R G Kar Hospital Incident

একটি ‘অরাজনৈতিক’ প্রশ্ন

সঙ্গত কারণেই প্রশাসনের বিরোধিতা ছাড়া নারী-আন্দোলন হয়ে ওঠে না, তবে সেটা তার প্রধান লক্ষ্য নয়। অযোগ্য সরকার ন্যায়বিচারে অসফল হতে পারে।

Advertisement
ঋতু সেন চৌধুরী
শেষ আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০২৪ ০৮:৫০
—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

সেই ১৪ অগস্ট কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় সব বয়স, শ্রেণি, জাত, ধর্ম, যৌন অভিমুখের মেয়েদের চিৎকার রাতের আকাশ বিদীর্ণ করে দাবি জানিয়েছিল ‘জাস্টিস ফর আর জি কর’। দেড় মাস অতিক্রান্ত, জনমানুষের সেই কলরব থামেনি। মিছিল খুঁজে নিয়েছে মানুষ, সংক্রমিত হয়েছে সাহস। তবে সম্যক সম্ভাবনা থাকলেও এই আলোড়নের কোনও একটি স্রোতও শেষ পর্যন্ত নারী-আন্দোলনের চেহারা নেবে কি না, তা বোঝা যাচ্ছে না। আন্দোলনের অভিমুখ একটি নির্দিষ্ট খুন-ধর্ষণের ন্যায়বিচার থেকে সার্বিক রেপ-কালচারের বিরুদ্ধে যাচ্ছে কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়। বোঝা যাচ্ছে না জনগণের রায় বা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির সঙ্গে নারী-আন্দোলন কী ভাবে বোঝাপড়া করবে। প্রশাসনবিরোধী রাজনীতিতে, তা দলীয় রাজনীতির বাইরে হলেও, ঝুঁকির সঙ্গে সঙ্গে আছে গরিমা। কিন্তু ধর্ষণের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুললে মহিলা এবং এলজিবিটিকিউএপ্লাস মানুষের গরিমাহীন প্রাত্যহিকতা তাকে ‘অরাজনৈতিক’ করে তুলবে। লিঙ্গ রাজনীতি এখনও ততটা রাজনৈতিক নয় কিনা!

Advertisement

সঙ্গত কারণেই প্রশাসনের বিরোধিতা ছাড়া নারী-আন্দোলন হয়ে ওঠে না, তবে সেটা তার প্রধান লক্ষ্য নয়। অযোগ্য সরকার ন্যায়বিচারে অসফল হতে পারে। কিন্তু ভেবে দেখার বিষয় হল, নারীজাতির বিরুদ্ধে হিংসাকে যদি একটি বিচারব্যবস্থাধীন প্রশ্নে সীমাবদ্ধ রাখা হয় তা হলে তাকে সাধারণ পুনরাবৃত্তিযোগ্য ঘটনার মতো দেখাবে। অপরাধের পুনরাবৃত্তির আশঙ্কাতেই তো আইন। সংস্কারমূলক উপায়ে ধর্ষণ রোধ করা নারী-আন্দোলনের একটা দায়িত্ব হলেও— তার মূল উদ্দেশ্য সমাজটাকে পাল্টানো। যে হিংসার নিশানায় শুধুই মেয়েরা তার মূলে রয়েছে নারীবিদ্বেষ। জনপরিসর, অন্দরমহল এবং অন্যত্রও মেয়েদের সার্বিক গুরুত্বহীনতা, প্রত্যেক দিনের অবমাননা, যৌন হেনস্থা, ধর্ষণ বাঁধা রয়েছে একই সূত্রে। সেই সূত্র সমূলে উৎপাটন না করলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির পরও ধর্ষণ থামবে না। রাস্তার প্রতিবাদের সঙ্গে জুড়তে হবে ব্যক্তি পরিসর। প্রত্যেক মুহূর্তে প্রতিবাদ— না বলতে শিখতে হবে আমাদের।

আন্দোলনের কোনও ফর্মুলা হয় না, তবু তাকে কার্যকর করতে হলে সুচিন্তিত দিশা প্রয়োজন। ১৪ তারিখ ও তার পরবর্তী জমায়েতগুলি সংক্রান্ত মূল পোস্টটিতে ‘রিক্লেম দ্য নাইট’-এর তর্জমা হল ‘রাত দখল’। এই নিয়ে কথাটা শুরু করব। এই হচ্ছে নারীবাদীদের সমস্যা। এত বড় আলোড়নের মধ্যে চোখ পড়ল একটা পোস্টার! কিন্তু পাঠক জানবেন এ সমস্যা আদপে সামান্য নয়। দখল শব্দটা নিয়ে একটু ভাবা দরকার। শব্দকোষে দখলের অর্থ বা প্রতিশব্দ মালিকানা, অধিকার, নিয়ন্ত্রণ। শব্দগুলির মধ্যে নিয়ন্ত্রণকারী ক্ষমতার কী আশ্চর্য আস্ফালন!

