এপ্রিল ২০২২
imran khan

নামভূমিকায়

অবসর ভেঙে মাঠে ফিরে পাকিস্তানের হাতে তুলে দিয়েছিলেন স্বপ্নের বিশ্বকাপ। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শেষেও তেমন আলো আছে কি, প্রশ্নের মুখে ইমরান খান

Advertisement
অগ্নি রায়
শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০২২ ০৫:১৬

বিবিধ দল উপদলে বিন্যস্ত, একটি নড়বড়ে আত্মবিশ্বাসহীন টিম পেয়েছিলেন তিনি ঠিক ত্রিশ বছর আগে। তৎকালীন পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট জিয়া উল হকের বিশেষ অনুরোধে অবসর ভেঙে ইমরান আহমেদ খান নিয়াজি ফিরে এসেছিলেন বাইশ গজে। রাজকীয় প্রত্যাবর্তন! দেশকে বিশ্বকাপ দিয়ে রাতারাতি জাতীয় নায়ক হয়ে গিয়েছিলেন অক্সফোর্ড শিক্ষিত এই পাশতুন। বিশ্বকাপ হাতে তাঁর ছবি ছিল পাকিস্তানের সেরা বিজ্ঞাপন।

‘আজ সেই ঘরে এলায়ে পড়েছে ছবি’! রং চটা পুরনো কাপড়ের মতো। সহযোদ্ধাদের পরামর্শ দিতেন আহত শার্দূলের মতো লড়াই করতে। অথচ, দীর্ঘ দু’দশকের চেষ্টায় এত সাধের প্রধানমন্ত্রিত্ব পাওয়া সত্ত্বেও ইনিংসের মাঝপথেই রান আউট হয়ে গেলেন ইমরান।

Advertisement

অগ্নি উদ্গিরণ করতে করতে ক্রমশ নিবে যাওয়া অলাতচক্রের মতো জীবন ইমরানের। সাফল্যের তুঙ্গ থেকে নিন্দার ঝড়ে যাঁর গ্যালারি ভেসে গিয়েছে বার বার। ব্যক্তিগত জীবন তছনছ হয়েছে এই প্রবল ক্যারিসম্যাটিক সুদর্শনের। প্রধানমন্ত্রী কুর্সি থেকে উৎখাতের আগে পর্যন্ত বলেছেন, ‘শেষ বল পর্যন্ত লড়ব’। কিন্তু হায়, ৩৬২টি টেস্ট উইকেটের মালিক জানতেনই না, বা জেনেও নিজের কাছে স্বীকার করেননি যে, তাঁর হাত থেকে ঝরে গিয়েছে সেই প্রখ্যাত ইনসুয়িং। কবচকুণ্ডলহীন হয়ে পড়েছেন তিনি আজ, সম্পূর্ণ অরক্ষিত।

১৯৫২ সালে লাহোরে উচ্চবিত্ত পরিবারে জন্ম ইমরানের। বিত্ত এবং মেধার মিশেলে ১৯৭৫ সালে অক্সফোর্ডের কেবেল কলেজ থেকে স্নাতক হয়েছেন। আর তার চার বছর আগেই মাত্র ১৮ বছর বয়সে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট অভিষেক। ১৯৭১ সালে শুরু হওয়া তাঁর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট জীবন দু’দশকের। দেশকে বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন করার পর ১৯৯২ সালে পাকাপাকি ভাবে বিদায় জানান বাইশ গজকে। চার বছরের মধ্যে তৈরি করেন রাজনৈতিক দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)।

পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানের জনজীবনে ইমরানের অবদান তাঁর বিরোধীরাও অস্বীকার করতে পারেননি। বিশেষ করে পাকিস্তানে ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য তাঁর প্রয়াসকে। পাকিস্তানে ভাল ক্যানসার হাসপাতাল এবং চিকিৎসার সুযোগ না থাকায় ক্যানসার আক্রান্ত মাকে উন্নত মানের চিকিৎসা দিতে পারেননি ইমরান। তাই মায়ের মৃত্যুর পর ১৯৯১ সালে শুরু করেন অর্থ সংগ্রহ। সংগ্রহ করেন বিপুল টাকা (প্রায় ২৫ মিলিয়ন আমেরিকান ডলার)। লাহোরে গড়ে তোলেন শৌকত খানুম মেমোরিয়াল ক্যানসার হাসপাতাল। পরে পেশোয়ারে তৈরি করেন দ্বিতীয় হাসপাতাল। তাঁর তৈরি দুই হাসপাতালেই দরিদ্রদের জন্য এখনও স্বল্পমূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে।

