Farmers

নিজের ধান নিজে বেচার পথ

ধান কেনার সরকারি ব্যবস্থায় যাতে ফড়েরা না ঢুকতে পারে, তার জন্য কম তোড়জোড় হয়নি। এখন পুরো ব্যবস্থাটাই ডিজিটাল করা হয়েছে।

Advertisement
অশোক সরকার
শেষ আপডেট: ২৬ অগস্ট ২০২২ ০৮:১৩
মূল ব্যবস্থাটা বদলায়নি।

মূল ব্যবস্থাটা বদলায়নি।

সম্প্রতি খবরে জানা গেল, ঝাড়গ্রামের এক চাষি ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে (১৯৪০ টাকা প্রতি কুইন্টাল) সরকারকে ধান বিক্রি করবেন বলে কিসান মান্ডিতে গিয়ে ফড়েদের কাছে বাধা পান। মান্ডির আধিকারিকদের কাছে অভিযোগ জানালে ওই চাষির বাবাকে কিছু লোক রাতে তুলে নিয়ে যায়। তাঁকে আটকে রেখে সাদা কাগজে সই করিয়ে অভিযোগ প্রত্যাহার করিয়েছে, সেই চাষিকেও বন্দুক দেখিয়ে সাদা কাগজে সই করিয়েছে।

ধান কেনার সরকারি ব্যবস্থায় যাতে ফড়েরা না ঢুকতে পারে, তার জন্য কম তোড়জোড় হয়নি। এখন পুরো ব্যবস্থাটাই ডিজিটাল করা হয়েছে। চাষিকে তাঁর পরিচয়, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, সবই নথিভুক্ত করতে হবে। কিন্তু কাজের বেলায় দেখা যাচ্ছে, ফড়ে চাষিকে তৎক্ষণাৎ কুইন্টাল প্রতি ১২০০-১৪০০ টাকা দিয়ে ধান কিনে নিচ্ছে, আর চাষির নামেই মান্ডিতে রেজিস্ট্রি করিয়ে তা সরকারি দরে বিক্রি করছে। সাধারণত তারা চাষির কাছ থেকে চেক, বা টাকা তোলার স্লিপে আগাম সই করিয়ে রাখে। চাষির অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকলে ফড়ে টাকাটা তুলে নেয়। এই ব্যবস্থা বেশ গেড়ে বসেছে। মন্ত্রী-আমলা বদলেছে, সরকারি বাজারের পরিচালন সমিতি বদলেছে, ধান কেনা ও টাকা পাঠানোর পদ্ধতি-প্রক্রিয়া বার বার বদল হয়েছে, কিন্তু মূল ব্যবস্থাটা বদলায়নি। খাতায়-কলমে সরকার চাষির কাছ থেকেই ধান কিনছে, কিন্তু আসলে কিনছে ফড়েদের কাছ থেকে।

Advertisement

এই দুষ্টচক্র থেকে মুক্তি দিতে পারত চাষিদের নিজেদের সংস্থা (ফার্মার্স প্রোডিউসার্স কোম্পানি)। এই সংস্থা তার সদস্য চাষিদের থেকে যে কোনও ফসল কেনে এবং সরাসরি ক্রেতাকে বিক্রি করে— সে ক্রেতা হতে পারে বড় ব্যবসায়ী, পাইকার, গৃহস্থ, কিংবা সরকার। পশ্চিমবঙ্গে পাঁচশোরও বেশি এমন সংস্থা আছে; তার মধ্যে বেশ কিছু ভালই কাজ করছে। তা হলে কেন তারা সরকারকে ধান বিক্রিতে আরও সক্রিয় হচ্ছে না?

কথাবার্তা বলে জানা যাচ্ছে, সেই পথ বহু নিয়মবিধিতে এমন কঠিন করে বাঁধা হয়েছে যে, পেরিয়ে যাওয়াই কঠিন। প্রথমে এই সংস্থাগুলিকে অত্যাবশ্যক পণ্য সরবরাহ নিগম বা বেনফেড-এর কাছে নথিভুক্ত হতে হবে। তার জন্য চাই ব্লক ও জেলা স্তরের কৃষি আধিকারিকদের সুপারিশ। জেলা থেকে সংস্থার পরিদর্শন হয়ে সেই কাগজ যাবে রাজ্য খাদ্য সরবরাহ বিভাগে, সেখান থেকে তাদের অনুমোদন-সহ যাবে বেনফেডে। তারা নথিভুক্ত করলে তবে চাষি সংস্থা পাবে সরকারি কেনাকাটার ওয়েবসাইটে ঢোকার ‘পাসওয়ার্ড’। এর পরে কাজের পালা ধান কেনার মরসুমে। ওই ওয়েবসাইটে ঢুকে ধান বিক্রির অনুরোধ করতে হবে। সঙ্গে লাগবে একগুচ্ছ কাগজ— বিক্রয়ে ইচ্ছুক চাষিদের এবং ক্রেতা চালকলের বিশদ তথ্য। সেগুলি ওয়েবসাইটে তুলতে হবে, তার পর আসবে ধানের বরাত— কত ধান নেবে সরকার। ধান কেনার ক্যাম্প কোথায় কবে বসছে, দেখে আগে থেকে জায়গা ‘বুক’ করতে হবে। নির্দিষ্ট দিনে ক্যাম্পে ধান নিয়ে গেলে চালকলের কর্মীরা এসে ওজন করে ধান নিয়ে যাবেন।

