Gender Equality

সম্পাদক সমীপেষু: লড়াই ঢের বাকি

রিপোর্ট অনুযায়ী, লিঙ্গসমতা আনতে ভারতের এখনও ১৩৪ বছর লেগে যাবে। এর থেকে ভারতীয় সমাজে নারীদের অবস্থানের ক্ষত ঠিক কতটা, সহজেই উপলব্ধি করা যায়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৯:১৫

ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে বর্তমানে নারী ও পুরুষের লিঙ্গবৈষম্য যথেষ্ট উদ্বেগজনক। সাম্প্রতিক ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম-এর ‘জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট’ অনুযায়ী ভারতের অবস্থান ১৪৬টি দেশের মধ্যে ১২৯তম, যা থেকে লিঙ্গবৈষম্যের মাধ্যমে নারীর সামাজিক বিভিন্ন পরিসরকে সঙ্কীর্ণ করে তোলার কথাটি স্পষ্ট। রিপোর্ট অনুযায়ী, লিঙ্গসমতা আনতে ভারতের এখনও ১৩৪ বছর লেগে যাবে। এর থেকে ভারতীয় সমাজে নারীদের অবস্থানের ক্ষত ঠিক কতটা, সহজেই উপলব্ধি করা যায়।

Advertisement

ভারতে নারী-পুরুষ সমপরিমাণ কাজ করেও নারীরা পুরুষদের তুলনায় কম বেতন পায়। বেশির ভাগ গৃহস্থ মহিলা সংসারে সমস্ত কাজ করার পর অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য অন্য কাজের সময় ও সুযোগ পায় না। তার পরেও জুড়ে রয়েছে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের প্রতি অবহেলা, অপমান, নির্যাতনের কাহিনি। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নয়, বরং রাজনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক, সাংস্কৃতিক সমস্ত দিকে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি। যেটা তাদের নৈতিক স্বাধীনতা এবং অধিকার হওয়া উচিত ছিল।

এ ক্ষেত্রে ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’-এর মতো জনপ্রিয় প্রকল্পগুলো মেয়েদের অনেকটা স্বস্তি দিতে পারে। বিশেষ করে যাদের স্বামীরা অন্য রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে কাজ করে, সন্তানদের নিয়ে সংসার চালানো দুষ্কর, কিংবা অর্থনৈতিক ভাবে অনগ্রসর শ্রেণি যাদের দু’বেলা ভাতের সন্ধান করতে ঘাম ছুটে যায়। সেখানে দাঁড়িয়ে পাঁচশো, হাজার, যে পরিমাণ অনুদানই পাওয়া যাক না কেন, তাতেই অনেকটা সুবিধা হয়। এই প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে কিছুটা হলেও করের টাকা সাধারণের মাঝে বণ্টিত হওয়ার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমানে এই প্রকল্পগুলোই ভারতীয় রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার।

তবে বর্তমান অনুদান প্রকল্পগুলোর নানান নেতিবাচক দিক রয়েছে। প্রথমত, রাজনৈতিক স্বার্থে চাহিদাহীন মানুষকেও প্রকল্পের আওতায় আনায় রাজকোষে চাপ বাড়ছে। পাশাপাশি প্রকৃত চাহিদাসম্পন্ন মানুষকে অনেক সময়ই প্রকল্পের আওতায় আসতে বহু কাঠখড় পোড়াতে হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, শুধু নারীদের দীর্ঘকালীন জীবনের মান উন্নয়নের জন্য এই অনুদান যথেষ্ট নয়। তার জন্য প্রয়োজন নির্দিষ্ট বয়স থেকে মহিলাদের শিক্ষাক্ষেত্রে, কর্মক্ষেত্রে, সামাজিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় সরকারি পদক্ষেপ, যা সামাজিক মান বৃদ্ধির পরিচায়ক। প্রকৃত স্বাবলম্বী হয়ে উঠার জন্য নারীদের লড়াইয়ের পথ এখনও অনেকটা বাকি।

