গোয়া, কাশী এবং আরও
TMC

মমতার ‘ভারত অভিযান’ কি কোনও নতুন অভিষেকের ইঙ্গিত

বিধানসভা ভোটে বিজেপিকে কোণঠাসা করে দেওয়ার পর থেকে তৃণমূলনেত্রী মমতা নিজেকে জাতীয় স্তরে যে ভাবে দেখতে চাইছেন, তাঁর এই গোয়া সফর তার অঙ্গ।

Advertisement
দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০২১ ০৬:০৭
প্রতিবাদ: গোয়ার পূর্বতন সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র হাতে তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ, ২৫ অক্টোবর, ২০২১, পানজিম।

প্রতিবাদ: গোয়ার পূর্বতন সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র হাতে তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ, ২৫ অক্টোবর, ২০২১, পানজিম। পিটিআই।

এক দিন পরেই রাজ্যে আরও চার বিধানসভার উপনির্বাচন। আর ঠিক তার আগে আজই গোয়া যাচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আপাত ভাবে ঘটনা দু’টি আলাদা হলেও সম্পর্কহীন নয়। মে মাসে বিধানসভা ভোটে বিজেপিকে কোণঠাসা করে দেওয়ার পর থেকে তৃণমূলনেত্রী মমতা নিজেকে জাতীয় স্তরে যে ভাবে দেখতে চাইছেন, তাঁর এই গোয়া সফর তার অঙ্গ।

ভোট-ভবিতব্যে অনিশ্চয়তার একটি ভূমিকা নিশ্চয় আছে। তবে সময় ও পরিস্থিতির ভিত্তিতে কিছুটা আগাম মূল্যায়ন করা যেতে পারে। এক মাস আগের তিনটির মতো এ বারের এই চার উপনির্বাচন নতুন কোনও বার্তা দেবে, তেমন সম্ভাবনা এখনও দেখা যাচ্ছে না। তৃণমূলের শক্তি আরও একটু বাড়ার ইঙ্গিতই মিলছে বেশি।

Advertisement

সে ক্ষেত্রে বিধানসভার গত ভোটে বিজেপির পাওয়া আসনের সংখ্যা কমে যাওয়া হয়তো খুব আশ্চর্যের হবে না। কারণ, যে চারটি কেন্দ্রে ভোট হচ্ছে, তার দু’টিতে তখন বিজেপির দুই সাংসদ জিতে বিধায়ক হয়েছিলেন। তাঁরা বিধায়ক পদ ছেড়েছেন। আর তাঁদের ধরেই বিজেপি সেই সময় সাতাত্তরটি আসনে জিতেছিল। হিসাব বরাবর রাখতে গেলে বিজেপিকে এখন চারের মধ্যে অন্তত দু’টিতে জিততেই হবে, যা এখনও পর্যন্ত সংশয়ের জায়গায়।

কিন্তু এই ভোটে তৃণমূল দু’টি আসন বাড়াক, বা বিজেপি আগের জেতা দু’টি আসন হারাক, সেটা তত গুরুত্বপূর্ণ নয়। এতে সামগ্রিক ছবিও বদলে যাবে না। তাৎপর্যপূর্ণ হল, অ-বঙ্গভাষী বিভিন্ন রাজ্যে দ্রুত পৌঁছে যাওয়ার জন্য তৃণমূল নেতৃত্বের তৎপরতা।

এটা ঘটনা যে, বাংলায় বিধানসভা ভোট থেকে শুরু করে তৃণমূলের একক আধিপত্যের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে বলেই জাতীয় রাজনীতিতে বিজেপির বিরুদ্ধে ‘মুখ’ হয়ে ওঠার দৌড়ে মমতা আজ এক জন বড় দাবিদার। সেখানে কংগ্রেস অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী। তবে তার নিজের ‘জোর’ কোথায় কতটা, সেই প্রশ্নটি এখনও অমীমাংসিত। তা নিয়ে কংগ্রেসের ভিতরে-বাইরে জটিলতাও বিস্তর। যার প্রমাণ স্পষ্ট হচ্ছে।

