Suicide

অন্যের কথা শোনার সময়

যিনি আত্মীয় বা পড়শির দেহ ঝুলতে দেখেন, বাকি জীবন তিনি কোন ট্রমার শিকার হবেন, তা তিনিও জানেন না।

Advertisement
তন্বী হালদার
শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০২৫ ০৭:০০

যে  লোকটি পাড়ার দোকান থেকে নাইলনের দড়ি কিনে উল্টো দিকের বাড়ির প্রতিবেশীর সঙ্গে গল্প করে বাড়ি ঢুকল, খানিক পর জানা গেল সেই দড়ি দিয়ে সে অসুস্থ সন্তানকে নিয়ে নিজে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে। নিজে না থাকলে অসুস্থ সন্তানের ভবিষ্যৎ কী হবে, এই ভয়ের তাড়নায় সন্তানকে মেরে ফেলেছে, নিজেকেও। আবার, ভয়ঙ্কর এক পথ-দুর্ঘটনার পরে জানা গেল, সেটা ছিল সপরিবারে আত্মহত্যার চেষ্টা। এ সবের কী প্রতিক্রিয়া হয় আশেপাশের মানুষদের? যিনি আত্মীয় বা পড়শির দেহ ঝুলতে দেখেন, বাকি জীবন তিনি কোন ট্রমার শিকার হবেন, তা তিনিও জানেন না। সেই মুহূর্তে তাঁর মনোভাব কী হয়, কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা থেকে ফিরে আসতে কতক্ষণ লাগে, কে বলতে পারে?

Advertisement

আমাদের আশেপাশে অহরহ কত মানুষ নিয়ত নিজের মৃত্যুকামনা করছেন, ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। কোথায় পৌঁছে গেলে মনে হতে পারে, ‘আমার বাঁচবার পথ একমাত্র মৃত্যু?’ কে কখন ‘নেই’ হয়ে যাবে, পাশাপাশি বাস করেও আন্দাজ করা যাচ্ছে না। যে প্রতিবেশী পরিবারটিকে দু’দিন আগেও দেখা গেল বাজার করতে, আজ তাদের বাড়ির সামনে মরদেহের গাড়িতে একটার পর একটা মৃত শরীর তুলতে দেখা যাচ্ছে। যিনি আত্মহত্যা বেছে নিচ্ছেন, তিনি আপনজনদেরও সেই মৃত্যুতে শামিল করে নেওয়ার নানা যুক্তি খুঁজে বার করছেন। এই ‘সপরিবার’ আত্মহত্যা কি পরিকল্পিত হত্যা, না কি সমবেত আত্মহত্যা? নিজেদের মতো করে বাঁচার পথ খোঁজার সুযোগ কি সত্যিই অন্যরা পেয়েছিল?

মনোবিদরা বলেন, এক জন মানুষ যখন নিজেকে শেষ করে দেওয়ার কথা ভাবেন তখন তিনি কিছু না কিছু আগাম সঙ্কেত বা ‘সিগন্যাল’ দেন তাঁর আপনজনদের কাছে, নানা রকম ভাবে। নিজের খুব প্রিয় জিনিস অনায়াসে অন্যকে দিয়ে দেওয়া, মৃত্যু সম্পর্কিত নানা কথা বলা, অকারণে নিজের ক্ষমতার বাইরে দান, এ সব কাজ এই ধরনের বার্তা বয়ে আনে। কিন্তু এ ধরনের আচরণ থেকে মনের অবস্থার আন্দাজ করা তো সহজ নয়। অন্যের মনের ভাষা বুঝতে পারা সহজ নয়। এই ভোগবাদী এবং মিডিয়া-সর্বস্ব সময়ে একে অন্যের মন বোঝার সময় কোথায়? যে ভাষা বুঝতে পারলে আর একটা মানুষ হয়তো দেহে-মনে বেঁচে যেত। আত্মহত্যা একটি বার্তাও বটে, কিন্তু সে বার্তা সবার ক্ষেত্রে সমান নয়। চরম ভোগবাদের শিকার হয়ে কারও কোটি টাকার দেনা হয়ে গিয়েছে, কেউ অসুস্থ সন্তানের ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছেন না, কেউ বা সমাজের কোনও অন্যায় প্রতিবাদ করার ভাষা এ ভাবেই খুঁজে নিচ্ছেন। কারণ যা-ই হোক, মৃত্যু দিয়ে যেন তাঁরা শেষ কোনও কথা বলে যেতে চান।

