জনতার ভোটে নির্বাচন কমিশনার বেছে নেওয়া হোক
Election Commissioner

আস্থা অর্জনই প্রথম দায়িত্ব

বর্তমানে ভারতের তিন নির্বাচন কমিশনার— জ্ঞানেশ কুমার, সুখবীর সিংহ সান্ধু এবং বিবেক জোশী— প্রত্যেকেই ছিলেন আইএএস অফিসার। তাঁদের তিন পূর্বসূরিও ছিলেন আইএএস বা আইআরএস অফিসার।

Advertisement
অর্ঘ্য সেনগুপ্ত
শেষ আপডেট: ২৮ মার্চ ২০২৫ ০৬:৪৫

কল্পনা করুন, নির্বাচন কমিশনে তিন জন অচেনা এবং অজানা অফিসারের জায়গায় যদি থাকতেন এই তিন সুপরিচিত, সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি— এক, সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি বি এন শ্রীকৃষ্ণ, যিনি বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর মুম্বই দাঙ্গার বিষয়ে সাহসিকতার সঙ্গে তদন্ত চালিয়েছিলেন; দুই, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রাক্তন চিফ সায়েন্টিস্ট সৌম্যা স্বামীনাথন, যিনি কোভিড-১৯ অতিমারির বিরুদ্ধে লড়েছিলেন; এবং তিন, এইচডিএফসি-র প্রাক্তন চেয়ারম্যান দীপক পারেখ, যিনি দীর্ঘ সময় ধরে সুনামের সঙ্গে ভারতের অন্যতম বৃহৎ আর্থিক সংস্থাটি পরিচালনা করেছেন। প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে দক্ষ, এবং প্রভাবশালী পদে থাকা সত্ত্বেও বরাবরই সম্পূর্ণ ভাবে রাজনীতির ঊর্ধ্বে থেকেছেন। কিন্তু, ভাবতে পারেন কি, নির্বাচন কমিশনার হিসাবে তাঁদের নিয়োগ করা হবে? এমন চিন্তা আজ এক প্রকার অবাস্তব বলে মনে হয়।

Advertisement

বর্তমানে ভারতের তিন নির্বাচন কমিশনার— জ্ঞানেশ কুমার, সুখবীর সিংহ সান্ধু এবং বিবেক জোশী— প্রত্যেকেই ছিলেন আইএএস অফিসার। তাঁদের তিন পূর্বসূরিও ছিলেন আইএএস বা আইআরএস অফিসার। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, একমাত্র এক জন বিচারপতি ও এক জন আইনজীবী ছাড়া, বাকি ছাব্বিশ জন মুখ্য নির্বাচন কমিশনারই ছিলেন সরকারি আমলা। ভি এস রমা দেবী ছাড়া বাকিরা সবাই পুরুষ। এটি সত্যি যে, দীর্ঘ প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা নির্বাচনী কাজকর্ম তদারকির জন্য উপকারী। কিন্তু নির্বাচন কমিশনারের কাজ কি কেবল ভোটকেন্দ্রে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা আর সময়মতো ফল ঘোষণা করার মধ্যে সীমাবদ্ধ? আসলে, নির্বাচন হল এমন একটি প্রক্রিয়া, যাতে নাগরিকদের নিঃশর্ত আস্থা থাকা শুধু জরুরি নয়, অপরিহার্য। সেই আস্থা বজায় রাখাই নির্বাচন কমিশনারের প্রধান কর্তব্য।

ভারতে অভিজ্ঞ অফিসারদের প্রতি আস্থা রাখা পোষণ করা দীর্ঘ দিনের রীতি। যুক্তি হল— অফিসাররা নিরপেক্ষ প্রশাসক; শিক্ষিত, কঠিন পরীক্ষা পাশ করেছেন; প্রযুক্তিনির্ভর চিন্তায় দক্ষ; এবং জনসেবার আদর্শে অনুপ্রাণিত। এ সবের সঙ্গে প্রশাসনিক দক্ষতা জুড়লে তাঁদের নির্বাচন কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় যোগ্য মনে করা হয়।

কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই অফিসার-কমিশনারদের নিরপেক্ষতায় বিশ্বাস অনেকাংশে কমে গেছে। এত দিন তাঁদের ব্যক্তিগত জীবন বা দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়ে আমরা বিশেষ কিছু জানতাম না; অজ্ঞতা থেকেই হয়তো আস্থা জন্মাত। এখন অনেক তথ্য সহজলভ্য হওয়ায়, সরকার আরও অজানা বা অন্তরালে থাকা ব্যক্তিদের নিযুক্ত করছে। অথচ তথ্যের যুগে অজ্ঞতা দিয়ে আস্থা অর্জন করা অসম্ভব। আস্থা আসে যোগ্যতা এবং তার সুস্পষ্ট প্রমাণের মাধ্যমে। ব্যতিক্রম হিসাবে টি এন শেষন নিজ দক্ষতায় খ্যাতিলাভ করলেও, আজকের দিনে নিছক সুশীল অফিসার কেবল তাঁর অভিজ্ঞতার দরুন জনসাধারণের আস্থা অর্জন করতে অক্ষম।

