Election

হেমন্তের ঝড়ের শেষে

বছরটা খুব অন্য রকম। সংবিধানসম্মত সত্তরটি দেশের প্রায় চারশো কোটি মানুষ, মানে পৃথিবীর জনসংখ্যার অর্ধেক— এই বছরে ভোট দিয়ে নেতা নিয়োগ করলেন ও সরকার গঠন করলেন।

Advertisement
অলকেশ দত্তরায়
শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ০৪:৫৯

নভেম্বর মাস শেষ হতে চলল। গোটা মাস ধরে রিপাবলিকান পার্টির ‘এ ভাবেও ফিরে আসা যায়’ উৎসবের পাশে ডেমোক্র্যাটদের ‘এ কী হল’-র বিচার-বিশ্লেষণ চলছে। আঙুল তোলা হচ্ছে বাইডেনের ঠিক সময়ে সরে না-আসার সিদ্ধান্তের দিকে, ও কমলার ‘নিজস্বী’ বক্তব্য তৈরির পাশে দলের ‘স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানিং’-এ যথেষ্ট সময় না দেওয়ার ভুলের দিকে। তবে কিনা, মানতেই হবে, ‘গণতান্ত্রিক’ আমেরিকার মানুষ জেনেবুঝেই এক জন ডিক্টেটরকে ফিরিয়ে এনেছেন আবার। দেশ চালানোর চাবিকাঠি তুলে দিয়েছেন সেই নেতার জঙ্গিমনোভাবাপন্ন দক্ষিণপন্থী সাঙ্গোপাঙ্গকে। তাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ইন্ধন জুগিয়েছেন অসীম অর্থনৈতিক ক্ষমতাসম্পন্ন ইলন মাস্ক বা জেফ বেজ়োস-এর মতো কতিপয় অতি ক্ষমতাশালী ব্যক্তি বা অলিগার্ক।

Advertisement

বছরটা খুব অন্য রকম। সংবিধানসম্মত সত্তরটি দেশের প্রায় চারশো কোটি মানুষ, মানে পৃথিবীর জনসংখ্যার অর্ধেক— এই বছরে ভোট দিয়ে নেতা নিয়োগ করলেন ও সরকার গঠন করলেন। রাশিয়া ও চিন দেশে, ভারত ও পাকিস্তানে, আফ্রিকা মহাদেশের কিছু জায়গায়, মধ্য, দক্ষিণ ও উত্তর আমেরিকায়। বছরের প্রতিটি মাসেই কোনও না কোনও দেশের সাধারণ মানুষ তাঁদের রাজনৈতিক অধিকার প্রয়োগ করেছেন ভোটের বাক্সে। কিছু দেশে হয়তো সেই অধিকারের ফল অল্প হলেও, গণতান্ত্রিক সফলতার সদর্থক হদিসই দেখিয়েছে। কিন্তু বলতেই হয়, যে অর্থে গত শতাব্দীর মধ্য ও শেষ ভাগে গোটা পৃথিবী জুড়ে গণআন্দোলনের জোয়ারের ইতিহাস তৈরি হয়েছিল, এই নতুন শতাব্দীর গোড়ায় সেই ইতিহাস দ্রুত মুছে যাচ্ছে একনায়কতন্ত্রী স্বঘোষিত ‘পপুলিস্ট’ নেতাদের আস্ফালনে ও সরকার গঠনে। সরকারের পাশাপাশি তৈরি হচ্ছে সেই আস্ফালনের মগজধোলাই যন্ত্রের নিপুণ প্রয়োগকারী, এবং তুমুল অর্থনৈতিক ক্ষমতাশালী অলিগার্ক ও লবিস্টদের সঙ্গী নেতাদের রাজনীতির নতুন ভাষ্য। তার উদ্দেশ্য ও বিধেয়— হয়তো কোনও দেশে ধর্মীয় ভেদাভেদ সৃষ্টি, কোনও দেশে অভিবাসী বা মাইগ্র্যান্ট মানুষদের প্রান্তিকীকরণ, কোনও দেশে তুমুল অর্থনৈতিক বিভাজনের শিকার হওয়া নাগরিকদের খেপিয়ে তোলা। এই বিভেদ-বিভাজনের ডামাডোলের বাজারে, সামাজিক-অর্থনৈতিক-মানসিক ভারসাম্যহীন পরিস্থিতির জাঁতাকলে পড়ে আরও পিষে যাচ্ছেন সেই সাধারণ মানুষরাই।