নন্দন সরকার, বালুরঘাট, দক্ষিণ দিনাজপুর

শিক্ষার বিকাশ

পুলক রায়চৌধুরীর ‘বিজ্ঞানশিক্ষার করুণ হাল’ (৭-১২) শীর্ষক প্রবন্ধ সম্পর্কে দু’-চার কথা। স্কুলপাঠ্য সিলেবাসে গণিত, ইতিহাস, সাহিত্য, ভূগোল, অর্থনীতি, বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা’সহ অন্যান্য বিষয় পড়ানো হয়। এর মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীরা জ্ঞান লাভ করে। কিন্তু কোন বিষয়কে আমরা জ্ঞান-অর্জন বলে বুঝি? সভ্যতার উষা লগ্ন থেকে চার পাশের পরিবেশ, বৈষম্য দূর করার লড়াই, স্বাধীনতার লড়াই বা জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার বিভিন্ন দিকের উপর ভিত্তি করে সমগ্র মানব সমাজে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়েছে, তাকে আমরা জ্ঞান ভান্ডার বলে থাকি। বিপুল এই ভান্ডার গড়ে তুলতে চরম মূল্যও দিতে হয়েছে। প্রচলিত ধর্মীয় বিশ্বাসের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করায় প্রাণ দিতে হয়েছে বহু যুক্তিবাদীকে। মৌলবাদের বিরুদ্ধে বা স্বাধীনতার জন্য, গণতন্ত্রের জন্য কত লেখকের উপর নেমে এসেছিল অত্যাচার। আজকের শিক্ষার প্রতিটি ক্ষেত্রে উন্নতির জন্য, দেশের উন্নতির জন্য সেই সব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হবে। সূর্যের কিরণ, বৃষ্টির ধারা যেমন বৈষম্যহীন ভাবে সকলের কাছে পৌঁছয়— তেমনই শিক্ষাকে সকলের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।

আর এই জায়গাতেই হয়েছে সমস্যা। শাসক শ্রেণি তাদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য উন্নত চিন্তার মানুষ তৈরি করা, সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার মতো জরুরি কাজ দূরে সরিয়ে রাখতে চায়। কিছু বেতনভুক কর্মচারী তৈরিই তাদের উদ্দেশ্য। এই পরিকল্পনাকে তারা শিক্ষা নীতি হিসেবে চালাতে চায়। এই ধারাবাহিকতায় রাজ্য-কেন্দ্রের শিক্ষানীতিকে বুঝতে হবে। যার পরিণতি আমরা প্রত্যক্ষ করছি শিক্ষার প্রতিটি ক্ষেত্রে। প্রবন্ধকার বলেছেন, চারটি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে থাকে শিক্ষাব্যবস্থা— সিলেবাস, পাঠ্যবই, শ্রেণিকক্ষের অনুশীলন, মূল্যায়ন ব্যবস্থা। আমার মনে হয় এর সঙ্গে শিক্ষাখাতে অবশ্যই অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে হবে। আমাদের দেশে কোঠারি কমিশন-সহ প্রায় সমস্ত শিক্ষা কমিশন সুপারিশ করেছিল দেশের জাতীয় আয়ের অন্তত ৬% শিক্ষাখাতে ব্যয় করার। অথচ, প্রথম পরিকল্পনার পর স্বাধীনতার বয়স যত বেড়েছে, প্রতি বছর বরাদ্দ তত কমেছে।

প্রবন্ধকার বিজ্ঞানশিক্ষার দুরবস্থার কথা ভেবে স্কলারশিপ-এর উল্লেখ করেছেন। এখানে দরকার বিনা পয়সায় শিক্ষার ব্যবস্থা, যাতে বাধাহীন ভাবে সমস্ত প্রতিভার যথাযথ বিকাশ ঘটানো যায়।

