এবং নানা দিকে অবনতির সূচনা করে গিয়েছে। তা সত্ত্বেও স্বীকার করতেই হবে যে, তৃণমূল আমলের মতো দুর্নীতি বাম আমলে ছিল না। বামেরা সরকারে এসে কয়েক বছরের মধ্যেই বিদ্যালয়ের প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি তুলে দিয়ে সাধারণ মানুষের কয়েক প্রজন্মের মেরুদণ্ড ভেঙে দিলেন। কিন্তু নিজেদের সন্তানদের তাঁরা ইংরেজি মাধ্যমেই পড়ালেন। সারা দেশে কম্পিউটার প্রচলন, কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার, বেসরকারি এঞ্জিনিয়ারিং ও মেডিক্যাল কলেজ চালু হলেও এ রাজ্যে তাঁরা ‘টাটা-বিড়লা নিপাত যাক’, ‘লাঙল যার জমি তার’ ইত্যাদি স্লোগান এবং বেসরকারিকরণের আতঙ্ক সৃষ্টি করে ভোটব্যাঙ্ক বাড়িয়ে গেলেন, যা পরিশেষে রাজ্যবাসীর সর্বনাশ করে। এ রকম ‘ভোটসর্বস্ব’, ‘ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতিকর’ সিদ্ধান্তের পরে এক সময় ‘বোধোদয়’ হয় তাঁদের।

Advertisement

তবে, দেরিতে টের পাওয়ার ‘কুফল’ ভুগতে হল দলকে— এক সময়ের ‘নিপাত যাক’ তকমাধারী টাটাকে ‘স্বাগত’ জানাতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত পতন হয় সিপিএম-এর দুর্গের। প্রবন্ধকার লিখেছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই চৌত্রিশ বছরের বাম দুর্গের পতন ঘটিয়েছেন। তাই এক সময় তাঁরা (বামেরা) মনে মনে তৃণমূলকে হারাতে বিজেপির জয়ও প্রার্থনা করেছিলেন। ভুলে গিয়েছিলেন, বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এলে কমিউনিস্টদের শিকড়বাকড়-সহ উপড়ে ফেলবে।

বিজেপি ক্ষমতায় এলে কী করবে তা তো অনুমানের বিষয়, কিন্তু তৃণমূল ক্ষমতায় এসেই দিকে দিকে সিপিএম ও বাম শরিকদের দলীয় কার্যালয়ে আগুন লাগিয়ে, দখল করে শিকড়বাকড়-সহ উপড়ে ফেলার কাজে লেগে পড়ে। নতুন প্রজন্মের সিপিএম নেতারা এ সব ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী না হওয়ায় তাঁদের সামনের সারিতে এগিয়ে দিয়ে তৎকালীন নেতারা ‘পিছনে’ থেকে এখন বাজিমাত করতে চাইছেন। ক্ষমতা হারিয়েও তাঁদের ‘বিলম্বে বোধোদয়’-এর ধারা এখনও চলছে।

নিকুঞ্জ বিহারী ঘোড়াই, কলকাতা-৯৯

ভুল পদক্ষেপ

দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সিপিএম পার্টির অবস্থান এমন হওয়া উচিত ছিল যে, তারা মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারে। অথচ, সেখানেই তারা বারে বারে বিফল হচ্ছে। এই ক্ষেত্রে প্রেমাংশু চৌধুরীর প্রবন্ধটিতে যা তুলে ধরা হয়েছে, তা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। এ কথা অনস্বীকার্য যে, সিপিএম পার্টির আন্দোলনে সুস্পষ্ট সঙ্গী নির্ধারণের অবস্থানগত স্বচ্ছতা প্রশ্নাতীত নয়। রাজনীতির পথে চলার সময় সাফল্য অর্জন করতে দরকার সঠিক সঙ্গী ও প্রতিদ্বন্দ্বী নির্ধারণ। নব্বইয়ের দশকে সাম্প্রদায়িক বিজেপি দলকে প্রধান প্রতিপক্ষ চিহ্নিত করে কংগ্রেসকে সঙ্গে নিয়ে লড়াই করার যুক্তি উপস্থাপন করায় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সইফুদ্দিন চৌধুরীকে বহিষ্কার করেছিল। পরবর্তী সময়ে সেই কংগ্রেস-ই সিপিএম পার্টির সবচেয়ে বড় সহযোগী দল হয়ে ওঠে। জোট প্রসঙ্গে পার্টির বক্তব্যে চিনের মাও জে দং ও কুয়োমিনটাং নেতা চিয়াং কাই শেক-এর সন্ধির কথা উত্থাপন করা হয়। কিন্তু সেটা ছিল বাইরের শত্রু জাপানি আক্রমণকারীদের রুখতে জাতীয়তাবাদী কুয়োমিনটাং দলের সঙ্গে সন্ধি করে সাফল্য পাওয়ার একটি বৈপ্লবিক কৌশল।

এ দিকে এ রাজ্যে বাকি দু’টি দলের একটি সাম্প্রদায়িক বিজেপি এবং অন্যটি অগণতান্ত্রিক পথে চলা তৃণমূল কংগ্রেস। এখানে গত নির্বাচনগুলোতে পার্টির ‘বিজেমূল’ তত্ত্ব বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছিল। বিধানসভা ও লোকসভায় সিপিএম দল আসন পেয়েছিল শূন্য। রাজ্যে যে তৃণমূল দল পার্টির চরম বিরোধী, সেই দল আবার কেন্দ্রে ইন্ডিয়া জোটের শরিক হওয়ায় সিপিএম-এর সঙ্গে একই অবস্থানে রয়েছে। এই জটিল রাজনৈতিক অবস্থান সঠিক প্রতিপক্ষ চিহ্নিতকরণে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। ফলে, দলের সাফল্যও থাকছে অধরা।