২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ইমরান আসলে মৌচাকে হাত দিয়ে ফেলেছিলেন— নিছক অবিমৃশ্যকারিতা। ক্ষমতাসীন হওয়ার সময় তাঁর নিজের পিছনে জনসমর্থন ছিল এটা ঠিকই। কিন্তু পাকিস্তানে শুধু জনসমর্থনই তো প্রধানমন্ত্রী হওয়ার শেষ মাপকাঠি নয়। গোড়ায় থাকলেও, পাক সেনা এবং গোয়েন্দাবাহিনীর সহযোগিতা শেষ পর্যন্ত ছিল না তাঁর সঙ্গে। ইমরান ক্রমশ বিভিন্ন বিষয়ে চটিয়ে তুলেছিলেন পাকিস্তানের সেনাকে। সেনা এবং গোয়েন্দা সংস্থার অভ্যন্তরীণ টানাপড়েনে নাক গলিয়েছিলেন। সেনাপ্রধান জেনারেল বাজওয়া এবং গোয়েন্দা প্রধান ফায়েজ় হামিদের বিরোধের মধ্যে ঢুকে হামিদের পক্ষ নিয়েছেন। একই সঙ্গে পঞ্জাবে সুশাসন নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন ইমরান। আমেরিকা এবং চিনের বিরাগভাজন হয়েছেন ভুল বিদেশনীতির জন্য। ঘরোয়া অর্থনীতির হাল ক্রমশ শোচনীয় হয়েছে। দেশবাসীর জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে গিয়েছে, খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে, দেখা দিয়েছে মূল্যস্ফীতি।

ইমরানের ব্যক্তিজীবনও বার বার সামনে চলে এসে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার মুখরোচক খাদ্য হয়েছে। তাঁর তিনটি বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, তুমুল কেচ্ছা সবই গিলেছে তাঁর দেশবাসী। পাকিস্তান ইউরোপের কোনও দেশ নয়, ফলে তাঁর ব্যক্তিজীবন ইমরানের রাজনৈতিক ভাবমূর্তিকে বরাবরই (প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অনেক আগে থেকেই) অস্থির করে রেখেছে। জেমাইমা গোল্ডস্মিথ বা রেহাম খানের সঙ্গে বনিবনা শুধু হয়নি তা-ই নয়— তাঁরা প্রকাশ্যে ইমরানের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে বিষোদ্গার করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগও উঠেছে। তাঁর নানা কাণ্ডকারখানা নিয়ে আওয়াজ উঠছে সিন্ধ থেকে লাহোর পর্যন্ত। পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী মিফতাহ ইসমাইল দু’দিন আগেই বলেছেন, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নাকি রোজ হেলিকপ্টারে করে অফিস যাতায়াত করতেন! দেশের এই ভয়ঙ্কর আর্থিক দুঃসময়ে তাঁর যাতায়াতের জন্য দেশকে তিন বছর আট মাসে নাকি গুনাগার দিতে হয়েছে ৫৫০ কোটি পাকিস্তানি রুপি! এ রকম হাজার অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে। সরকারি সম্পত্তি বিক্রি করে দেওয়া যার মধ্যে সাম্প্রতিক উদাহরণ। অথচ আস্থা ভোটে হেরে গদিচ্যুত হওয়ার পরেও স্তিমিত হলেও গর্জন শোনা যাচ্ছে ইমরানের কণ্ঠে। বলেছেন, “পাকিস্তানের দ্বিতীয় স্বাধীনতার লড়াই সবে শুরু হল!”

সবুজ মাঠ থেকে যে ইনিংস শুরু হয়েছিল, অন্ধকার কারাগারেই তার শেষ কি না, তা অবশ্য একমাত্র সময়ই বলতে পারবে।

আরও পড়ুন
Advertisement