খনি ও খনিজ সম্পদে কর চাপানোর ‘ক্ষমতা’ কার হাতে
Tax

কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কে মোড়?

দেখে মনে হতে পারে এ বেশ ভাল অর্থনৈতিক ন্যায্যতা— এক দিকে ঝুঁকে থাকা অর্থনৈতিক যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় খানিক সঙ্গতি এল। কিন্তু এর ফলে সাধারণ মানুষের উপর শেষ পর্যন্ত কোন চাপ পড়ল, সেটাও দেখা দরকার।

Advertisement
শমীক সেন
শেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০২৪ ০৪:১৫

গত ২৫ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের নয় বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ ৮-১ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জানাল যে, রাজ্য তালিকার ৪৯ ও ৫০ নম্বর এন্ট্রি মোতাবেক রাজ্য সরকারগুলির ক্ষমতা আছে খনি ও খনিজ সম্পদে কর বসানোর। প্রধান বিচারপতি-সহ ৮ বিচারপতির মতামত এমনটাই। বিচারপতি বি ভি নাগরত্ন কেবল ভিন্ন মত পোষণ করেন। এই রায়ে কেন্দ্র-রাজ্য যুক্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের, বিশেষ করে অর্থনৈতিক যুক্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের এক নতুন দিক খুলে গেল বলা চলে। পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যের ক্ষেত্রে এর অযুত সম্ভাবনা, কারণ এ রাজ্যে খনিজ সম্পদ আছে অনেক, কিন্তু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দু’দিক থেকেই রাজ্যটির দর কষাকষির ক্ষমতা কম।

Advertisement

এই রায়ের তাৎপর্য বুঝতে কেন্দ্র ও রাজ্য তালিকার কিছু এন্ট্রির দিকে একটু নজর ফেরানো যাক। এ তো জানা-ই যে, কেন্দ্রীয় তালিকাভুক্ত বিষয়গুলির ক্ষেত্রে আইন করার পূর্ণ ক্ষমতা আছে সংসদের, আর একই ভাবে রাজ্য বিধানসভাগুলির সমান ক্ষমতা রাজ্য তালিকাভুক্ত বিষয়ে আইন প্রণয়নের। রাজ্য তালিকার ৫০ নম্বর এন্ট্রি অনুযায়ী রাজ্য সরকার খনিজ সম্পদে কর বসাতে পারে, ‘খনিজ উন্নয়ন বিষয়ে সংসদ-আরোপিত আইনি নিয়ন্ত্রণের শর্তসাপেক্ষে’। সংসদ এই নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে কেন্দ্রীয় তালিকার ৫৪ নম্বর এন্ট্রিমাফিক। সেখানে লেখা আছে: খনি, খনিজ সম্পদ ও খনি সংক্রান্ত উন্নয়নের ক্ষেত্রে কেন্দ্রের অধীনে সংসদ আইন অনুযায়ী এবং জনস্বার্থে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

এই দু’টি এন্ট্রির মধ্যে একটা সংঘাত চোখে পড়ছে। এক দিকে ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যের মতে, রাজ্য তালিকার ৫০ নম্বর এন্ট্রি অনুযায়ী রাজ্যগুলির বিশেষ ক্ষমতা আছে খনিজ সম্পদের উপর কর বসানোর; অন্য দিকে কেন্দ্রীয় সরকারের যুক্তি: রাজ্যের এই ক্ষমতা সীমাবদ্ধ ‘মাইনস অ্যান্ড মিনারেলস (ডেভলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেশন) অ্যাক্ট ১৯৫৭’ দ্বারা, যে ধরনের আইনের কথা বলা আছে কেন্দ্র তালিকার ৫৪ নম্বর এন্ট্রিতে; যে ধরনের আইনবলে কেন্দ্রীয় সরকার নির্ধারণ করতে পারে, খনির ইজারাদার (লিজ়হোল্ডার) জমির মালিককে কত টাকা রয়্যালটি হিসাবে দেবে।

এ প্রসঙ্গে আদালতের যে অমীমাংসিত বা বিতর্কিত প্রশ্নটির উত্তর দেওয়ার ব্যাপার ছিল তা আসলে এই: রয়্যালটিকে কি আদৌ কর বলে বিবেচনা করা যাবে? এর উত্তর দিতে গিয়ে আদালতকে পঁয়ত্রিশ বছর পুরনো এক বিচার সংক্রান্ত পূর্বদৃষ্টান্তকে ফিরে দেখতে হয়েছে। এ এমন এক পূর্বদৃষ্টান্ত যার আইনগত বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টেরই অন্য এক বেঞ্চ প্রশ্ন তুলেছিল। কিন্তু যেটা আরও গুরুত্বপূর্ণ তা হল, এই প্রশ্নের উত্তরে আরও বেশ কয়েকটি অর্থনৈতিক জটিলতার জরুরি প্রশ্ন উঠে আসে।

রয়্যালটিকে যদি সত্যিই কর হিসাবে গণ্য করতে হয়, তা হলে ১৯৫৭-র এমএমডিআর আইন অনুযায়ী এ ধরনের কর বিবেচনা করার ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারেরই হাতে। তার অর্থ পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যের লোকসান— তার খনিজ সম্পদ আছে অনেক, কিন্তু তাতে কর চাপানোর ক্ষমতা হাতবদল হয়ে চলে যাচ্ছে কেন্দ্রের হাতে। অন্য দিকে, রয়্যালটিকে যদি কর হিসাবে বিবেচনা করা না হয়, তা হলে তাতে কর চাপানোর অধিকার নিজে থেকেই চলে আসে রাজ্য সরকারগুলির হাতে।

