Tourist Destination

যে পথ যেত পশ্চিমে

মধুপুর, দেওঘর, জসিডি, কোডারমা, শিমুলতলা, ঝাঁঝা, ম্যাকলাস্কিগঞ্জ, গিরিডি, হাজারিবাগ, রাঁচী— বাংলা থেকে যাওয়া মানুষের চোখে মায়াঞ্জন পরিয়ে দিত।

Advertisement
স্বাতী ঘোষ
শেষ আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০২৫ ০৫:১৮

ছোটনাগপুরে বা সাঁওতাল পরগনায় (ভালবেসে যাকে এক সময় ‘পশ্চিম’-ও বলা হত) ভ্রমণ একটা বৃহৎ সময় ধরে বাঙালিদের শুধুমাত্র প্রিয় ছিল না, বেশ গৌরবের ব্যাপার ছিল। একাল যখন শুরু হল স্মৃতিকথায় পুণ্যলতা চক্রবর্তী লিখেছেন, “ছোটনাগপুরের অনেক অংশই ছিল বাঙালিপ্রধান। অনেক শিক্ষিত, উদারমনা লোক, স্বাস্থ্যলাভের জন্য কিংবা বৃদ্ধ বয়সে নিরিবিলি শান্তিতে দিন কাটাবার আশায় রাঁচী, হাজারিবাগ, গিরিডি প্রভৃতি জায়গায় বাড়ি করেছিলেন। তা ছাড়া এই সব সুন্দর স্বাস্থ্যকর স্থানে প্রতি বৎসর নানা দিক থেকে অনেক লোক বায়ু-পরিবর্তনের জন্য আসেন। বৎসরের মধ্যে কয়েকটি মাস এই ছোটশহরগুলিকে সজীব ও আনন্দমুখর করে তোলেন এই নবাগতের দল।”

Advertisement

মধুপুর, দেওঘর, জসিডি, কোডারমা, শিমুলতলা, ঝাঁঝা, ম্যাকলাস্কিগঞ্জ, গিরিডি, হাজারিবাগ, রাঁচী— বাংলা থেকে যাওয়া মানুষের চোখে মায়াঞ্জন পরিয়ে দিত। সুন্দর সব বাংলো, খোলা ছাদ, বারান্দায় দেদার রোদ্দুর, বাগানে ফুল-আম-জাম-দেবদারু-ইউক্যালিপ্টাসের সমারোহ, আর উঠোনের কুয়ো থেকে লাট্টা খাম্বার মধুর শব্দ। কাছে-দূরে হালকা পর্বতশ্রেণি, নীলচে-ধূসর অরণ্যরেখা আর দিগন্তবিস্তৃত মাঠ। যত ক্ষণে দিনের আলো ম্লান হয়ে টিয়াপাখির বাসায় হারিয়ে যেত, তত ক্ষণে স্বাস্থ্যান্বেষী বাঙালি সপরিবারে আলপথে স্টেশন ঘুরে ঘরে ফিরতেন। অতি অল্প দামে মিলত সতেজ আনাজ, মাছ-মাংস। কুয়োর জল দারুণ ক্ষুধাবর্ধক। এ ছাড়াও ছিল এ বাড়ি ও বাড়ি আলাপচারিতা, সন্ধ্যায় স্বল্প আলোতে আড্ডা-তাস-লুডো, গান-চা-মুচমুচে ভাজাভুজি। আর কী চাই?

এই সব বাড়ি কিন্তু সারা বছর প্রায় খালিই পড়ে থাকত। হাজারিবাগে নাকি কলকাতার একটি অতি বনেদি পরিবার রাস্তার এক দিকে প্রাসাদতুল্যবাড়ি বানিয়ে, অন্য দিকে গোটা শালবন কিনে ফেলেছিল। পরিবারের একটি অসুস্থ ছেলেকে চেঞ্জে নিয়ে যাবে বলে।

কী করে সেই ‘পশ্চিম’ অতীত হয়ে গেল? কোনও ঝোঁকই চিরস্থায়ী নয়। তবু বাঙালির ভ্রমণের এই অতি পছন্দসই ধারাটির আমূল পরিবর্তনের কারণ কী, সে কৌতূহল থেকে যায়। সেই কারণ বোধ হয় অনেকগুলি।