কিন্তু সে কথা শুনছে কে? যদি অনেক আগেই তাঁদের কথা শোনার, বোঝার, লোক পাওয়া যেত, তা হলে হয়তো এমন করে ‘শেষ কথা’ বলে যেতে হত না। “আমি আছি, আমি তোমার জন্য আছি,” এটা বলতে যেন আমরা ভয় পাই, পাছে আমারই ঘাড়ে দায়িত্ব এসে পড়ে। সেই সঙ্গে, নিজের উপর নিজে চাপ তৈরি করি ‘না হলেই নয়’-এর তালিকা দীর্ঘ করে। যেমন, যে ভাবেই হোক আমার সন্তানকে ক্লাসে ফার্স্ট হতে হবে। যেন স্কুলের একটা ক্লাসে বছরের একটা পরীক্ষায় একটি শিশু প্রথম না হলে পরিবার, সমাজ, এমনকি নিজের কাছে নিজেই হেরে গেলাম। যদিও জানি, প্রথম এক জনই হয়, আর ‘লাস্ট’ হলেও সে আমারই সন্তান। এ সত্য জানলেও মানতে অসুবিধা তৈরি হচ্ছে। অমুক ব্র্যান্ডের গাড়ি, জামা, গ্যাজেট পাওয়ার তাড়না তৈরিও করছে বাজার, আবার বাজারই ক্রেডিট কার্ড, সুলভে লোন জুগিয়ে সে সব পাওয়ার উপায় করে দিচ্ছে। তাতে অন্তরের শূন্যতা কি ভরে উঠছে?

প্রায়ই শোনা যায়, নিজেকে ভালবাসুন। এই ‘সেল্ফ লাভ’ নিশ্চয়ই দরকার, নিজেকে নিয়ে বিব্রত, লজ্জিত থেকে জীবন কাটানোর মানে নেই। কিন্তু এই ‘সেল্ফ’-এর বৃত্ত যদি একটিই ব্যক্তির প্রতি ভালবাসায় সীমিত থাকে, তখন তা একাকিত্ব হয়ে ওঠে। একটি অচেনা মেয়ের হত্যায় আমরা মিছিলে হাঁটি, কারণ আমাদের ‘আত্ম’-বোধ বহু দূর বিস্তৃত।

মৃত্যুকে নিয়ে যতই কাব্য বা রাজনীতি হোক, মৃত্যুর মতো নিষ্ঠুর সত্য আর কিছু নেই। গত কয়েক দিনে যে মানুষগুলোর মৃত্যু আমাদের আলোড়িত করল, তার তরঙ্গও সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে যাবে। আবার নতুন তরঙ্গ উঠবে— দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া কিছু মানুষ না-থাকাকেই বেছে নেবেন। এই দুই তরঙ্গের চূড়ার মাঝে নিচু স্বরে গুঞ্জরিত হবে কিছু প্রশ্ন— আমি কি এর পরও একটু দায়বদ্ধ থাকব না, যাতে এমন কিছু ঘটার আগেই থামাতে পারি? কেউ কথা বলতে চাইলে নিজের সময় একটু খরচ করে নাহয় তাঁর কথা শুনব। কেউ চুপ করে গেলে তাঁর সঙ্গে কথা বলব। কেউ হাত সরিয়ে নিলে তাঁর দিকে একটু হাত বাড়িয়ে দেব। কেউ বিরক্তির কথা বললে তাঁকে ধৈর্যের কথা বলব। কেউ ঘেন্নার কথা বললে তাঁকে ভালবাসার কথা বলব। কেউ মৃত্যুর কথা বললে তাঁকে বেঁচে থাকার গান শোনাব। একটু শুধু বুঝতে দেওয়া, আমি আছি।

Advertisement
আরও পড়ুন