Social Media

Fear of missing out: নেটমাধ্যম আমাকে ‘ইউজার’ ভাবে, আমি ওটাই বাস্তব ভাবি, আর ক্রমেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি

প্রত্যেকের নেটমাধ্যমের ঘটনাধারার ক্রমপর্যায় সম্পূর্ণ আলাদা। একই সময়ে সম্পূর্ণ পৃথক টাইমলাইন। আপনি, আমি এবং সবাই ‘ইউজার’ মানে ব্যবহারকারী।

Advertisement
ঋকসুন্দর বন্দ্যোপাধ্যায়
ঋকসুন্দর বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৯ জুন ২০২২ ১৫:০৮

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

অনেক দিন ধরেই পরিকল্পনা করা হচ্ছিল। একসঙ্গে একটা দিন সবাই মিলে দেখা করা হবে। আড্ডা হবে। সেই কলেজজীবন শেষ হওয়ার পর কথাবার্তা হোক বা আড্ডা, সে তো মূলত হোয়াটস্‌অ্যাপ গ্রুপেই। মুখোমুখি দেখাসাক্ষাৎ হয়নি অনেক দিন।

শেষে একটা দিন ঠিক হল। সকলে একটা জায়গায় জড়োও হলাম। কিন্তু আড্ডা কোথায়! মাঝেমধ্যে টুকটাক কথা হচ্ছে বটে। কিন্তু সকলের চোখ এবং হাত মোবাইলে! আঙুল স্ক্রিনের গায়ে ওঠানামা করছে। অন্য দিন হোয়াটস্‌অ্যাপ গ্রুপের আড্ডায় সকলকে কেমন উদগ্রীব দেখায়। কিন্তু মুখোমুখি হয়ে এখন কেন সকলে মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত! কথা চলছে অন্য গ্রুপে। অথবা নানা রকম নোটিফিকেশনে ক্লিক! কথা বলার ফাঁকে মোবাইলের স্ক্রিনটাইম বেড়ে যায়।

Advertisement

এমন ছবি কিন্তু আমাদের খুবই পরিচিত। চারপাশে তো এমন দৃশ্য অহরহ দেখছি। বন্ধুদের আড্ডা চলছে। চোখ মোবাইলে। আমাদের অনেকেরই সারা দিনে মোবাইল ব্যবহার করার সময়সীমা ৭-৮ ঘণ্টা! কারও কারও তো ১২ ঘণ্টাও পেরিয়ে যায়। অর্থাৎ সারা দিনে ঘুম আর কাজের সময় বাদ দিয়ে সিংহভাগ সময়টাই মোবাইলকে দেওয়া।

প্রতীকী ছবি

সঙ্গে মোবাইল না-থাকা, পরিভাষায় যাকে ‘নোমোফোবিয়া’ বলে, তা কিন্তু আধুনিকতার অর্জন। কিছু ক্ষণের জন্য মোবাইলে ইন্টারনেট না-থাকলে ‘কী জানি কী হয়ে গেল’, ‘জানতে পারলাম না’ বলে অস্বস্তিতে ভুগতে থাকি। চার পাশের কোনও কিছুতেই যেন ঠিকমতো মনঃসংযোগ করে ওঠা যাচ্ছে না। মোবাইল ছাড়া একটা মুহূর্তও চলছে না। নোটিফিকেশনের ‘টুং’ শব্দ এল মানেই মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখতেই হবে। নিউজ ফিড আর লিঙ্কে ক্লিক করার জন্য হাত নিশপিশ করবেই। না করলেই মনে হচ্ছে, বড় কিছু বোধহয় অজানা থেকে গেল!

হারিয়ে যাওয়ার যে ভয়, পরিভাষায় যাকে ‘ফোমো’ (ফিয়ার অব মিসিং আউট) বলে, তার শিকড় কিন্তু মানবমনের গভীরে অনেক আগে থেকেই প্রোথিত। বর্তমানে এর অভিঘাত আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। মূলত নেটমাধ্যমের দৌলতে। আড্ডার কোনও ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা নেই এখন। মহাদেশের পর মহাদেশ থেকে একসঙ্গে আড্ডায় জুড়ে যাওয়া যায়। এখন তো পরিবার, কর্মক্ষেত্র, পাড়া— পৃথক পৃথক বন্ধুদের একাধিক গ্রুপ এবং সেখানে অবাধ যাতায়াত। সব সময় যে খুব কথা বলতে হচ্ছে এমন নয়। আসলে সবটুকুর উপর একটা নজর রাখার তাগিদ তো আছেই। চারপাশে ছড়িয়ে থাকা উন্মুক্ত পর্বতরাশির মাঝখানে বেড়াতে গিয়ে নেটওয়ার্কের কারণে যদি নেটমাধ্যমে ছবি দিতে না পারা যায়, তা হলে মনে অস্বস্তি। ছবি দেওয়া হল। কিন্তু তার পর কে কে তাতে কী ‘রিঅ্যাক্ট’ করে গেল, তা নিয়ে একটানা সজাগ থাকা। তার পরে আবার নতুন আপডেট দেওয়ার তাগিদ। এর মাঝেই অন্য বন্ধুদের বিভিন্ন পোস্ট বা মেসেজ দেখে তাদের সঙ্গেও একটা যোগাযোগ রেখে দেওয়া। যাতে বেড়াতে গিয়েও কিছু হারিয়ে যাওয়ার বোধ তৈরি না হয়। এ ভাবে যোগসূত্র রাখতে চাওয়ার চেষ্টা আসলে ব্যক্তি মানুষটির এক রকম ভাবে আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া।