দেখে মনে হতে পারে এ বেশ ভাল অর্থনৈতিক ন্যায্যতা— এক দিকে ঝুঁকে থাকা অর্থনৈতিক যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় খানিক সঙ্গতি এল। কিন্তু এর ফলে সাধারণ মানুষের উপর শেষ পর্যন্ত কোন চাপ পড়ল, সেটাও দেখা দরকার। তাঁদের এখন কর দিতে হচ্ছে রাজ্যকে, আবার রয়্যালটি দিতে হচ্ছে কেন্দ্রকে। মনে রাখতে হবে, এমনিতেই মানুষ যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যুৎ বিল দিয়ে থাকেন, যখন খনিজ সম্পদকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়।

আদালতের রায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারক মত দিয়েছেন: ৫৪ নম্বর এন্ট্রি অনুযায়ী কেন্দ্রের শুধুমাত্র খনি ও খনিজের ‘নিয়ন্ত্রণ’-এর ক্ষমতা আছে, কর বসানোর নয়— সেই ক্ষমতা একান্ত ভাবেই রাজ্য তালিকার অধীনে রাজ্য সরকারগুলির উপর ন্যস্ত। আদালত ‘রয়্যালটি’ ও ‘কর’কে আলাদা করে বুঝিয়েছে: রয়্যালটি হল চুক্তিমাফিক পেমেন্ট, আর কর হল সার্বভৌমত্বের সহজাত ও অপরিহার্য এক বৈশিষ্ট্য (এসেনশিয়াল অ্যান্ড ইনহেরেন্ট অ্যাট্রিবিউট অব সভরেনটি), যার মাধ্যমে সরকারি ব্যয়ের জন্য রাজস্ব আদায় করা হয়।

এখানে নজর করার মতো একটা ব্যাপার হল, বিচারকদের অধিকাংশ তাঁদের বক্তব্যের সমর্থনে ন্যায্যতার একটি যুক্তি উত্থাপন করেছেন। বলেছেন ঝাড়খণ্ড, ছত্তীসগঢ় ও ওড়িশার মতো রাজ্যের ‘সম্পদ অভিশাপ’ (রিসোর্স কার্স)-এর কথা: খনিজ সম্পদে অত্যন্ত সমৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও এরা সারা দেশে সর্বনিম্ন মাথাপিছু আয়ের রাজ্যগুলির অন্যতম। কেন্দ্র-রাজ্য অর্থনৈতিক যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতে এই উদাহরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

যে বিচারক ভিন্ন মত পোষণ করেছেন, তিনিও ন্যায্যতার যুক্তি দিয়েছেন। তাঁর পর্যবেক্ষণ, এমএমডিআর আইন অনুসারে রয়্যালটি ছিল এক ধরনের ‘বাধ্যতামূলক আদায়’ (কম্পালসরি এগজ়্যাকশন), সুতরাং বলা যেতে পারে তা ছিল এক প্রকার কর-ও। আরও গুরুত্বপূর্ণ: এন্ট্রি ৪৯-এর অধীনে রাজ্যগুলিকে কর নেওয়ার অনুমতি দিলে আদতে তা হবে রাজ্যগুলিকে এমন এক দৌড়ে শামিল করা, যাতে শেষ অবধি খনিজ-সমৃদ্ধ রাজ্য ও খনিজ-দুর্বল রাজ্যগুলিকে পরস্পর লড়িয়ে দেওয়া হবে। তাতে খনিজ ও তার শিল্পজাত উৎপাদনের দাম চড়ে যাবে; গ্রাহককে গুনতে হবে বিদ্যুতের মাসুলও।

যে প্রশ্নটা মনোযোগ সহকারে বিবেচনা করা দরকার তা হল, এই রায় কি ভারতকে আরও যুক্তরাষ্ট্রীয় করে তুলবে— যেমনটা দেখানো হচ্ছে মূলধারার সংবাদমাধ্যমের বয়ানে? তা কি সত্যিই ‘উৎপাদক রাজ্য’ ও ‘উপভোক্তা রাজ্য’-এর মধ্যে অর্থনৈতিক অসঙ্গতি মুছে দিতে পারবে? আমার ব্যক্তিগত মত, এই রায়ের প্রভাব সীমিতই থাকবে। যা মনে হচ্ছে, সংসদ হয় এমএমডিআর আইন সংশোধন করবে, নয়তো রাজ্যগুলির ট্যাক্স বসানোর ক্ষমতা বন্ধ করতে বা তাকে গণ্ডিবদ্ধ করতে নতুন কোনও আইন আনবে।

এই রায়কে তাই যুগান্তকারী ভাবার কারণ আছে বলে মনে হয় না। তবে তা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সময়ের এক জরুরি সন্ধিক্ষণে এই রায় এল। লোকসভা নির্বাচনের পরে কেন্দ্রীয় সরকার এখন একটু হলেও দুর্বল, অন্য ছোট আঞ্চলিক দলগুলোর উপর নিজেদের অস্তিত্বের প্রয়োজনেই একটু বেশি মাত্রায় নির্ভরশীল। শেষ কথা ভবিষ্যৎই বলবে।

আরও পড়ুন
Advertisement