এই রাজ্যে ভোটের আগে থেকেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ভিন্‌রাজ্যে যাওয়ার একটি ছক কষে রেখেছিলেন। প্রকাশ্যেই তিনি বলেছিলেন, তাঁর লক্ষ্য অন্যান্য রাজ্যে সংগঠন গড়ে তোলা। সেই কাজে প্রশান্ত কিশোরের পরামর্শ অবশ্যই তাঁর সঙ্গে ছিল। অন্যান্য রাজ্যের বিভিন্ন নেতার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে অভিষেক আপাতত উদ্দেশ্যটি এগিয়ে নিচ্ছেন।

দলের নতুন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হিসাবে এটা তাঁর কাছেও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এত পরিকল্পিত ও সংগঠিত ভাবে বিভিন্ন রাজ্যে বিস্তারের প্রয়াস তৃণমূলে আগে দেখা যায়নি। অভিষেক উদ্যোগী হয়েছেন। ‘সফল’ হলে সংগঠনে তাঁর কর্তৃত্বের মুঠো আরও দৃঢ় হতে বাধ্য।

পাশের বাঙালি রাজ্য ত্রিপুরায় তৃণমূল আগে লড়েছে। মথুরাতেও এক বার স্থানীয় কোনও প্রভাবশালীকে প্রার্থী করে একটি আসন জিতেছিল মমতার দল। তবু ওগুলিকে বিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা বলাই সঙ্গত। সব ছিল ক্ষণস্থায়ী। ফলে, আলোচনাও তেমন ভাবে হয়নি। এ বার হচ্ছে। কারণটি সহজবোধ্য।

তবে সন্দেহ নেই, যদি তৃণমূল নিজের রাজ্যে ভোটে না জিতত বা বিজেপি অল্প ব্যবধানে হারত, তা হলে ভিন্‌রাজ্যে যাওয়ার এই উদ্যোগ ধামাচাপা থেকে যেত ভবিষ্যতের জন্য, কোনও ‘অনুকূল’ সময়ের অপেক্ষায়। কিন্তু যে ভাবে, যে পরিস্থিতির মুখে দাঁড়িয়ে মমতা বিজেপির বিরুদ্ধে বিপুল গরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরলেন, তাতে ওই প্রকল্প কার্যকর করার পথ ‘সুগম’ হয়েছে। রাজনীতির ময়দানে কোনও দল নিজের বৃদ্ধি ঘটাতে চাইবে, সেটাই তো স্বাভাবিক।

অভিষেকের ঘোষণা অনুযায়ী, গোয়া, ত্রিপুরার মতো উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম প্রভৃতি রাজ্যেও তাঁরা সংগঠন গড়তে যাবেন। সরকার গড়তে পারা তো শেষ কথা। নানা দিকে কয়েকটি রাজ্যে তৃণমূল তাদের রাজনৈতিক উপস্থিতির ছাপ রাখতে পারলেও তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী হবে।

কংগ্রেস ও সমমনস্করা অনেকেই অবশ্য মনে করে, তৃণমূলের এটা ‘ভারী অন্যায়’! বাংলার দল তৃণমূল এ ভাবে অন্য রাজ্যে সংগঠন করতে যাক, সেটা তাদের ঘোরতর না-পসন্দ। যুক্তি সাজাতে সামনে আনা হচ্ছে বিরোধী জোটের প্রসঙ্গ।

আসলে এটা এক ধরনের ভাবের ঘরে চুরি। প্রথমত কংগ্রেস বিলক্ষণ বোঝে, সামগ্রিক বিচারে ঘরে-বাইরে তারা খুব স্বস্তিকর অবস্থায় নেই। অন্য দিকে মমতার জনভিত্তির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মূলগত ভাবে কংগ্রেসি মানসিকতার। তিনি কোনও ভিন্‌রাজ্যে পা রাখলে তাই প্রকৃতপক্ষে ঘা প্রথম পড়তে পারে কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্কের উপর।

সর্বত্র এর অভিঘাত সমান হবে, এমন নয়। তৃণমূলের এই ভূমিকায় বিজেপির কোথায় কতটা ক্ষতি হবে, বা সুবিধা, সেটাও নিশ্চয় বিচার্য। কিন্তু বাইরের রাজ্যে যেখানে যতটা ভোট তৃণমূল জোটাতে পারে, তার অনেকটা যাবে কংগ্রেসের ঘর থেকেই।

তাই শুধু বিরোধী জোটের কথা তুলে নিজেদের সেই ‘দুর্বল’ অবস্থা আড়াল করার চেষ্টা রাজনৈতিক হঠকারিতার নামান্তর।