বিশ্বনাথ সর্দার, রায়দিঘি, দক্ষিণ ২৪ পরগনা

মাটির স্বাস্থ্য

অমিতাভ পুরকায়স্থ তাঁর ‘মাটির স্বাস্থ্য ভাল রাখা চাই’ (৬-১২) প্রবন্ধে জরুরি একটি বিষয়ের উপর আলোকপাত করেছেন। মাটি সকল প্রকার জীবনের ভিত্তি। প্রাণীদের বাসভূমি বলেই নয়, স্বাস্থ্যকর মাটি শক্তপোক্ত উদ্ভিদ উৎপাদন, ফসল বৃদ্ধি, এবং খাদ্য নিরাপত্তায় সহায়তা করে। মাটির নানাবিধ গুরুত্ব অনুধাবন করে রাষ্ট্রপুঞ্জ ৫ ডিসেম্বর, ২০১৪-কে প্রথম আনুষ্ঠানিক ভাবে ‘বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস’ ঘোষণা করে।

মাটিতে জীবন্ত প্রাণীর প্রাচুর্য এবং বৈচিত্রই হল মাটির বাস্তুতন্ত্রের মূল চালক, যা তার উর্বরতা, পুষ্টি-চক্র এবং গ্রিনহাউস গ্যাসের ভারসাম্যকে নিয়ন্ত্রণ করে। এ ছাড়াও, অণুজীবগুলি প্রাকৃতিক বর্জ্য পচিয়ে মাটিতে রূপান্তরিত করে, দূষিত মাটিকে ‘ডি-টক্সিফাই’ করে এবং গাছপালা ও প্রাণীর উপযোগী করে পরিবেশকে পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। তাই মাটির জীববৈচিত্র বজায় না রেখে মাটি ও মানুষের স্বাস্থ্যের উন্নতি করা যায় না, যা বর্তমানে কৃষি রাসায়নিকের অত্যধিক ব্যবহার এবং রাসায়নিক সারের ভারসাম্যহীন ব্যবহারের কারণে হ্রাস পাচ্ছে। কৃষিতে জৈব উপকরণের কম ব্যবহারের কারণে মাটির জৈব পদার্থ হ্রাস পাচ্ছে। মাটিতে ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ফলে মাটির জীবাণুসংখ্যা এবং তাদের স্বাভাবিক কার্যকলাপ হ্রাস পাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে মাটির জীববৈচিত্র টিকিয়ে রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সুতরাং, বর্তমান ক্রমবর্ধমান খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা এবং দারিদ্র সমস্যা দূর করার জন্য জীববৈচিত্র সংরক্ষণ একান্ত প্রয়োজন। কৃষকদের অবশ্যই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে— যেমন রাসায়নিক সারের সুষম ব্যবহার, জৈব উপকরণের সঙ্গে সমন্বয় সাধন, সঠিক পদ্ধতিতে সেচের কাজ, চুন দিয়ে মাটির অম্লতা সংশোধন, চাষের পদ্ধতিতে বৈচিত্রসাধন ইত্যাদি। অন্যান্য মৃত্তিকা সংরক্ষণ ব্যবস্থা— যেমন লেবুজাতীয় ফসলের ব্যবহার, শস্যের ঘূর্ণন বা রোটেশন এবং বনসৃজন মাটির জৈব ক্রিয়াকলাপকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে উন্নত মানের সারের ব্যবহার রাসায়নিক সারের ভূমিকার পরিপূরক হয়ে উঠেছে এবং মাটির জৈবিক, ভৌত এবং রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যের উন্নতিতে সহায়ক হয়েছে। তবে এই বিষয়ে স্থানীয় স্তরে আরও বেশি করে সচেতনতা প্রয়োজন।

ফসলের উৎপাদনশীলতা এবং মানুষের জীবনযাত্রার উন্নতিতে মাটির জীববৈচিত্রের গুরুত্ব এবং মাটির স্বাস্থ্য, ভূমিকা সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করা সকলের দায়িত্ব। মনে রাখতে হবে, সুস্থ মাটি পরিবেশকে সুস্থ করে, আর সুস্থ পরিবেশ মানুষকে ভাল ভাবে বাঁচতে সাহায্য করে।

সৌম্য বটব্যাল, দক্ষিণ বারাসত, দক্ষিণ ২৪ পরগনা

Advertisement
আরও পড়ুন