এত পোশাক ক্রয়, উৎপাদন ও অপচয়ের মধ্যে পরিবেশের বড় ক্ষতি
Fashion

রোজ চাই নতুন পোশাক

একটি ভাল মানের পোশাকের ক্ষেত্রে সৌন্দর্য, আরামের পাশাপাশি তার টেকসই হওয়াটাও জরুরি। পরতে পরতে পোশাকটির রং নষ্ট হবে, এক সময় ছিঁড়ে যাবে, তবেই তার পরিপূর্ণ ব্যবহার হবে।

Advertisement
রূপালী গঙ্গোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০২২ ০৫:০৪
একটি ভাল মানের পোশাকের ক্ষেত্রে সৌন্দর্য, আরামের পাশাপাশি তার টেকসই হওয়াটাও জরুরি।

একটি ভাল মানের পোশাকের ক্ষেত্রে সৌন্দর্য, আরামের পাশাপাশি তার টেকসই হওয়াটাও জরুরি। ফাইল চিত্র।

“হে আলেখ্য, অপচয় চিরকাল পৃথিবীতে আছে;

এই যে অমেয় জল-মেঘে মেঘে তনুভূত জল-

Advertisement

এর কতোটুকু আর ফসলের দেহে আসে বলো?

ফসলের ঋতুতে অধিকাংশ শুষে নেয় মাটি…”

(ফিরে এসো চাকা, ৬, বিনয় মজুমদার)

শব্দটা হল ‘অপচয়’। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পরিমাণে সংগ্রহ করে শেষ অবধি নষ্ট করা। শব্দটা আমাদের বিব্রত করে; নানা রকম প্রশ্ন, সংশয় এবং অপরাধবোধের মুখে ফেলে দেয়। খাদ্যদ্রব্য, জল, শক্তি, অর্থ, ইত্যাদি সম্পদ বিষয়ে অপচয় ও তজ্জনিত ক্ষতির হিসাব দিতে প্রায়ই আমাদের মাথা হেঁট হয়। কারণ, এই অপচয় আমাদের মৌলিক ভান্ডারকে ধ্বংস করে। কিন্তু আলমারি ভর্তি জামাকাপড় নিয়েও যে অভিযোগের আঙুল উঠতে পারে, সে কথা কে-ই বা ভেবেছিল!

একটি ভাল মানের পোশাকের ক্ষেত্রে সৌন্দর্য, আরামের পাশাপাশি তার টেকসই হওয়াটাও জরুরি। পরতে পরতে পোশাকটির রং নষ্ট হবে, এক সময় ছিঁড়ে যাবে, তবেই তার পরিপূর্ণ ব্যবহার হবে। এই হিসাবে একটি পোশাকের গড় আয়ুষ্কাল নাকি তিন বছর। গত কয়েক দশকে পোশাকের মানের যেমন উন্নতি হয়েছে তেমনই এক শ্রেণির ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। অনলাইনের সুযোগ আসায় ইচ্ছেমতো কিনে ফেলাও সহজ হয়েছে। এর সম্মিলিত ফল হল মানুষ ক্রমাগতই প্রয়োজনের থেকে অনেক বেশি পোশাক কিনছেন। শরীর ঢাকার মৌলিক প্রয়োজন থেকে সরে নিজেকে সাজানোর অতিমৌলিক প্রয়োজনকেও ছাড়িয়ে পোশাক এখন একটা বাতিক বা অধিকার (পজ়েশন) হয়ে উঠেছে। যে কোনও সচ্ছল মহিলার পোশাকের আলমারি খুললে যে শব্দটা প্রথম মাথায় আসে তা হল ‘সঞ্চয়’ বা ‘কালেকশন’। থরে থরে সাজানো নানা রঙের, ধরনের, তন্তুতে বোনা পোশাক পরে, দেখে এবং দেখিয়ে এক জন যে আনন্দ পান, তা-ই তাঁকে এই কালেকশন গড়ে তুলতে এবং বাড়িয়ে চলতে উৎসাহিত করে। কিন্তু এই জামাকাপড়ের কতটুকু ঠিক ভাবে পরে ওঠা হয়? যাঁর পোশাক যত বেশি, প্রতিটি পোশাক বার বার পরার সম্ভাবনা তাঁর ক্ষেত্রে তত কম। এক সময় মধ্যবিত্ত পরিবারে মহিলারা যে কোনও বিয়েবাড়িতে নিজের বিয়ের দু’টি বেনারসি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পরতেন। মেয়েরাও মায়ের বেনারসি পরত। এখন একই পোশাক বার বার পরার কথা ভাবাই যায় না। তাতে জীবনে বৈচিত্র এসেছে (যেটা খুবই দরকার) ঠিকই, কিন্তু এক জন মহিলা এখন জীবনে মাত্র কয়েক বার বেনারসি শাড়ি পরছেন। মানে, প্রিয় পোশাক এখন কিছুটা নষ্ট হওয়া অবধিও ব্যবহার করা হয় না। পছন্দের ‘তোলা’ জামাকাপড় প্রায় নতুন অবস্থায় আলমারির তাকে অপেক্ষা করে থাকে, গায়ে ছোট হয়ে যায় (শাড়ি বাদে), কিন্তু মায়া ত্যাগ করে কাউকে দেওয়াও হয় না।