দ্বিতীয়ত, ত্রিপুরা, অসমের কথা ছেড়ে দিলাম। সন্তোষ দেবের মেয়ে সুস্মিতার তৃণমূলে আসার পিছনেও নাহয় তাঁর বাবার সঙ্গে মমতার দীর্ঘ রাজনৈতিক যোগাযোগের তত্ত্ব খাড়া করা যেতে পারে। কিন্তু গোয়ার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী লুইজ়িনহো ফেলেইরো, কিংবা উত্তরপ্রদেশে কমলাপতি ত্রিপাঠীর পরিবারের দুই উত্তরপুরুষ কংগ্রেস ছেড়ে হঠাৎ তৃণমূলে যোগ দিতে গেলেন কেন? সেটাও এই সূত্রে ভেবে দেখা প্রয়োজন নয় কি? কংগ্রেসের উচিত এ নিয়ে আত্মসমীক্ষা করা।

অথচ ওই দুই রাজ্যে তো বটেই, অন্যত্রও মমতা এত দিন নিজের দলের প্রসারে খুব সক্রিয় ছিলেন, তা বলা যাবে না। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে তিনি রাজনীতি করতে গোয়া বা বারাণসী গিয়েছেন বলেও মনে পড়ে না।

গোয়ার তুলনায় বারাণসী, অর্থাৎ কাশীর সঙ্গে আমবাঙালির যোগাযোগ বেশি। কিন্তু অখিলেশ তাঁর ‘স্নেহধন্য’ হলেও মমতাকে বাঙালি ভোটের অঙ্কে কাশী বা মথুরা-বৃন্দাবনে যেতে দেখিনি। কোনও একটি ভোটে এক বার বোধ হয় মমতার একটি বার্তা রেকর্ড করে সেখানে পাঠানো হয়েছিল।

আর সম্ভবত ২০১০ সালে রেলমন্ত্রী থাকাকালীন চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধন করতে শেষ বার গোয়া গিয়েছিলেন মমতা। তৎকালীন কেন্দ্রীয় তথ্যমন্ত্রী অম্বিকা সোনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় উদ্বোধনের দায়িত্ব বর্তায় রেলমন্ত্রীর উপর। সামান্য সময়ের সফর। দেখেছিলাম, যাতায়াতের পথে সাধারণ মানুষ তাঁর প্রতি আগ্রহবশত রাস্তায় সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছেন।

এটা মমতার ক্ষেত্রে খুব অভিনব বলব না। বেঙ্গালুরু বা বিশাখাপত্তনম সবখানেই এমন দেখেছি। বেঙ্গালুরুতে ভিড়ের রাস্তায় মমতার গাড়ি দেখে অফিসফেরতারা বাস থেকে ঝুঁকে পড়ে হাত নেড়ে তাঁকে অভিবাদন জানিয়েছেন। এটাও দেখা।

তার মানে এই নয় যে, মমতার দল যে কোনও জায়গায় ভোটে দাঁড়ালেই তাদের জয়জয়কার হবে! তবে এ কথাও মানতে হবে, জন-আকর্ষণী ক্ষমতায় মমতা অন্য কারও চেয়ে কম যান না। তাই গোয়া, কাশী, ত্রিপুরা বা মেঘালয়ে ভোট করতে গেলে এটা তাঁর দলের পক্ষে আপাত ভাবে একটু সুবিধাজনক। অন্তত মমতার সভায় তাঁর বক্তৃতা শুনতে ভিড় হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ফল যা-ই হোক। অন্য রাজ্য থেকে প্রথম যাওয়া একটি দলের পক্ষে এটা অবশ্যই রাজনৈতিক লাভের। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে যা আরও বেশি অর্থবহ।

অবশেষে বিরোধী জোটের প্রসঙ্গ। বহু চর্চা হয়েছে, হবেও। শুধু জানতে ইচ্ছে করে, মমতা অন্য রাজ্যে গেলে যদি জোট-স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয়, তা হলে কংগ্রেস এই রাজ্যে মমতার বিরুদ্ধে লড়ে কেন? বিজেপি-বিরোধী ভোট ভাগ করার চেষ্টায়?

Advertisement
আরও পড়ুন