প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ফাইল চিত্র
বেসরকারিকরণ আর ‘নগদীকরণ’-এর মধ্যে একটি ভিত্তিগত পার্থক্য রয়েছে। প্রথমটির ক্ষেত্রে কোনও ব্যবসা বা প্রতিষ্ঠান থেকে সরকারের সরে আসা বোঝায়। আর দ্বিতীয়টি এমন ক্ষেত্রে সরকারের সক্রিয়তার বিষয়েই ইঙ্গিত করে। সেই কারণে বেসরকারিকরণ তুলনামূলক ভাবে নগদীকরণের থেকে অনেক সহজ কাজ। তা সত্ত্বেও দেখা যায়, ভারত সরকারের বেসরকারিকরণের ইতিহাসটা বেশ হতাশাব্যঞ্জক (এয়ার ইন্ডিয়া বা ভারত পেট্রোলিয়াম তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ)। বিলগ্নীকরণের ক্ষেত্র বাছাইয়ের ব্যাপারে সরকার বেশ কয়েক বার লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে বলা যায়। অন্য দিকে আবার চার বছরে ৬ লক্ষ কোটি টাকা লাভের আশায় নগদীকরণের প্রক্রিয়াও তেমন সফল হয়নি। ভারতীয় রেলের সম্পত্তি বিক্রি করে নগদীকরণের চেষ্টাও সফল হয়নি। ক্রেতাদের ঔৎসুক্যই তৈরি করা যায়নি। যদি সেই উচ্চাশা পূরণই না হয়ে থাকে, তবে ফলাও করে তা ঘোষণা করার মধ্যে কোনও কৃতিত্ব আছে কি? বিশেষত, যখন এই উচ্চাশা পূর্ব অভিজ্ঞতার সম্পূর্ণ বিপরীত কথা বলে?
এখানে আরেকটি সমস্যা আছে। যা বিশেষজ্ঞরা আগেই বলেছেন। বিষয়টিকে ‘বান্ধবপোষণ’ (যা চরিত্রগত ভাবে ‘স্বজনপোষণ’-এর থেকে আলাদা) বলে তাঁরা চিহ্নিত করেছেন। মনে করুন, নরেন্দ্র মোদীর সেই বিখ্যাত উক্তি: “না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা।” (সরলার্থে, দুর্নীতি করব না। অন্যদেরও করতে দেব না)। কেউ তর্ক করতেই পারেন এই বলে যে, ‘ইলেক্টোরাল বন্ড’ বস্তুটি কি ‘খাউঙ্গা’-র উদাহরণ নয়? কিন্তু ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের তৈরি দুর্নীতি নির্ধারক তালিকায় (করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স) গত দু’বছরে ভারতের অবস্থান ইতিবাচক ভাবেই বদলেছে। বিশ্বের প্রথম ১৮০টি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে ভারত ৭৮ থেকে ৮৬-তে মেনে গিয়েছে। এখানেই মোদী সরকার সম্পর্কে গণধারণা বদলের কাহিনি লুকিয়ে।
এমন একটি পরিস্থিতিতে বেসরকারিকরণ আর নগদীকরণ— দুটোই ঝুঁকির কাজ। মনমোহন সিংহের সরকারের কথা ধরলে দেখা যাবে, টেলিকম সংস্থা এবং খনিগুলির লাইসেন্স নিলাম ডেকেই তা ধ্বংসের পথে এগিয়ে গিয়েছিল। যে সব ব্যক্তিগত লগ্নিকারী সরকারি পদ্ধতিতে আস্থা রেখেছিলেন, তাঁরাও বিধ্বস্ত হন। কারণ, আদালত পরে দু’রকম লাইসেন্সই বাতিল বলে ঘোষণা করে। এমন একটি দেশ, যেখানে অর্থনীতিবিদ অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যমের মতে ‘কালিমালিপ্ত পুঁজি’-র কোনও অভাব নেই, সেখানে ব্যক্তিগত সুনাম-দুর্নাম নিয়ে সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন ফরাসিরা প্রায়শই বলে থাকেন— অনিল অম্বানী ভারত সরকারের ‘অনুগ্রহপ্রাপ্ত’ ঠিকাদার।
এ বার কিছু বৈপরীত্য আর সমাপতনের দিকে তাকানো যাক। যে সব বৃহৎ খুচরো পণ্যবাণিজ্যের চেনগুলি তাদের ব্যালান্স শিটের বলে বলীয়ান হয়ে ক্রেতাদের বিপুল ছাড় দিয়ে বাজার ধরে, তার প্রতি সরকারের দৃষ্টি খানিক তির্যক। কিন্তু দেখার বিষয়, টেলিকম কমিশনও জিও-কে টেলি যোগাযোগ ক্ষেত্রে একই কাজ করার ছাড়পত্র দিয়েছিল। এবং কী উপায়ে জিভিকে গোষ্ঠী কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (সিবিআই) এবং এনফোর্সমেন্ট ডায়রেক্টরেট (ইডি)-এর দরপত্রে সুবিধা পায় (তখন ইডি-র এক শীর্ষ আধিকারিক বিজেপি-তে যোগ দিতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছিল)। তখন জিভিকে মুম্বই বিমানবন্দরের অধিগ্রহণ নিয়ে আদানি গোষ্ঠীর সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