এই ছবির একটা উল্টো পিঠও আছে, যেখানে একটা নতুন পোশাক দ্রুত বাতিল হয়ে যায়। কারণ, নতুন পোশাকের প্রতি মানুষের অমোঘ ও অনিয়ন্ত্রিত আকর্ষণ বহুগুণ বাড়িয়ে তুলতে সক্রিয় হয়েছে ফ্যাশন শিল্পক্ষেত্র। নামকরা ‘ডিজ়াইনার হাউস’, যারা এক সময় বছরে দু’-তিন বার ৪-৬টা নতুন ডিজ়াইন বাজারে আনত, এখন তারা প্রায় দু’-তিন সপ্তাহ পর পরই নতুন ডিজ়াইন আনছে। ফলে নিত্যনতুন পোশাকের প্রদর্শনবিলাসীরা প্রতি দু’-তিন সপ্তাহের মধ্যেই নতুন পোশাক কিনতে দৌড়চ্ছেন, কিন্তু তাঁদের কোনও পোশাকই পুরনো হতে পারছে না, স্বল্পব্যবহৃত হয়ে পড়ে থাকছে। আর ফুলেফেঁপে উঠছে ফ্যাশন-বাণিজ্য।

ফ্যাশনের এই প্রবাহ কিন্তু শুধু ‘দামভারী’ শপিং মলেই আটকে থাকে না। বরং যে কোনও ‘ডিজ়াইনার’ পোশাক বাজারে আসার কিছু দিনের মধ্যেই তার নকল ছেয়ে ফেলে গড়িয়াহাট কিংবা হাতিবাগানের ফুটপাত এবং খুব তাড়াতাড়ি সে সব পোশাক সরেও যায় নতুন পোশাকের প্রবাহে। সস্তায় ‘ট্রেন্ডি’ জামাকাপড় ধারাবাহিক ভাবে সরবরাহ করার এই বাণিজ্যিক মডেলের নাম ‘ফাস্ট ফ্যাশন’। ডিজ়াইনারের অন্দরমহল বা ফ্যাশন শো থেকে ডিজ়াইনকে সরাসরি পথের পোশাকে নামিয়ে আনার এই বাণিজ্যে জুড়ে আছে বেশ কিছু দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড এবং অসংখ্য নামহীন স্থানীয় কারখানা ও কারিগরেরা। কম দামি উপাদান আর আরও কম মজুরির শ্রম ব্যবহার করে উৎপন্ন হওয়া এই পোশাক দেখতে দামি, আসলে সস্তা, চরিত্রে ক্ষণস্থায়ী। তাই গুণমানে খাটো হলেও কেউ বিশেষ মাথা ঘামান না। শুধু দ্রুত বদলে যাওয়া ফ্যাশনপ্রবাহ ক্রেতার মনে এক কৃত্রিম চাহিদার অভ্যাস গড়ে তোলে, যার দাবিতে মানুষ অনবরত কিনে চলে।

ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে অর্থনৈতিক উন্নতির সূচক। কিন্তু রানির ঘরের বস্ত্রসম্পদ টুনির ঘরে পৌঁছে দেওয়ার মায়া সৃষ্টি করতে গিয়েও দেখা যাচ্ছে মূল্য দিতে হচ্ছে পরিবেশের ঘর থেকে। কাপড় বোনার জন্য দরকারি কার্পাস তুলোর চাষে শুধু প্রচুর জল খরচই হয় না, তাকে পোকার হাত থেকে বাঁচাতে প্রচুর কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয়। তা ছাড়া কাপড় রাঙাতে দরকারি রাসায়নিক রং নদী ও সমুদ্রে মিশে দূষণ ঘটায়। তাই ভাল মানের পোশাকও পরিবেশের দিক থেকে একটি ‘মূল্যবান’ সামগ্রী। আর ফাস্ট ফ্যাশনের চলতি হাওয়ার পন্থী যে সব পোশাক, তাদের বেশির ভাগ কৃত্রিম পলিয়েস্টার জাতীয় তন্তুতে তৈরি, যার উৎপাদনে প্রচুর জল ও জীবাশ্ম জ্বালানি খরচ হয়, দহনে পরিবেশে গ্রিনহাউস গ্যাস মেশে, ফেলে রাখলে সহজে নষ্ট না হয়ে জমি ভরিয়ে চলে, তার অংশবিশেষ সমুদ্রের জলে ‘মাইক্রোপ্লাস্টিক’ হিসেবে মিশে সামুদ্রিক প্রাণীদের মধ্যে নানা ব্যাধির সৃষ্টি করে। কৃত্রিম রেশম তৈরিতে ব্যবহার হয় ‘ভিসকোজ় রেয়ন’, যা কাঠের মণ্ড থেকে বানানো হয়। তার উৎপাদনের চাপে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বনভূমি। পোশাক তৈরির সময়েও টুকরো ছাঁট কাপড়, বাতিল পোশাক ও কাপড়, সুতো, নমুনা সব মিলে একটা বিরাট পরিমাণে বর্জ্য উৎপাদন হয়। এমন বহুমুখী ক্ষতিকর বস্তুর এমন লাগামছাড়া উৎপাদনের আগে সত্যিই অনেক কিছু ভাবা দরকার।

