GST

কোন আতশ কাচে দেখবেন! সার্বিক উন্নয়ন দেখাতে গিয়ে আর্থসামাজিক বিভাজন প্রকট

উন্নয়নের চর্চায় দেখতে হয়, শিক্ষা, পুষ্টির মান, চিকিৎসার অধিকার, বার্ধক্যে বাঁচার জন্য সঞ্চয়ের পরিসর— এক কথায় জীবন যাপনের উপাদানের সহজলভ্যতা।

Advertisement
সুপর্ণ পাঠক
সুপর্ণ পাঠক
শেষ আপডেট: ২৬ অগস্ট ২০২২ ১৯:৫১
আমাদের চোখের সামনেই দুরবস্থার ছবিটা প্রকট।

আমাদের চোখের সামনেই দুরবস্থার ছবিটা প্রকট।

বন্ধন ব্যাঙ্কের সপ্তম প্রতিষ্ঠা দিবসে প্রণব সেন বলছিলেন। গোটা হল স্তব্ধ। ইউপিএ সরকারের আমলে দেশের প্রধান পরিসংখ্যানবিদ তাঁর মূল প্রতিপাদ্যের প্রেক্ষিত তৈরি করছিলেন। বলছিলেন দেশ বড়লোক হওয়া মানেই নাগরিকের স্বাচ্ছন্দ বাড়া নয়। আর দেশে অসংগঠিত ক্ষেত্রের প্রসার দেশের স্বাচ্ছল্য বৃদ্ধির সূচক নয়। বরং উল্টোটাই। অসংগঠিত ক্ষেত্রের প্রসার আসলে পেট চালাতে নাগরিক কতটা মরিয়া তার সূচক। বলছিলেন ইংরাজিতে। তার উপরে অর্থনীতিবিদ। কিন্তু এই প্রসঙ্গে তাঁর বাক্যবন্ধে উৎকণ্ঠায় কোনও রাখঢাক ছিল না।

আসলে আমাদের চোখের সামনেই দুরবস্থার ছবিটা প্রকট। কিন্তু যা হয়। দুরবস্থা আমাদের তাড়া করে ফিরলেও আমরা কিন্তু সেই উট পাখির মতোই বালিতে মাথা গুঁজে থাকব। দুধ, চাল, মুড়ি-সহ সাধারণ খাবারের দাম লাফিয়ে বেড়ে যাওয়া। (এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলে নেওয়া জরুরি। অনেকেই বলেন গোটা বিশ্বে পণ্যের দাম বাড়ছে, তার প্রভাব ভারত এড়াতে পারে না। কিন্তু রিজার্ভ ব্যাঙ্ক তার বার্ষিক পর্যালোচনায় কিন্তু বলে দিয়েছে, দেশের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মূলে বিশ্ববাজারের খুব একটা অবদান নেই।) খরিফ ফলন নিয়ে কম বৃষ্টির কারণে দাম বাড়ার ব্যাপারে আমরা উদ্বিগ্ন। কিন্তু জিএসটি বাড়ার কারণে যে দাম বাড়ল, তা নিয়ে প্রকট আলোচনায় আমরা ততটা উৎসাহী নই। কিন্তু সাধারণের পেটে টান পড়ছেই। তবে আজকের আলোচনার প্রসঙ্গ তা নয়। আজকের আলোচনার বিষয় দেশের ধনী হওয়া এবং গরীবের ভাত কাপড়। এক অর্থে আবার সেই উপেন্দ্রকিশোরকে টেনেই বলি, রাজার ঘরে যে ধন আছে টুনির ঘরে সে ধন কি সত্যিই আছে?

Advertisement

আমরা ভুলে যাই যে উন্নয়ন আর বৃদ্ধির মধ্যে একটা বড় ফারাক আছে। কিছুটা যেন সেই মানুষ ও মানুষ হয়ে ওঠার মধ্যে ফারাকের মতোই। আমরা যখন বলি দেশের গড় জাতীয় উৎপাদনের নিরিখে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দেশ আমরা তখন রাজকোষের শক্তি নিয়ে কথা বলি। আর সেই আয়কেই যখন জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে দি তখন বলি মাথা পিছু আয়ের কথা। কিন্তু সত্যিই কি সেই আয় সাধারণের উপজীব্য হয়ে ওঠে। উত্তরটা কিন্তু না। আমরা তখন মানুষের কথা বলি, মানুষ হয়ে ওঠা বা উন্নয়নের কথা বলি না।