জর্জ অরওয়েল তার ১৯৮৪ বইতে যে কথাগুলো প্রায় পঁচাত্তর বছর আগে লিখে গিয়েছিলেন, সেই কথাগুলো গত এক দশকের মধ্যেই চোখের সামনে যেন বাস্তবায়িত হয়ে উঠল। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হল যে, ইন্টারনেট পরিচালিত ২৪x৭-এর দৈনন্দিন জীবনে মানুষ এখন নিজেরাই নিজেদের হাত-পা বেঁধে ফেলছেন সেই অলিগার্ক ‘বিগ ব্রাদার’ নিয়ন্ত্রিত পৃথিবীতে— তথ্যপ্রযুক্তি, সমাজমাধ্যম ও কৃত্রিম মেধার শিকলে। সেই পৃথিবীতে গাজ়া-র নিহত শিশুদের ছবি দেখার পরেও আমেরিকা ও ইজ়রায়েলের যুদ্ধাস্ত্র বেচাকেনার অর্থনীতি চলতেই থাকে; পরিবেশ পরিবর্তনকারী কার্বন-ফুটপ্রিন্টের পরিমাপ জানার পরেও ফসিল-ফুয়েল ইন্ডাস্ট্রি আরও রমরমা হয়ে ওঠে; পারমাণবিক কারখানার বিস্ফোরণ অবশ্যম্ভাবী জেনেও বিকল্প জ্বালানি হিসেবে পরমাণু শক্তির পক্ষেই মতামত দেওয়া হয়।

অনেকে এখনও বলছেন, ট্রাম্প, পুতিন, শি জিনপিং, বা হাঙ্গারির ভিক্টর ওরবান অথবা ক’দিন আগের ব্রাজ়িলের বোলসোনারো, এঁরা কেউই সে অর্থে ফ্যাসিস্ট নন। হিটলার বা মুসোলিনির সঙ্গে এঁদের তুলনা করাটা বাড়াবাড়ি। একটা কথা ভাবার থাকে। তখনও জেনেবুঝে মগজধোলাই-এ রাজি হয়েছিলেন বহু মানুষ, অস্বীকার করেছিলেন পরিস্থিতির গুরুত্ব।। আজও কি তাই-ই হচ্ছে না? আজও কি বহু মানুষ এই অতি-স্বৈরতন্ত্রীদের হালচাল জেনেও না জানার ভান করছেন না? সম্ভবত মানুষ নিজেরাই যখন ঢুকে পড়েন মগজধোলাইয়ের যন্তর-মন্তর ঘরে, তাঁরা নিজেরা সমস্যার বিশালত্বকে বুঝতে পারেন না। তাই, ভোট নামক যে হাতিয়ার এই বছর বহু দেশের বহু মানুষের কাছে এক বিকল্পের সুযোগ নিয়ে এসেছিল, তা কাজে লাগাতে না পারার ফলে সেই হাতিয়ারই হয়তো অদূর ভবিষ্যতে মানুষের হাত থেকে কেড়ে নেওয়া হবে। কেবল পরিবেশ-বিপন্নতার কারণে নয়, নানা অর্থেই এই পৃথিবী এগিয়ে যাবে ধ্বংসের দিকে।

প্যান্ডোরার বাক্স থেকে সমস্ত ভয়ানক আর ‘ইভল স্পিরিট’ বেরিয়ে আসার পরেও ‘আশা’ নামক ছোট্ট বস্তুটি রয়ে গিয়েছিল। সেইটুকুর উপর বিশ্বাস রাখা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। লক্ষণীয়, আমেরিকার অনেক প্রদেশে এই মুহূর্তেই একটা অন্য ধারা দেখা যাচ্ছে, দলীয় মতভেদ ভুলে মানুষ পাশাপাশি কাজ করছেন, একে অন্যকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন। শহরের মিউনিসিপ্যালিটির এক জন সৎ প্রধানও বড় বড় সামাজিক বিপ্লব ঘটিয়ে দিতে পারেন। সেই রকম কিছু মানুষের উপরেই ভরসা থাকুক। বহু দেশ জুড়ে ‘বহুস্বর স্তব্ধ’ হয়ে গেলেও প্রতিবাদের জায়গাটা আমরা ছেড়ে দেব না নিশ্চয়ই। বর্তমান চলমান সময়ে এটাই সবচেয়ে বড় কাজ। এই ভোটের বছরের শেষে এটাই হোক সবচেয়ে বড় বার্তা।

আরও পড়ুন
Advertisement