Government Schools

সম্পাদক সমীপেষু: শিক্ষা ও সমাজ

এই অশিক্ষার আবহে অনেকটা অলক্ষ্যে অধিকাংশ স্কুলের সঙ্গে স্থানীয় শিক্ষিত মানুষ, ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকার সঙ্গে আত্মিক অভাবের এক বাতাবরণ তৈরি হয়েছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০২৪ ০৬:৩৪

তূর্য বাইনের ‘বিশ্বাসটা কি আর ফিরবে’ (১৪-৫) প্রবন্ধ প্রসঙ্গে এই চিঠি। সরকারি স্কুলগুলিতে শিক্ষার উপযুক্ত পরিমণ্ডল তৈরি করে পড়ুয়া ও অভিভাবকদের আস্থা ফেরাতে উপযুক্ত পদক্ষেপ জরুরি— লেখকের এই নাগরিক শপথের সঙ্গে একমত হতেই হয়। আশা করা যায়, রাজ্যের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ পথ খুঁজে বার করবেন। যত শীঘ্র সম্ভব ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে অভিভাবকরা সরকারি ও শাসক দলের জনপ্রতিনিধিদের কাছে দাবি রাখবেন। সরকারি রাজস্ব বা জনগণের দেওয়া কর-শুল্ক ব্যয়ে নতুন সম্পদ নষ্ট হচ্ছে। ফাঁকা সরকারি স্কুল আসলে সরকারের বদনাম, ব্যর্থতার পরিচয়।

Advertisement

এই দাবি পূরণ করা কঠিন বিষয় নয়। কেন্দ্রীয় প্রকল্প সর্বশিক্ষা অভিযানের কার্যকারিতায় বিগত প্রায় দুই দশকে স্কুলবাড়ি, খেলার মাঠ, শৌচালয় ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বস্তুগত পরিকাঠামো প্রায় সব স্কুলেই তৈরি হয়েছে। কিন্তু এ সব রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য মানবসম্পদের স্থায়ী জোগানের দিকে লক্ষ রাখা হয়নি। ইদানীং শিক্ষাজগতের দুর্নীতির জন্য যোগ্য শিক্ষাকর্মী ও শিক্ষকের অভাব সামগ্রিক পরিকাঠামোকে বিপর্যস্ত করেছে। আগের সরকার ইংরেজিকে প্রয়োজনীয় গুরুত্ব না দিয়ে যথেষ্ট শিক্ষা পেয়েছে। বর্তমান সরকার কোনও শিক্ষার প্রয়োজন বোধ করছে না। অন্তত রাজ্যের শিক্ষাবিদ, শিক্ষামন্ত্রী, উপদেষ্টা, শিক্ষাপ্রেমী মহলের অবস্থান তাই বলে।

এই অশিক্ষার আবহে অনেকটা অলক্ষ্যে অধিকাংশ স্কুলের সঙ্গে স্থানীয় শিক্ষিত মানুষ, ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকার সঙ্গে আত্মিক অভাবের এক বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। কারণ, স্কুলে শিক্ষক থেকে শিক্ষা দফতর অবধি শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা ও সময়ানুবর্তিতার অভাব বেড়েই চলেছে, যা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে সাধারণত দেখা যায় না। শিক্ষার্থী সরকারি স্কুলে উপস্থিত না থেকেও পাশ হয়ে যাচ্ছে! নজরদারির অভাবে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী, উভয়ের মূল্যায়ন উপেক্ষিত। নতুন শৌচালয় জলের অভাবে পরিত্যক্ত। সাফাইকর্মীর অভাবে ক্লাসরুম-সহ স্কুল চত্বর অপরিষ্কার। পানীয় জলের ব্যবস্থা নিজেদের করতে হয়। স্কুলের একমাত্র পরিচয় কোনও রকমে মিড-ডে মিলের ব্যবস্থা। এ সব অভিভাবক, ছাত্রছাত্রীরা দেখছে স্বচক্ষে। ইংরেজি স্কুলের সযত্ন পরিকাঠামোর প্রতি ‘বিশ্বাস’-এর কার্যকারণ এইখানেই স্পষ্ট। এখানে সরকারি অবৈতনিক ব্যবস্থার সুযোগ স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিয়ে ছেলেমেয়ের জন্য অনেক টাকা খরচ করেও অভিভাবকরা অসরকারি ইংরেজি স্কুলে পড়াচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, কোচিং সেন্টার, প্রাইভেট টিউশনের জন্য টাকা খরচ করতে হচ্ছে। অর্থাৎ, সরকারি স্কুলে বিনাব্যয়ে শিক্ষার জায়গায় দু’গুণ খরচ করতে হচ্ছে অভিভাবকদের। এতেও সুশিক্ষার গ্যারান্টি নেই। জমি বেচে, অতিরিক্ত শ্রম করে বাবা-মা রাজ্যের বাইরের স্কুলে ছেলেমেয়েদের পড়তে পাঠাচ্ছেন। তাই এই রাজ্যে সার্বিক শিক্ষার সঙ্গে সমাজের আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠছে না।