মোবাইলে যে কোনও অ্যাপ ইনস্টল করার সময় পাতার পর পাতা ‘শর্তাবলি’ পড়ে দেখা বা বোঝার ধৈর্য বা সময় আমাদের নেই। আর সেই সুযোগ নিয়েই দিনরাত একটা নজরদারির আওতায় আমাদের নিয়ে চলে আসছে একাধিক বাণিজ্যিক সংস্থা। আমাদের গতিবিধি সারা ক্ষণ অনুসরণ করছে কেউ। এই বোধের মধ্যেই যে অস্বস্তি লুকিয়ে থাকে, তা আরও বেশি করে আমার নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। খাওয়া, পরা, গোপন সার্চ হিস্ট্রি— সব কিছুই তাদের নজরদারির আওতায়। সেই ‘অ্যালগরিদম’-এর আওতায় পড়ে আমাদের প্রত্যেকের কাছে আসতে থাকে বিশেষ বিশেষ বিজ্ঞাপন, সুনির্দিষ্ট খবরের লিঙ্ক, কোনও সাম্প্রতিক ভিডিয়ো। আমার, আপনার গতিবিধির খবর তথা তথ্য জোগাড় করে সিলিকন ভ্যালির বড় বড় বাণিজ্যিক সংস্থাগুলো তৈরি করে ফেলছে তাদের লক্ষ্যে থাকা খদ্দেরদের তালিকা। সেই ‘লক্ষ্য’ অনুসারে বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে বিজ্ঞাপনের মডেল। এই নিটোল বুনোনে আমরা সবাই আসলে নজরদারির শিকার।

প্রতীকী ছবি

আসলে নেটমাধ্যমে জুড়ে থাকা সকলের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিন্যাস এক রকমের হয় না। তাই মূল্যবান সামগ্রী কিনে তা অন্যদের মাঝে শেয়ার করা অথবা ঝাঁ চকচকে রেস্তরাঁয় অন্যদের ঘনঘন খেতে যেতে দেখার ছবি পোস্ট হতে দেখলে একই গ্রুপে থাকা মানুষদের যোগসূত্রের মাঝেই জন্ম নেয় বিচ্ছিন্নতাবোধ। আপাত ভাবে এটা ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতা মনে হতে পারে। কিন্তু এটা আসলে সমাজের সঙ্গে ব্যক্তির দ্বন্দ্ব থেকে ব্যক্তিমনে তৈরি হওয়া বিচ্ছিন্নতাবোধ।

দার্শনিকদের অনেকে মনে করেন, মানুষের অস্তিত্বের সঙ্কট থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্ম হয়। আধুনিক প্রযুক্তিশাসিত নেটমাধ্যমের যুগে এই অস্তিত্বের সঙ্কট আরও সূক্ষ্ম এবং সুদূরপ্রসারী। নিজেরই আর একটা ফেক প্রোফাইল বানিয়ে প্রথমে নিজেকেই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে বাকিদের পাঠানো, যাতে ফেক প্রোফাইলটা আরও বিশ্বাসযোগ্য হয়। এ-ও নিজের অস্তিত্বকে বিপন্ন করা। নিজের একটা অন্য পরত চাই। যেখানে আমার ভিতর থাকা ‘অন্য আমি’ তার মতন করে কথা বলতে পারে।

এ তো আসলে বিচ্ছিন্নতাই। ভাবতে গেলে শিউরে উঠতে হবেই আপনাকে। আপনার বাড়ির প্রত্যেক সদস্য, তাঁদের প্রত্যেকের মোবাইল, প্রত্যেকের নেটমাধ্যমের ঘটনাধারার ক্রমপর্যায় সম্পূর্ণ আলাদা। এক ছাদের তলায়, একই সময় সম্পূর্ণ পৃথক টাইমলাইন। আপনি, আমি এবং এরা সবাই ‘ইউজার’ অর্থাৎ ব্যবহারকারী।

অথচ আমি, আপনি নিজেকে ব্যবহারকারী ভাবি না। ব্যবহারের ঊর্ধ্বে উঠে, ওটাকেই বাস্তব বলে মনে করে। বাস্তবকে ফেলে দিয়ে ওটাকেই ভেবে ফেলি বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। প্রয়োজন মতো ব্যবহার করলে, আর নিজেকে ব্যবহারকারী ভাবলে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না বোধহয়। এটা এ বার ভাবার সময় এসেছে আমাদের।

(লেখক গবেষক। মতামত ব্যক্তিগত)

আরও পড়ুন
Advertisement