মনে রাখি, প্রাধান্য বিস্তারের একটি মূল আকর হল ভাষা। লিঙ্গ (অথবা শ্রেণি, ধর্ম, জাত, বর্ণ) ভিত্তিক কর্তৃত্ব যেমন এক ভাবে তৈরি হয়, তেমন টিকেও থাকে ভাষার ব্যবহারে। সমাজে ঠিক যা যে ভাবে ঘটছে তাই নিয়েই ভাষার নির্মাণ। দৈনন্দিন কথাবার্তায় সমাজের প্রভাবশালী মতাদর্শ নীতি-নিয়ম, ঠিক-ভুলের মাপকাঠিতে বেঁধে রাখে আমাদের। অথচ কথা বলা বা লেখার সময় ভাষার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চলনে ক্ষমতার নিপুণ বিন্যাস খেয়াল করি না আমরা। একটা উদাহরণে ভাবনাটা একটু ভেঙে নেওয়া যায়। ভাষার খেলায় শুধু দুইয়ের বিভাজন— ভাল/মন্দ, পরাক্রমী/দুর্বল, যুক্তি/আবেগ, বিবেচক/অর্বাচীন, মানব/অবমানব। দ্ব্যণুক কাঠামোয় খাপে খাপে বসে যায় নারী আর পুরুষ, যার একটা দিক মেয়েদের মতো দুর্বল, অকিঞ্চিৎকর। বাস্তব জীবনে ব্যতিক্রমী মহিলারা এই নির্মাণ অতিক্রম করেন বারংবার। কিন্তু তাতে ভাষা বা সমাজ কাঠামোয় সব সময় বদল হয় না। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে ভাষার টান শিশ্নকেন্দ্রিক আর তা ক্রমাগত দৃঢ় করে তোলে পুরুষের ক্ষমতার ভিত। ভাষাকে প্রশ্নাতীত ভাবলে অজানতেই ধরে রাখব স্থিতাবস্থা; যা লিঙ্গ রাজনীতির উদ্দেশ্যকে পরাস্ত করবে।

রাতে যে সময়ে মেয়েদের বেরোনো নিষেধ বা দিনেও যে সব জায়গায় মেয়েদের অনুমোদন নেই, সেখানে যখন তাঁরা আসতে চান, তা দখল নয় কেন? লিঙ্গ নির্বিশেষে অবাধ চলাফেরা ভারতীয় সংবিধানের একটি মৌলিক অধিকার। রাতের রাস্তা আইনত আমাদেরও। নারীবিদ্বেষী সমাজ কাঠামোয় যে মৌলিক অধিকার কায়েম করা যায়নি তার দাবি আমাদের রাজনৈতিক দায়। কিন্তু অধিকার প্রতিষ্ঠাকে ‘দখল’ বলায় সমানাধিকার কায়েম করার কাজকে ‘র‌্যাডিকাল’ বলে দাবি করা হবে। তাতে প্রকৃতপক্ষে র‌্যাডিকাল দাবিগুলি অধরা থেকে যাবে।

এ বার একটু উল্টো দিক থেকে ভাবা যাক। সমানাধিকারের দাবির মধ্যেই কি একটা র‌্যাডিকাল দিক নিহিত থাকে না? পিতৃতান্ত্রিক সমাজে সাংবিধানিক সমানাধিকার একটা কথার কথা। সমাজের কাঠামোগত পরিবর্তন না ঘটলে যে সমানাধিকার কায়েম করা যাবে না, দখল শব্দটা যেন তারই একটা উপসর্গ। ফলে শব্দটাকে পুরো নাকচ করা যাচ্ছে না। দখল করা আসলে উল্টে দেওয়ার রাজনীতি। কিন্তু মুশকিল এটাই যে, দখল করার মধ্য দিয়ে পাল্টে দেওয়ার সম্ভাবনাগুলি হয়তো পর্যবসিত হবে উল্টে দেওয়ায়। একেবারে গোড়ার থেকে বদল না হলে, ব্যবস্থা পাল্টে না গেলে সত্যি কি কোনও দিন মেয়েরা সমান অধিকার পাবেন? দখল বলে দেগে দিলে কঠিন হবে কাঠামো বদলানো! দখল বললে পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ আটকে থাকবে পুরুষেরই বয়ানে। এই যুক্তিতে নারী-আন্দোলন হয়ে উঠবে প্রাধান্যকারীর সঙ্গে মোকাবিলার হাতিয়ার। আর যা রোধ করতে চাই, হাতিয়ারকে হতে হবে তারই মতো।

কিন্তু নারী-আন্দোলন তো শুধুমাত্র পিতৃতন্ত্রকে অপসারণ করার হাতিয়ার নয়, তা আগ্রাসন, বঞ্চনার বাইরে এক অন্য ভুবনের স্বপ্ন দেখায়। আমরা যেন সেই অন্য বা যথার্থ রাজনীতির পথ খুলে রাখতে পারি। মনে রাখি যে দখল একটি প্রয়োজনীয় প্রতিক্রিয়া— আন্দোলনের উদ্দেশ্য নয়।

আরও পড়ুন
Advertisement