রাজনীতি এখন জীবিকাবিশেষ। আইননির্মাতা সাংসদ, বিধায়কদের তাই পরীক্ষা দিয়ে যোগ্য প্রমাণিত হওয়া প্রয়োজন। যেমন— আইএএস, আইপিএস, আইএফএস, ডব্লিউবিসিএস ইত্যাদি দায়িত্বশীল পদের জন্য রীতিমতো দক্ষ হতে হয়। অথচ, দেখা যায় এই উচ্চপদাধিকারীদের দাবিয়ে রাখছে অদক্ষ, অশিক্ষিত জনপ্রতিনিধিরা, শুধু অর্থ আর ক্ষমতার বলে সাংসদ, বিধায়ক হয়ে। শিক্ষার অভাব তৃণমূল স্তরে, স্কুলে। কিন্তু তার চেয়েও বড় অভাব রাজনীতির জগতে। অর্থাৎ, শিক্ষাজগতে প্রথমে ‘বিশ্বাস’ ফিরিয়ে আনতে পারে রাজনীতি। সে বিশ্বাস অবধারিত ভাবে অভিকর্ষের টানে নিজেদেরই ‘বিশ্বাস’-এর ভিত শক্ত করবে। নয়তো নির্বাচনের আঙিনায় নির্বাচক অভিভাবক, উচ্চশিক্ষার্থীরা অশিক্ষিতদের বয়কট করবেন। সেটা গণতন্ত্রের শিক্ষার পক্ষে শুভ নয়।

শুভ্রাংশু কুমার রায়, চন্দননগর, হুগলি

আড়ালে শিক্ষা

তূর্য বাইন তাঁর উত্তর সম্পাদকীয় প্রবন্ধের উপসংহারে যে বিষাদের সুর ছড়িয়ে দিয়েছেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয়, ২০১৬-র বাতিল প্যানেলের প্রায় ছাব্বিশ হাজার শিক্ষকের ভাগ্যলিপি এখন যেন অভিভাবকদের অনুগ্রহের উপর নির্ভরশীল। তদুপরি প্রিয় ছাত্রদের মনোজগতে আস্থা ফেরানোর গুরুত্বপূর্ণ দায় তাঁদের, যাঁদের চাকরি বাতিল হওয়ার রায় ঘোষণা করেছিল হাই কোর্ট। যোগ্য-অযোগ্য সম্পর্কিত বিষয় এই ক্ষেত্রে মূল্যহীন। তর্কাতীত ভাবে যোগ্য শিক্ষক, যাঁদের একাসনে বসানো হল, তাঁদের মান-সম্মানও ধূলিধূসরিত হল। সম্মান এমন একটি স্পর্শ-গন্ধহীন অনুভবী বিষয়, যা এক বার হারালে পুনরায় উদ্ধার করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়।