২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে আইএসএফ-এর সঙ্গে সিপিএম জোট বাঁধে। কিন্তু এ বছরের লোকসভা নির্বাচনে সেই আইএসএফ ব্রাত্য থেকে যায়। অথচ, সাম্প্রতিক উপনির্বাচনে হাড়োয়া আসনে সেই আইএসএফ-ই বামফ্রন্টের প্রার্থী হয়ে দাঁড়ায়। দলের বক্তব্য, এ সব বর্তমান পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতা। এই বাধ্যবাধকতা মানুষের মধ্যে কী প্রভাব ফেলবে, দলের তরফে তার পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন। না হলে বাংলার মাটিতে যতটুকু অস্তিত্ব দলটির রয়েছে, তা-ও হারাবে।

সারনাথ হাজরা, হাওড়া

কঠিন জমি

প্রেমাংশু চৌধুরীর প্রবন্ধটি এ রাজ্যে সিপিএমের বর্তমান চিত্রটিই তুলে ধরেছে। আসলে বঙ্গ-সিপিএম আজকাল একটু বড় মিছিল বা বিক্ষোভ কর্মসূচি করলেই রাজ্য নেতৃত্ব ভাবতে বা প্রচার করতে শুরু করেন যে, বাম আবার ক্ষমতায় ফিরছে। কিন্তু প্রবন্ধকার ঠিকই ধরেছেন যে, গ্রামেগঞ্জে সিপিএমের সংগঠন ও সমর্থন প্রায় শূন্য। আসলে, সিপিএম দিনে দিনে জনবিচ্ছিন্ন একটা দলে পরিণত হচ্ছে। বিজেপিও গ্রামে ততটা মজবুত নয়, তা সত্ত্বেও বিরোধী ভোটের বড় অংশ তাদের ঝুলিতেই। এর অন্যতম কারণ, বঙ্গ-সিপিএমের ভ্রান্ত পরিকল্পনা এবং ভোটারদের মন বুঝতে না পারা। ৩৪ বছর কংগ্রেসের সঙ্গে মারামারি, খুনোখুনি করে ক্ষমতা হারানোর পর পাঁচ বছর না যেতেই তাদের সঙ্গে জোট বাঁধে তারা। এক দিকে তারা যেমন ধর্ম-নিরপেক্ষতার কথা বলছে, তেমনই অন্য দিকে আইএসএফ-এর সঙ্গে জোট বাঁধছে, বাংলাদেশে হিন্দু নিধনে বা মন্দিরে আগুন লাগানোয় চুপ থাকছে। মানুষ এই ভণ্ডামি মেনে নেয়নি। সামান্য ভোট এবং ‘ভোট কাটুয়া’ তকমা নিয়ে প্রতিটা নির্বাচনে শূন্যের সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে তাদের। ইদানীং কয়েক জন বামপন্থী বুদ্ধিজীবীর গলায় ‘সিঙ্গুর’ নিয়ে আক্ষেপ শোনা যায়। সিঙ্গুরে টাটারা এলে অবশ্যই রাজ্যের শিল্পের মানচিত্র বদলে যেত। কিন্তু এটাও কি ভোলা যায় যে, ৩৪ বছরে বামেদের জঙ্গি আন্দোলনের ফলে কত কারখানা, শিল্প ধ্বংস হয়েছে? এক শ্রেণির ট্রেড ইউনিয়ন নেতা মালিকদের সঙ্গে অনৈতিক আঁতাঁত গড়ে হাজার হাজার শ্রমিককে তাঁদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করেছেন? হয়তো বাম আমলে টাকার বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগ হয়নি, কিন্তু যোগ্য প্রার্থীর বদলে যে কেবলমাত্র পার্টি ক্যাডারদেরই শিক্ষাক্ষেত্রে চাকরি হত, এই তথ্য কারও অজানা কি? এই সব স্মৃতি এত সহজে ভুলবে না বাংলার মানুষ।

অন্য দিকে, ২০১৪-র পর বাংলার ভোট বিন্যাসে একটা পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়— তৃণমূল বিরোধী ভোটের একটা বড় অংশ বিজেপির দিকে ঝুঁকতে শুরু করে। বিজেপির হিন্দুত্ববাদী নীতি হিন্দু বামেদের যেমন বিজেপির দিকে টানে, তেমনই তৃণমূল নেতৃত্ব তাঁদের মুসলিমপ্রীতি দিয়ে মুসলিম বামেদের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জনে সমর্থ হন। অতীতে যেখানে সংখ্যালঘু ভোটের বড় অংশ বামেদের ছিল, সেখানে এখন থাবা বসিয়েছে তৃণমূল। সংখ্যালঘু ভোটের প্রায় সমস্তটাই তৃণমূল কংগ্রেসের দখলে। আর, হিন্দু ভোটের প্রায় ৬০ শতাংশের উপর বিজেপির দখলে। সে ক্ষেত্রে বামেরা ভোট পাবেন কোথা থেকে?

ভুললে চলবে না, সম্প্রতি আর জি কর-এর ঘটনা নিয়ে যে বিরাট গণ-আন্দোলন শুরু হয়, প্রাথমিক স্তরে তার রাশ কিন্তু ছিল বামেদের হাতেই। অথচ নিজেদের নীতির ভুলে সেই সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি দলটি। স্বাভাবিক ভাবেই বাংলায় নতুন করে ফিরে আসা বামেদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ল বলেই মনে করা যায়। সিদ্ধান্তের ঠিক-ভুলের দোলাচল দলটিকে শূন্য থেকে ক্রমাগত মহাশূন্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

স্বপন চক্রবর্তী, হাওড়া

Advertisement
আরও পড়ুন