এই ধরনের ঘটনা ‘এজেন্সি রাজ’-এর আমলে যে বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে, তা নিশ্চিত ভাবে বলা যায়। এটি এমন এক সময়, যখন ভূয়োদর্শী প্রশাসকরা বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য জটিল সব নিয়মবিধি প্রণয়ন করেন। এমন সময়েই দুর্নীতিগ্রস্ত এনরন এবং তার অংশীদাররা একতরফা দাভোল শক্তি চুক্তির ক্ষেত্রে লাভবান হয় (যা মহারাষ্ট্র রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদকে প্রায় দেউলিয়া করার পথ প্রশস্ত করেছিল)। এমনকি, তৎকালীন শক্তি সচিব কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ প্রাধিকরণের (সেন্ট্রাল ইলেকট্রিসিটি অথরিটি) বিধিবদ্ধ দায়বদ্ধতাকেও টপকে প্রকল্পের যৌক্তিকতা নির্ধারণে রত হন। সেই সঙ্গে এ-ও জিজ্ঞাস্য যে, আদানি গোষ্ঠী কোন মন্ত্রবলে কেরলের ভিঝিঞ্জাম বন্দর নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য ৪০ বছরের চুক্তিবদ্ধ হয়, যেখানে এমন চুক্তির মেয়াদ সাধারণত ৩০ বছর হয়ে থাকে?
সেই সঙ্গে এ-ও ভাবুন, চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে কী ভাবে টাটা গোষ্ঠীর ভারতীয় হোটেলগুলি নতুন নিলাম রুখতে আদালতের শরণ নেয়। যার ফলে নয়াদিল্লির এক গুরুত্বপূর্ণ বিলাসবহুল হোটেলের উপর তাদের কর্তৃত্ব বলবৎ থাকে (সংস্থাটি শেষ পর্যন্ত এক নতুন ঠিকা-চুক্তিতে আবদ্ধ হয়)। ভাবুন, শুল্ক-পথগুলিতে ঠিকাদাররা কী উপায়ে আদায়ীকৃত অর্থের পরিমাণে কারচুপি করে রাজস্ব ফাঁকি দেয়। সেই সঙ্গে ভাবুন পরিকাঠামোগত পরিষেবার ঠিকা আর আর্থিক পরিষেবা সংক্রান্ত বিষয়গুলি নিয়েও। এর পর চিন্তা করুন, এই সব চুক্তি সম্পাদন এবং পর্যবেক্ষণের প্রতিটি ধাপে সরকারি আধিকারিকরা মধ্যস্থতাকারী হয়ে কাজ করেছেন (অথবা অবসর গ্রহণের পরে এ সব কাজের দায়িত্ব পেয়ে ফায়দা লুটেছেন) এবং এই সব বিষয়ের নিয়ন্তা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। অথবা অনেক ক্ষেত্রে সেই সব কোম্পানির পরিচালক মণ্ডলীর সদস্যপদ অলঙ্কৃত করেছেন। বেসরকারিকরণের চেয়ে বা সেই সূত্রে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ হারানোর চেয়ে এ সব ঘটনা কীসে ভাল?
সংক্ষেপে, মোদী সরকার এমন এক বিপজ্জনক উপকূলে তাদের তরী ভিড়িয়েছে, যেখানে যত্রতত্র বিস্ফোরক বিছানো। নির্বিচারে এই ঝুঁকি গ্রহণের এবং কঠোর লক্ষ্যে পৌঁছনোর প্রয়াসের জন্য কেউ তাদের প্রশংসা করতেই পারেন। কিন্তু তাদের ইতিপূর্বে করা গুরুতর ভ্রান্তি এবং লক্ষ্যপুরণে ব্যর্থতাগুলির খতিয়ান নিতে গেলে যেটি প্রকট হয়ে ওঠে, তা হল দেশের বিভিন্ন ক্ষয়িষ্ণু প্রতিষ্ঠানের দুর্বল চেহারা আর ‘কালিমালিপ্ত পুঁজি’র দাপট। এ সব থেকে একটি দেশ কী আর পেতে পারে? বড় জোর আর একটা কেলেঙ্কারি। এ সব থেকে প্রভূত কাজ হচ্ছে, এমন এক বিভ্রম তৈরি হতে পারে। সেই বিভ্রমকে নিছক ‘কমেডি’ ভাবলে ভুল হবে।