ফাস্ট ফ্যাশনের ধাক্কায় তৈরি হওয়া এই পোশাক সম্ভারের অনেকটাই বিক্রি হয় না, অথচ কিছু দিনের মধ্যে কোনও দোকানে এদের চিহ্ন দেখা যায় না। বেশির ভাগটাই পুড়িয়ে দেওয়া হয়, কিংবা আবর্জনা হিসেবে ফেলে জমি ভরাট করা হয়। অল্প কিছু ‘ডাউনসাইকলড’ হয়ে পাপোশ, গদি, ঝোলা ইত্যাদি কমদামি জিনিস বানাতে, ঘরমোছা, স্যানিটারি ন্যাপকিনের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার হয়। আর মাত্র ১% ‘আপসাইকলড’ হয়ে নতুন পোশাকে পরিণত হয়। এত ক্ষতি স্বীকার করে উৎপন্ন এই বস্ত্রসম্ভার, যার অনেকটা পড়ে থাকে, বা নষ্ট করে দিতে হয়, সত্যি কি তার খুব প্রয়োজন আছে? এ কি অপচয় না?

সুখের কথা, ‘ফাস্ট ফ্যাশন’-এর বিপরীতে ‘স্লো ফ্যাশন’-এর ধারণাটিও আস্তে আস্তে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। উন্নত মানের, পরিবেশবান্ধব, টেকসই ও আরামদায়ক জামাকাপড় এই ধারণার উপযোগী। তবে গড়ে ওঠা অভ্যাস এক-দু’দিনে বদলায় না। তাই আমরা এখনই পোশাকের ব্যাপারে সব মোহ ত্যাগ করতে পারব না। বরং, বাতিল পোশাক কাজে লাগানোর চেষ্টাটাই সবচেয়ে দরকারি। সহজতম উপায়, পোশাকটি ভাল থাকতে থাকতে কাউকে দিয়ে দেওয়া। তা ছাড়া হস্তশিল্পের মাধ্যমে পুরনো পোশাক ও পুরনো কাপড়ের তৈরি জিনিস কতটা সুন্দর ও ব্যবহারযোগ্য করে তোলা যায়, তাও একটা চর্চার বিষয়। বিভিন্ন কোম্পানি পুরনো পোশাক সেলাই করে, নানা ভাবে নতুন করে তোলেন। দেশীয় বিভিন্ন সংস্থার অধীনে অনামী স্থানীয় হস্তশিল্পীরাও এই কাজ করেন। এই ভাবে নতুন জামা পরার কারণে পরিবেশের ক্ষতি কতটা রদ করা যায়, সেটাই লক্ষ্য।

তবে সংযত আমাদের হতেই হবে। প্রথমত, স্টাইল আর ফ্যাশনের তফাত আমাদের জানা। এক জন মানুষকে আলাদা করে তোলে তার স্টাইল, ফ্যাশন নয়। কেউ নিত্যনতুন দামি শাড়ি কেনেন, কেউ মা-ঠাকুমার বিয়ের শাড়ি একটু বদলে নিজের বিয়েতে পরেন। সেটাই স্টাইল। দ্বিতীয়ত, টাকা আমার কিন্তু পরিবেশ শুধু আমার নয়; তাই একটা পোশাক কেনার আগে ভাবতেই হবে এর প্রকৃত মূল্য কতটা আর সত্যিই কেনাটা দরকার কি না। লাগামছাড়া পোশাকপ্রীতি যে আমাদের পরিবেশের এতটা ক্ষতি করছে সেটা জেনে রাখা, মনে রাখা এবং বেচা-কেনা নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের সম্মিলিত কর্তব্য।

সিস্টার নিবেদিতা ইউনিভার্সিটি

আরও পড়ুন
Advertisement