Cattle Smuggling

পাচার বন্ধ করতে চাইলে

আমাদের দেশ থেকে ভিনদেশে গবাদি পশুর রফতানির নিয়ম যদি সরকার সরলীকরণ করত, তা হলে এই বিশাল পাচারচক্র গড়ে উঠত না।

Advertisement
অঙ্কুশ সাহা
শেষ আপডেট: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৫:৫৫
গরু পাচার একটি বড় সমস্যা।

গরু পাচার একটি বড় সমস্যা।

পশ্চিমবঙ্গ থেকে কী ভাবে, কোন পথে গরু পাচার হত, তা নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। একটা কথাই কেবল শোনা যাচ্ছে না— বৈধ ভাবে গরু রফতানি হচ্ছে না কেন? অন্য গৃহপালিত জীবিত পশু রফতানির ক্ষেত্রেই বা নিয়মকানুন কী? সরকারি নীতিতে দেখা গেল যে, গৃহপালিত জীবন্ত পশু রফতানি করা সম্ভব, কিন্তু যে সব জীব ‘নিয়ন্ত্রিত’ বিভাগের আওতাধীন, সেগুলি রফতানি করতে গেলে ‘ডিরেক্টর জেনারেল অব ফরেন ট্রেড’-এর থেকে একটা অনুমতি নিতে হয়। কাজটি আদৌ সহজসাধ্য নয়। তার জন্য এই সব কাগজের প্রয়োজন— ১) যে খামারের গরু সংগ্রহ করা হবে, সেই খামারের সম্মতিপত্র; ২) রাজ্য সরকারের পশুপালন দফতর থেকে সম্মতিপত্র; ৩) জাতীয় বায়ো ডাইভার্সিটি অথরিটি-র (চেন্নাই) সম্মতিপত্র; ৪) যে পশু রফতানি করা হবে, তার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ ও গুণমানের বিবৃতি; ৫) আমদানিকারীর চিঠি, যাতে এই পশু আমদানির কারণ জানাতে হবে; ৬) আমদানিকারীর দেশ থেকেও চিঠিতে একটি যুক্তি দিতে হবে, প্রাণীটি কেন আমদানি করা হবে; এবং ৭) জীবিত প্রাণীর পরিবর্তে সেই প্রাণীর বীর্য এবং ভ্রূণ থেকে জার্মপ্লাজ়মা রফতানি করা হবে না, এই বিষয়ে হলফনামা জমা দিতে হবে। এই সাতটি কাগজ ওয়েবসাইটে আপলোড করার পরে সরকারের ধার্য-করা ফি জমা দিতে হয়। এর পরে আবেদন গৃহীত হতে পারে, আবার বাতিলও হতে পারে।

কোনও জীবন্ত প্রাণী রফতানি করতে গেলে তার স্বাস্থ্যের সার্টিফিকেট প্রয়োজন। এ দেশে এই সার্টিফিকেট প্রদান করে ‘অ্যানিম্যাল কোয়রান্টিন অ্যান্ড সার্টিফিকেশন’ দফতর। এটি ভারত সরকারের পশুপালন বিভাগের অধীনে। কলকাতার বিভাগীয় দফতরে এক জন উচ্চপদস্থ আধিকারিকের সঙ্গে এই বিষয়ে যোগাযোগ করলে তিনি জানান যে, কলকাতা থেকে ও সব রফতানি হয় না, গবাদি পশুর কোনও ভাল খামার এই রাজ্যে নেই, রাজ্য সরকারের কাছে ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’ নিতে হবে, যা নাকি খুবই কঠিন কাজ। রফতানির আগে সেই প্রাণীগুলোকে আবার ওই দফতরের অফিসের শেডে এনে দু’দিন রাখতে হবে, এবং আরও অনেক রকম পরীক্ষা করাতে হবে। কেন্দ্রীয় কর্তাদের যোগাযোগ করেও কোনও সদুত্তর পাইনি।