সাঁওতাল পরগনায় বেড়াতে গেলে— সে নিজের বাড়িতেই যান বা বাড়ি ভাড়া করে যান, লোকবল লাগে। একদা একান্নবর্তী পরিবারে সেই সুবিধে ছিল। আজ লোকলস্কর, লটবহর নিয়ে বেড়াতে যাওয়া চিন্তার বাইরে। তার থেকেও বড় কথা, পূর্বজদের তৈরি বিরাট বাংলো বজায় রাখার ইচ্ছে বা অর্থ পরের প্রজন্মের রইল না। কোথায় গিরিডি, মধুপুর, হাজারিবাগ, যে বাড়িতে যাওয়াই হয়ে ওঠে না, হয়তো দু’বছরে এক বার পৌষ-মাঘে, তার জন্যে সারা বছর মালি, দারোয়ান, মিস্ত্রি, এ তো শুধু নিজেদের বিব্রত করা।

ছুটির ধারণাও এখন আমূল পরিবর্তিত। আগে সপরিবারে একনাগাড়ে মাসখানেক পশ্চিমে হাওয়াবদল ছিল খুব স্বাভাবিক। সেই সুখের দিন উধাও। এখন ছুটি মানে শনি-রবিবার, কাছাকাছি কোথাও। আর বড় ছুটি পাওয়া গেলে সারা বিশ্বের মানচিত্র বাঙালির কাছে খোলা। যেখানেই যাওয়া যাক, পকেটসই হোটেল, বেড-অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট, হোমস্টে-র সুবিধে রয়েছে। অরুণাচল বা অসলো, মাসাইমারা বা মিজ়োরাম, পর্যটনের গণ্ডি বৃহত্তর হতে হতে দেশবিদেশ যখন একাকার, তখন ছোটনাগপুর-বিলাসিতা অচল। সাঁওতাল পরগনায় বাড়ি তৈরি করে, সারা বছর সারাই, সাফ-সুতরো করে কেবল ছুটিছাটায় বেড়াতে যাওয়ার মানসিকতা এখন অতীত।

বিশের শতকের গোড়ার দিকেও এই শহরগুলির উচ্চবর্গীয় অংশ ছিল বাঙালিপ্রধান। দারোগা, পোস্টমাস্টার, শিক্ষক, ব্যবসায়ী থেকে সবচেয়ে প্রিয় মিষ্টির দোকানের মালিক, যাঁকেই ধরা যাক না কেন— স্বগোষ্ঠীর এই সাম্রাজ্যে পরিযায়ী বাঙালিও বেশ গৌরব বোধ করতেন। যখন কালের নিয়মে বাঙালির প্রতাপ কমে এল, যাঁদের ‘দেহাতি’ বলা হত তাঁরাই স্বদেশে সর্বাধিক গুরুত্ব পেলেন, তখন বাঙালির আগ্রহ গেল কমে। এ ছাড়া তো আছেই রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। বেশ অনেকটা সময় ধরে বিহারে, ও পরে ঝাড়খণ্ডে রাজনীতি ছিল অশান্ত-উত্তাল। পর্যটন-প্রিয় বাঙালি এই অনিশ্চিত টানাপড়েন থেকে সরে এল। “কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!” যত দিনে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে তত দিনে প্রাণের টানের শিকড় আলগা হয়ে গিয়েছে। ইতিমধ্যে অজস্র বাড়ি হাতবদল হয়েছে। কষ্ট হয়নি? অবশ্যই হয়েছে। আর কোথায় মেলে আলো-আঁধারি শাল-মহুয়ার বন, ইউক্যালিপ্টাসের আড়ালে উজ্জ্বল কালপুরুষ, পেয়ারাতলায় চড়ুইভাতি? কোথায় নামবে সেই মায়াবী দুপুর? কোন স্টেশনে নেমেই দেখা যাবে সন্ধ্যাকাশ ঝুঁকে আছে অগুনতি নক্ষত্র নিয়ে?

বিকল্প প্রেম হিসেবে কতশত দ্বিতীয় আবাস তৈরি হল শান্তিনিকেতন এবং আশেপাশে, রায়চকে, বারুইপুর-সোনারপুরে, বাসন্তী হাইওয়েতে বা বাটানগরে। সাঁওতাল পরগনার বাড়িগুলি এখনও হয়তো একরাশ স্মৃতি আঁকড়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোনও বাড়ি হোমস্টে-রূপে পুনর্জীবিত। ছোটনাগপুরের মালভূমির মাথায় “হয়তো সেই আকাশের বুক থেকে শেষ রোদ লয়নি বিদায়—”

আহা। প্রিয় নদীটি বয়ে যাক, পরিচিত পাথরে প্রতি দিন স্রোতের আঘাত লাগুক। ঘন কুয়াশায় পথ চিনে পাখিগুলি বাসায় ফিরুক।

Advertisement
আরও পড়ুন