সমস্যা হল, পুরো ব্যবস্থাটাই ব্লক থেকে রাজ্য স্তর পর্যন্ত পরিচিতি ও সম্পর্ক তৈরির উপর নির্ভরশীল। এক অভিজ্ঞ সমাজকর্মী জানালেন যে, ২০১৩ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত ২০টি চাষি সংস্থা তৈরিতে সহায়তা করেছে তাঁর সংস্থা। তার মধ্যে ১৫টি নথিভুক্ত হয়ে ধান বিক্রির সুযোগ পেয়েছে। প্রথম বার মাত্র হাজার কুইন্টাল করে বরাদ্দ এসেছে এক-একটা চাষি সংস্থার নামে। একটি সংস্থার অন্তত ৫০০ সদস্য, তাই মাথাপিছু দশ কুইন্টাল করে একশো জন পর্যন্ত চাষি ধান বিক্রি করতে পারেন। তবে প্রথম বার হাজার কুইন্টাল বিক্রির পর চাষি সংস্থাগুলি দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বার তিন হাজার কুইন্টাল বিক্রির অনুমোদন পেয়েছিল। তাতেও সব চাষি ধান বিক্রির সুযোগ পাননি। চাষি সংস্থা উৎসাহ ভাতা পেয়েছে কুইন্টাল প্রতি তেত্রিশ টাকা, আর চাষিরা তিন-চার দিনের মধ্যে অ্যাকাউন্টে সরকারি দরে টাকা পাচ্ছেন। কুইন্টাল প্রতি ৩০০-৪০০ টাকা বেশি পেয়ে তাঁরা অবশ্যই খুশি।

চাষিদের সমবায়, এবং গ্রামের মেয়েদের স্বনির্ভর দলের মাধ্যমে বিক্রি করলেও ফড়েদের অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে না, কারণ সমবায় বা গোষ্ঠীর সদস্যরা প্রকৃত চাষিকে চিহ্নিত করে রাখে, নির্দিষ্ট দিনে শিবির থেকে তাদের ধানই কিনে নিয়ে যায় চাল কল। স্বনির্ভর গোষ্ঠী আর চাষি সংস্থা মিলিয়ে মোট ২১৩৯টি সংস্থা ধান বিক্রির জন্য নথিভুক্ত আছে। কার থেকে সরকার কত ধান কিনছে, তার তথ্য সরকারি ওয়েবসাইটে নেই। যদি ধরা যায়, ওই ২১৩৯টি সংস্থা প্রত্যেকে সারা বছরে ৫০০০ কুইন্টাল করে ধান বিক্রি করেছে, তা হলে তারা মোট ১০ লক্ষ ৭০ হাজার টন ধান বিক্রি করতে পেরেছে, যা গত বছর সরকারি ক্রয়ের (৪৭ লক্ষ ৭৫ হাজার টন) পাঁচ ভাগের এক ভাগ। বাকি চার ভাগ কেনা হয়েছে সরাসরি মান্ডি থেকে, আর সেখানেই চলে ফড়েদের কারবার।

গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা দেখাচ্ছে, মান্ডিতে ফড়েদের আধিপত্য এড়াতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। কোথাও কোথাও কিছু ধরপাকড় হয়েছে, কিন্তু তা দেখনদারি। পুকুর চুরির মতো, চাষির সহায়তার জন্য বরাদ্দ বিপুল টাকার অধিকাংশ চলে যাচ্ছে দলীয় প্রশ্রয়প্রাপ্ত ফড়েদের হাতে। তাই চাষির বঞ্চনা আর হয়রানি বন্ধ করতে হলে চাষিদের নিজস্ব সংগঠনগুলি থেকে ধান কেনার পরিমাণ বাড়াতে হবে। তাদের নথিভুক্তি সহজ করতে হবে, ধান কেনায় সব রকম সহায়তা দিতে হবে। না হলে মান্ডিতে গিয়ে ধান বিক্রির দাবি করলে বার বার মার খেয়ে ফিরতে হবে চাষিকে।

আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন
Advertisement