Advertisement

রাজ্য সরকারের পশুপালন দফতরেও দেখা গেল ঠিক একই অবস্থা। উদ্যানপালনের দফতরের বেশির ভাগ আধিকারিক তাজা আনাজ রফতানির নিয়মকানুন সম্পর্কে অবগত নন, ঠিক তেমনই পশুপালন বিভাগের অফিসারেরাও জানেন না যে, গবাদি পশু রফতানি করতে গেলে তাঁদের ঠিক কী শংসাপত্র দিতে হবে। অভিজ্ঞতা বলছে যে, যাঁরা রফতানি করতে চান, তাঁদেরই বলা হয় সার্টিফিকেটের একটা ‘ফর্ম্যাট’ তৈরি করতে।

আমাদের দেশ থেকে ভিনদেশে গবাদি পশুর রফতানির নিয়ম যদি সরকার সরলীকরণ করত, তা হলে এই বিশাল পাচারচক্র গড়ে উঠত না। বৈদেশিক বাণিজ্য বাড়ত, গরিব কৃষক গরু-ছাগলের ভাল দাম পেতেন। লাল ফিতের ফাঁস কিছু নেতা-আধিকারিকের পকেট ভরল কেবল। সংবাদে প্রকাশ, বিএসএফ গরু প্রতি ২০০০ টাকা নিত, আর কাস্টমস নিত ৫০০ টাকা। এটা আশ্চর্য নয়— বৈধ রফতানির ক্ষেত্রেও যে ঘুষ দিতে হয়, অভিজ্ঞ জন মাত্রেই জানেন। কৃষিজপণ্য রফতানির জন্য যে শংসাপত্র (ফাইটো স্যানিটারি সার্টিফিকেট) প্রয়োজন, তার জন্যও আধিকারিকদের একাংশকে ঘুষ দিতে হয় বলে অভিযোগ। দেশ জুড়ে এই জাল ছড়িয়ে আছে।

বৈধ রফতানির নিয়মে যাঁরা বজ্র আঁটুনি বাঁধেন, এবং উদ্যোগীদের ক্রমাগত নিরুৎসাহ করেন, তাঁরাই কি কার্যত গরু পাচারে উৎসাহ দিচ্ছেন না? ব্যবসার নিয়ম অনুযায়ী কোনও দিন বাজার ফাঁকা থাকে না, কোনও না কোনও ভাবে ঘাটতি পূরণ হয়। আইনি রফতানিকে জটিল করে কার্যত বেআইনি পাচারকে রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকার উৎসাহ দিচ্ছে। ফলে গরুর চোরাকারবার হবে, এ প্রায় অবধারিত। জীবিত গৃহপালিত পশু রফতানিতে নিয়মকানুনের যে দুরূহ বাধা, তাকে এক অর্থে নিষেধাজ্ঞাই বলা চলে। কাণ্ডজ্ঞানই বলে যে, খোলা বাজার না থাকলে কালো বাজার তৈরি হবেই। তাতে কিন্তু সরকারেরও ক্ষতি— অবৈধ পাচারকারীদের থেকে কোনও কর বা শুল্ক রাজকোষে ঢোকে না। ফলে, এই ‘নিষেধাজ্ঞা’টি নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা জরুরি।

আমাদের রাজ্যে চাকরি নেই, সরকারি চাকরি নেতারা বিক্রি করছেন বলে অভিযোগ। যে সব ছেলেমেয়ে লেখাপড়া করছে, তারা চাকরি না পেয়ে যে ব্যবসা করবে, তারও উপায় নেই। তা হলে তারা আগামী দিনে কী করবে? পেট চালাতে গ্রামীণ যুবকদের একাংশ পাচারকারীদের অন্তর্গত হয়ে কাজ করবে, তার আশঙ্কা যথেষ্ট। তাই বৈধ ব্যবসার রাস্তা খুলে দিয়ে রোজগারের ক্ষেত্র প্রসারিত করুক কেন্দ্র ও রাজ্যের সরকার।

আরও পড়ুন
Advertisement