প্রবন্ধকার উল্লেখ করেছেন, ২০১৪ সালের টেট-এর মাধ্যমে নিযুক্ত প্রাথমিক শিক্ষকদের বাতিল তালিকার প্রসঙ্গ, যাঁরা উচ্চ ন্যায়ালয়ের অন্তর্বর্তিকালীন স্থগিতাদেশ বাতিল হওয়ার পর এখনও চাকরিতে বহাল। অভিযোগ, তাঁদের একাংশও ঘুষের বিনিময়ে চাকরি পেয়েছিলেন। ভাবলে লজ্জিত হতে হয়, ঘুষের বিনিময়ে পাওয়া চাকরিতে শিক্ষকরা বহাল তবিয়তে চাকরি করেছেন, ছাত্র পড়িয়েছেন, পড়াচ্ছেন। নিজেদের অযোগ্যতায় তাঁরা ছাত্রদের কতটা সঠিক শিক্ষা দিতে পেরেছেন, সে প্রশ্ন এখন উঠবেই। এই অন্ধকারাচ্ছন্ন কালে ফাঁকফোকর দিয়ে আরও নিবিড় ভাবে বিস্তার লাভ করছে অসরকারি স্কুলগুলোতে ছেলেমেয়েকে ভর্তি করার বাসনা। বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলোর প্রতি এমন অনীহা কেন তৈরি হল? সেখানে তো দান-খয়রাতির মেলা। মিড-ডে মিল, পোশাক, জুতো, বইপত্তর, উঁচু ক্লাসে নানাবিধ সরকারি প্রকল্প, হাতে ট্যাব, সাইকেল— তাও কয়েক হাজার স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা ৩০-এর নীচে থাকায় সেগুলো লাটে ওঠার মুখে। যাঁরা বাংলা মাধ্যমে পড়ে চাকরিতে থিতু হয়ে জীবনটা কাটিয়ে দিলেন, তাঁরা ভুলেও ভাবেন না এত সব। তবু, বছর বছর ছাত্র-ছাত্রীরা মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করছে। যারা মোটামুটি নম্বর পেয়ে সাধারণ কলেজে অনার্স না পেয়ে ভর্তি হল, তাদের ভবিষ্যৎ বলে কিছু কি আছে? চাকরির বাজারে হাহাকার। শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্য। পর্ষদও মেনে নেয় কয়েক হাজার অসদুপায়ে চাকরি পাওয়ার কথা। শুধু, ঘুষের বিনিময়ে লেনদেনের তালিকা আজ অবধি প্রকাশ্যে এল না।

অসরকারি স্কুলগুলো প্রচুর টাকা নেয়। কিন্তু, যে উন্নত পদ্ধতিতে হরেক রকম পাঠ্যবিষয় ছাড়াও অতিরিক্ত কার্যকলাপে শিক্ষার্থীদের ব্যস্ত রাখে সারা বছর, তা শিক্ষণীয়। বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলোতে দীর্ঘ গ্রীষ্মাবকাশ বা পুজোর ছুটিতে বাড়ির তদারকি ছাড়া ছেলেমেয়েরা বইয়ের সঙ্গে আড়ি-ভাব করে কাটিয়ে দেয়। অতি দরিদ্র পরিবারগুলোর কাছে এই অবকাশ যন্ত্রণাময়। কারণ, স্বামী-স্ত্রী উভয়েই বেরিয়ে যান কায়িক পরিশ্রমের কাজে। ছেলেমেয়েদের দেখার কেউ থাকে না।

যোগ্য-অযোগ্যদের বিচার সারা হলে সরকারকে ভাবতে হবে, দানসত্র খুলে শিক্ষাক্ষেত্র মজবুত করা যায় না। স্কুলে যাওয়ার উদ্দেশ্য যদি হয় মিড-ডে মিল, ‘সবুজ সাথী’র সাইকেল, উঁচু ক্লাসে ট্যাব ইত্যাদির অধিকার বোধ জাহির করা, শিক্ষা সে-ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা নিতে পারে না, পর্দার আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়।

ধ্রুবজ্যোতি বাগচী, কলকাতা-১২৫

টাকা কেন

ভোটের আগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অন্যতম ঘোষণা— তারা ক্ষমতায় এলেই সব জনগণকে টাকা দেবে। এর জন্য বিভিন্ন প্রকল্পও নামাঙ্কিত হয়। কিন্তু আমরা ভেবে দেখি না কোথা থেকে এর সংস্থান হবে। এমনকি এটা যে একশো চল্লিশ কোটি জনসংখ্যার দেশে আকাশকুসুম, সে নিয়েও কেউ প্রশ্ন তোলে না। আরও প্রশ্ন, রাজনৈতিক দল টাকা দেবে কেন? কাদের থেকে নিয়ে দেবে? করের টাকা ও জাতীয় জনকল্যাণার্থে তহবিলের টাকা নয়ছয়ের অধিকার রাজ্য বা কেন্দ্রকে কে দেয়? উন্নয়নের অর্থ কি জনে জনে টাকা দেওয়া?

অরিত্র মুখোপাধ্যায়, শ্রীরামপুর, হুগলি

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement