মানুষ মিলতে থাকে আশপাশ থেকে, স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে
Protest Movements

আন্দোলনের খসড়া হিসাব

ইতিহাস সাক্ষী যৌথ চেতনার বিবর্তনের। বিগত শতকে এই চেতনার ধ্বজাধারী হিসাবে নির্বাচিত ছিলেন দরিদ্র সর্বহারা।

Advertisement
তৃণাঞ্জন চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০২৪ ০৮:৫৮

Sourced by the ABP

পপ-আপ বুক। জয় বাবা ফেলুনাথ-এ ছাদের উপর সেই রুকুর ঘরটা মনে আছে? লালমোহনবাবু মাটি থেকে কুড়িয়ে নিলেন একটা বই। তার পাতা খুলতেই চোখের উপর লাফিয়ে উঠল ত্রিমাত্রিক দৃশ্যপট। তাঁর সেই হতভম্ব মুখটার কথা স্মরণ করুন। আন্দোলনকে অকস্মাৎ ফনফনিয়ে উঠতে দেখে আমাদের মনের অবস্থাও তদ্রূপ।

Advertisement

তবে এই যুগ কিন্তু জন-জাগরণের। ইতিহাস সাক্ষী যৌথ চেতনার বিবর্তনের। বিগত শতকে এই চেতনার ধ্বজাধারী হিসাবে নির্বাচিত ছিলেন দরিদ্র সর্বহারা। যাঁদের দায় ছিল নিপীড়িত মানব-সত্তাকে শৃঙ্খলমুক্ত করার। কিন্তু যে সংখ্যার জোরে তাঁদের প্রভাব, উৎপাদন-ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের ফলে তার ভাঁড়ারে এখন যথেষ্ট টানাটানি। কিন্তু ইতিহাসের চাকা থেমে থাকে না। প্রতিরোধ প্রতিবাদের ব্যাটন হস্তান্তরিত হল যার হাতে তাকে কি নেটিজেন বা ‘আন্তর্জাল-মাধ্যমে সংগঠিত জনগণ’ আখ্যা দেওয়া যায়? যাদের আন্দোলন সংঘটিত হয় বাস্তবে, কিন্তু সচেতনতা ও সংগঠনের কাজটা হয় ইন্টারনেটে। প্রযুক্তির কল্যাণে গ্রাম-শহর নির্বিশেষে যা এখন ঘরে-ঘরে। পাকা বাসস্থান, পানীয় জল, পাকা রাস্তা ও বিদ্যুতের সুবিধাকে যদি আমরা শহরের সূচক ধরি, তা হলে এ কথা অস্বীকার করার আর উপায় নেই যে তথাকথিত পঞ্চায়েত অঞ্চলের গভীর অবধি বিস্তৃত নাগরিক এই নেটওয়ার্ক।

উত্তরপাড়ার হিন্দমোটরের সেই কারখানাটা ভাবুন। ইঞ্জিন থেকে চেসিস— গোটা গাড়িটাই তৈরি হচ্ছে চার দিকে তোলা পাঁচিলের ঘেরাটোপে। চুড়োয় বসে মালিক, তার নীচে ম্যানেজার, ফোরম্যান শ্রমিক নিয়ে একটা পিরামিডের কাঠামো। হুকুম আসছে উপর থেকে, তামিল হচ্ছে নীচে।

আর এখন? যে গাড়িটা শো-রুমে দেখছেন তার চাকা তৈরি হয়েছে কামচাটকায় তো বডি কোয়ম্বত্তূরে। উৎপাদন ব্যবস্থা সতীদেহের মতো খণ্ড খণ্ড হয়ে ছড়িয়ে সারা বিশ্বে। তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে বিশ্বজোড়া এক জাল। ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব। আগের মতো নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাটা আর উল্লম্ব নেই, আনুভূমিক হয়ে গেছে। আমরা দেখব, উৎপাদন ব্যবস্থার মতো আন্দোলনের ক্ষেত্রেও আমরা উল্লম্ব যুগ ছেড়ে এক আনুভূমিক যুগে প্রবেশ করেছি।

মানুষের কণ্ঠস্বরকে যতই দমিয়ে রাখার চেষ্টা হোক, তা নিত্যনতুন পথে প্রকাশিত হবেই। বিগত পাঁচ বছরে ভারতের দিকে তাকালে খুঁজে পাওয়া যায় এক নতুন গণতান্ত্রিক পরিসরকে।

পাঁচ বছর আগে সিএএ-এনআরসি বিরোধিতার ফলে নয়াদিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া ও উত্তরপ্রদেশের আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরস্ত্র মুসলিম ছাত্রদের উপর নেমে আসে পুলিশি সন্ত্রাস। জামিয়ার ছেলেদের বাঁচাতে সে দিন পুলিশের লাঠির সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন কয়েক জন তরুণী। তার ফলে শাহিন বাগে যে ধর্না কর্মসূচি নেওয়া হয় তার পুরোভাগে ছিলেন সাধারণ নারী। দিল্লির শাহিন বাগের বিলকিস দাদিকে এখনও নিশ্চয়ই বিস্মৃত হয়নি দেশ।

বছরখানেক পরে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ আন্দোলনটি সংঘটিত হয়েছিল। সংসদে প্রায় গায়ের জোরে পাশ হওয়া তিন কালা কানুনের বিরুদ্ধে। টানা দেড় বছর শীত-রোদ-ঝড়জল উপেক্ষা করে লক্ষ কৃষক মাটি কামড়ে পড়েছিলেন নয়াদিল্লির উপান্তে। টানা আন্দোলনের ধকল না নিতে পেরে ৭০০ কৃষকের মৃত্যু হয়েছিল। কিন্তু কালা কানুন রদ করিয়ে ছেড়েছিলেন তাঁরা। শাহিন বাগের মতো এই আন্দোলনেও নারীর ভূমিকা ছিল অগ্রণী।

উপরের দু’টি আন্দোলনের মধ্যে সাদৃশ্য কৌতূহলোদ্দীপক। প্রথমত, আন্দোলনগুলির বিকাশ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে অবলম্বন করে। দ্বিতীয়ত, তাতে ভোটকাঙাল রাজনীতির বেবাক অনুপস্থিতি। সুনির্দিষ্ট কিছু দাবি নিয়ে তাদের আবির্ভাব, দাবি মিটে যেতেই গোটা উদ্যোগের অচিরাৎ তিরোভাব।

পশ্চিমবঙ্গের আর জি কর আন্দোলনও কি অনুরূপ? উত্তর দেওয়ার আগে তার ঘটনাক্রম ও গতিপ্রকৃতি বোঝার চেষ্টা করা জরুরি।

৯ অগস্ট আর জি কর ঘটল। গড়ে উঠল ডাক্তারদের ধর্না মঞ্চ। ১২ তারিখ থেকে পশ্চিমবঙ্গের অন্য মেডিক্যাল কলেজে প্রতিবাদ ও রাস্তায় নাগরিক সমাজের জমায়েত মিছিল। ১৪ তারিখে সেই ঐতিহাসিক ‘রাত দখল’ কর্মসূচি। বারাসত থেকে যাদবপুর, রানিগঞ্জ থেকে আসানসোল। রাস্তার মোড়ের দখল নিলেন প্রধানত মেয়েরা।

প্রথম কে দিয়েছিল ডাক— এই প্রশ্ন অবান্তর। মেয়েদের ডাকে রাস্তায় নেমেছেন মেয়েরা। শাহিন বাগ ও পঞ্জাবের কৃষকদের মতো মেয়েরা চাইছেন আন্দোলনের রাশ হাতে তুলে নিতে। ইন্টারনেট সক্ষমতা ও নারীর অর্ধেক আকাশ এই আন্দোলনের দুই গুরুত্বপূর্ণ দিকচিহ্ন।

আন্তর্জালে সংগঠিত আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য হল এর আনুভূমিক গঠন। বার্তা উপর থেকে আসে না, আসে না কোনও নেতা বা দলের কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে। পাশ থেকে আসে— বলা ভাল, চার পাশ থেকে। রাস্তাঘাট, রেলপথ, আকাশপথ, টেলিফোন যোগাযোগ সবই জালের মতো বিন্যস্ত হয়ে মানুষকে একে অপরের যেমন নিকটবর্তী করেছে তেমনই করছে নিয়ন্ত্রণ, করছে বিবিধ উদ্যোগে প্ররোচিতও। এই নেটওয়ার্ক ব্যবস্থার সাম্প্রতিকতম সংযোজন— আন্তর্জাল। যা খণ্ড খণ্ড উদ্যোগগুলিকে— তা উৎপাদন ক্ষেত্রেই হোক বা সমাজ-সাংস্কৃতিক— গেঁথে তাদের পূর্ণতা দান করছে অনেকটা অর্কেস্ট্রা কন্ডাক্টরের মতো।

তা ছাড়া তার ব্যাপ্তিও তো জবরদস্ত। ১৯৭০-এ পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা যা, তার থেকেও বেশি সংখ্যক মানুষ ২০২৪-এ ইন্টারনেট-মাধ্যমে সংযুক্ত। এবং তারা ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপে কোনও না কোনও গ্রুপের সদস্য। এক নয়, একাধিক। পাড়া, ক্লাব, হাউজ়িং বা ইস্কুল-কলেজের প্রাক্তনী— নানা ক্ষেত্র ও আগ্রহকে ঘিরে সমাপতিত অসংখ্য এক-একটি বৃত্ত। বৃত্ত থেকে বৃত্তান্তরে খবর, দাবিদাওয়া, আবেদন, হাসি-মশকরা, কটুকাটব্য মুহূর্তে ভাইরাল হয়। আন্দোলনের শক্তি ও সক্রিয়তার মাপক খবরের এই ভাইরাল হওয়ার ক্ষমতা। এটি বিকশিত হয় খুব দ্রুত। এবং কাজ ফুরিয়ে গেলে তিরোহিত হয় লহমায়। এই আবির্ভাব ও তিরোভাব— দুটোই হয় প্রায় নিঃসাড়ে।

অতএব আন্দোলনকে সংগঠিত হতে আর নেতার দরকার নেই। দরকার নেই প্রতিষ্ঠিত দলের। কয়েক জন মিলে কর্মসূচি ও মিটিং ভেনু ঠিক করুন। তার পর সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দিন। আবেদনের প্রাসঙ্গিকতা ও দম থাকলে মানুষ নিজে এসে জুটে যাবেন। মানুষ জুটে যাওয়ার প্রসঙ্গে বলি, এই আন্দোলনে রাস্তায় নামা একটা বিরাট অংশ কিন্তু মাঝবয়সি বা প্রবীণ। অর্থাৎ যাঁরা ঈষৎ ঝাড়া হাত-পা বা যাঁদের পেশা-জীবনের দাবি কম। দিকে দিকে, কলকাতার ভিতরে ও বাইরে দেখা গেল জাত-ধর্ম-শ্রেণি-প্রজন্ম নির্বিশেষে মানুষের প্রতিবাদী উদ্যোগ। তার ভাষা সঙ্কীর্ণ অর্থে অরাজনৈতিক ও ঈষৎ নৈতিকতার গন্ধ মিশ্রিত। হতপ্রাণ ও ধর্ষিতা চিকিৎসক হয়ে উঠলেন এই বাংলা, গুন্ডামি-কবলিত দুর্নীতি-দীর্ণ গোটা এক লাঞ্ছিত রাজ্যের প্রতীক।

রাস্তার মোড়ে মোড়ে জনতার উৎসাহে আয়োজিত হল নাচ গান ও পথনাটিকা। দক্ষিণ দিনাজপুরে পথে কীর্তন ভক্তেরা। আসানসোলে ‘পশ্চিমবঙ্গ বাউড়ি সমাজ’। প্রতিবাদের তীব্রতা ও বিস্তৃতিটা এতে বোঝা যায়। রাঢ় অঞ্চলের লোকগীত ভাদুগানেও স্থান করে নিয়েছে আর জি কর কাণ্ড।

আন্দোলনের সাফল্য বোঝা যায় প্রতীকের সফল নির্মাণে। ইন্টারনেট মাধ্যম সরকার-বিরোধী মিমে ভরে উঠল এই আন্দোলনের প্রতীক ‘শিরদাঁড়া’কে নিয়ে। রাজ্যের স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা ভরে গেছে ‘আগাছা ও জঙ্গল’-এ। ঝাঁটার প্রতীক নিয়ে ডাক্তাররা গেলেন ‘স্বাস্থ্যভবন সাফাই অভিযান’-এ। সাধারণ মানুষ এগিয়ে এলেন হাতে পাখা ও খাবার নিয়ে, সাহায্য এল উপর থেকে নয়, আশপাশ থেকে। এমন সমান্তরাল ব্যবস্থা ও প্রক্রিয়া এই বাংলার মানুষের অভিজ্ঞতায় একদম নতুন।

সারা বিশ্ব জুড়েই আন্দোলনের ভবিষ্যৎ এখন নব্য-নাগরিক এই নেটিজ়েনদের হাতে। এবং তা সংঘটিত হবে নগরেই। গ্রামে নয়, কারণ নগর ক্রম-প্রসারী। এই আন্দোলনের ব্যাকরণ আমার-আপনার চেয়ে ঢের ভাল বোঝেন এই তরুণরা। মিশরের তাহরির স্ক্যোয়ার, ফ্রান্সের
ইয়েলো জ্যাকেট, টিউনিজ়িয়ার বার্দো, আমেরিকার অকুপাই, এমনকি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রক্তক্ষয়ী পট পরিবর্তন শিখিয়েছে এর সার্থকতা। এবং আমাদের আরও শিখিয়েছে যে, যখনই ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবাদী স্বার্থপর নাগরিক কোনও সামূহিক উদ্যোগে জড়িয়ে পড়ে, কোনও এক মন্ত্রবলে সে কেমন যেন বদলে যায় সহসা। লক্ষ মাথা
মিলেমিশে তৈরি হয় যেন একটিমাত্র মাথা। আন্দোলন মিটে গেলে আবার সে ফিরে যায় তার ‘কান্নার শূন্য খাঁচা’য়।

আরও পড়ুন
Advertisement