উন্নয়নের আলোচনা করতে গেলে দেখতে হয়, সাধারণের শিক্ষার মান, পুষ্টির মান, চিকিৎসার অধিকার, বার্ধক্যে বাঁচার জন্য সঞ্চয়ের পরিসর— এক কথায় জীবন যাপনের উপাদানের সহজলভ্যতা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল নাগরিকের জীবন যাপনের এই গোটা ছবিকে আমরা এখনও সূচক হিসাবে দেখে উঠতে চাই না। চাইলেও পারি না, কারণ, এই চিত্র কেউ একক উৎসাহে গড়ে তুলতে পারে না। যারা পারে তাদের মধ্যে অন্যতম হল সরকারের পরিসংখ্যান বিভাগ। কারণ, তাদের কাছে যে বিপুল তথ্য সম্ভার আছে তা বেসরকারি ক্ষেত্রে থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু সরকারের এই উদ্যোগ আছে কি না তা আমার জানা নেই। তবে এখনও পর্যন্ত এই জাতীয় কোনও পদক্ষেপ বা সূচকের অস্তিত্ব ভারতে নেই বলেই জানি। তাই আমাদের খণ্ড খণ্ড চিত্র ধরে গোটা ছবিটা আন্দাজ করা ছাড়া উপায় থাকে না। আর সেই খণ্ডচিত্রটাও ভারতের উন্নয়নের মূল ধারা নিয়ে যে সংশয় বিভিন্ন মহলে আলোচিত হয় তারই প্রতিফলন বলে মনে করার কারণ রয়েছে।

যদি সার্বিক উন্নয়ন দেশের আর্থিক উন্নয়নের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলে, তা হলে দেশের বাচ্চারা তাদের পরিবারের কাছ থেকে স্কুল পেরিয়ে আরও একটু এগোনোর সাহায্যটা পাবে। কিন্তু সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমির সমীক্ষা বলছে, ২০১৬-১৭ সালে দেশের কর্মীদের সর্বোচ্চ শিক্ষার নিরিখে উচ্চমাধ্যমিক পাস করা ছিলেন ২৮ শতাংশ, ২০২১-২২-এ সেই অঙ্ক বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮ শতাংশে। একই সময়ে ক্লাস সিক্স আর এইট পাশ কর্মীর অংশিদারী ১৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৯ শতাংশে পৌঁছেছে।

এর অর্থ একাধিক এবং প্রতিটিই একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত এবং কোনওটিই খুব একটা উৎসাহব্যঞ্জক নয়। আমরা শুরু করেছিলাম অসংগঠিত ক্ষেত্রের প্রসার নিয়ে প্রণব সেনের মন্তব্য দিয়ে। এ বার যদি শ্রমশক্তিতে স্কুল বিদ্যাই শেষ প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যা এ রকম কর্মীর সংখ্যা বাড়তে থাকে তার একটা মানে তো পরিষ্কার। আমাদের আর্থসামাজিক পরিবেশ যা তাতে স্কুলের পরে শিক্ষায় আর এগোনোর ক্ষমতা কমছে। পেটের দায়ে রোজগারের জন্য কাজের বাজারে নেমে পড়তে হচ্ছে এই সব কর্মীদের। ঠিক যে কারণে বাড়ছে অসংগঠিত ক্ষেত্রের পরিসর। আমরা যে ভাবেই এই তথ্য পাঠ করতে চাই না কেন, এই পাঠটি কিন্তু এড়ানো সম্ভব নয়। আমাদের দেশে আর্থসামাজিক বিভাজন যে বাড়ছে সেটা না মেনে আমরা যদি চোখ উল্টে বাঁচতে চাই, বাঁচতেই পারি। কিন্তু তাতে সার্বিক উন্নয়নের অঙ্কে পিছিয়ে পড়ার তথ্যটা কি এড়াতে পারব? প্রশ্নটা তো দেয়ালে জ্বলজ্বল করছে। রাজার ঘরে যে ধন আছে টুনির ঘরে কি সত্যিই তা আছে?

আরও পড়ুন
Advertisement