এই পরিপ্রেক্ষিতেই দেখা যাচ্ছে, সম্প্রতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ তুলেছেন যে, পশ্চিমবঙ্গে ভোটার তালিকায় বহিরাগতদের নাম ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। দিল্লি নির্বাচনের পর, আম আদমি পার্টি উল্টো অভিযোগ করেছে যে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বহু নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। উভয় ক্ষেত্রেই অভিযোগ, এগুলি নাকি বিজেপির স্বার্থে করা হয়েছে আর নির্বাচন কমিশন নীরব দর্শক হয়ে আছে। এ ধরনের অভিযোগ এখন খুবই সাধারণ হয়ে উঠেছে এবং ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। এর মানে এই নয় যে, আগে এ ধরনের অনিয়ম ঘটেনি। তবে এখন এগুলো এমন মাত্রায় পৌঁছেছে যে, প্রতি বার নতুন অভিযোগ উঠলেই মানুষের নির্বাচনের স্বচ্ছতা সম্পর্কে আস্থা আর একটু কমে যায়। এর কারণ, অভিযোগের মূল হল নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা নিয়ে একটি গভীর সন্দেহ। যত ক্ষণ না নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগের জন্য একটি নতুন পদ্ধতি তৈরি হচ্ছে, তত ক্ষণ এই সন্দেহ নিরসনের কোনও উপায় নেই।

দুঃখজনক হল, এই জায়গাতেই আমাদের সমবেত কল্পনাশক্তি অত্যন্ত সীমিত। সুপ্রিম কোর্টে এবং জনপরিসরের আলোচনা, দুই ক্ষেত্রেই একটা কথা বার বার শোনা যায়: নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলনেতার সঙ্গে প্রধান বিচারপতিকে (বা অন্য কোনও নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে) রাখার প্রস্তাব। এই ‘কলেজিয়াম’ পদ্ধতি দেখে অনেকে উচ্ছ্বসিত হন। কিন্তু, যে সব প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে নিয়োগের জন্য এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছে— যেমন সিবিআই ও লোকপাল— তেমন প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে, প্রশ্ন আছে। এই ব্যবস্থায় বেশির ভাগ মানুষের প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আস্থা বা ধারণা বদলায়নি। সিবিআই ও লোকপালের মতো প্রতিষ্ঠানগুলি প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি লোধার কথায় ‘খাঁচায় বন্দি তোতাপাখি’-র মতো রয়ে গেছে। উদাহরণস্বরূপ আর জি কর-কাণ্ডে সিবিআই-এর গাফিলতির কথা উল্লেখ করা যায়। সুতরাং, নিছক নিয়োগ পদ্ধতি সামান্য ঘুরিয়ে দিলেই নির্বাচন কমিশনের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার হবে, এমনটা ভাবা ঠিক নয়।

এর মানে এই নয় যে, কিছুই করা উচিত নয়। প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা ধীরে ধীরে ফিরিয়ে আনতে হবে, যদিও সেটা দ্রুত ফল দেবে এমন চিন্তা অবাস্তব। আর এটা কোনও আদালত-নির্ভর উদ্ধারকার্য হতে পারে না। রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে থেকেই এই উদ্যোগ করতে হবে। দুর্ভাগ্যক্রমে, যেখানে রাজনীতির কাজ হওয়া উচিত এই গণতান্ত্রিক মেরুদণ্ডসম প্রতিষ্ঠানকে পুনরুজ্জীবিত করা, সেখানে সরকার একটা আইন এনেছে যা কার্যত সরকারের নিয়ন্ত্রণের কর্তৃত্ব পাকাপোক্ত করে। রাজনীতি জনমতের প্রতি সাড়া দিয়ে সমাধান হাজির করে— এটাই কাম্য। কিন্তু এখানে মনে হচ্ছে, সরকার বিরোধীদের অভিযোগকে গুরুত্ব না দিয়ে স্রেফ উড়িয়ে দিচ্ছে।

এই সমালোচনাগুলোর একমাত্র উত্তর— এমন একটি নিয়োগ ও পরিচালনার পদ্ধতি, যা সরকার নিজে মেনে চলতে পারবে এবং একই সঙ্গে সকল পক্ষের আস্থা অর্জন করবে। কেন এমন হয় না যে, সরকার যে সব নাম বাছাই করল, তাঁদের ‘মন কি বাত’-এ আমন্ত্রণ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী তাঁদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করলেন, তার পর ‘মাইগভ’ প্ল্যাটফর্মে নাগরিকরা ভোটের মাধ্যমে পছন্দের প্রার্থী নির্বাচন করলেন? আবার অন্য ভাবে, কেন একটা ভারতরত্নপ্রাপ্তদের কমিটি গঠন করা যায় না, যা তিন জন সৎ ও শুদ্ধ স্বভাবের প্রযুক্তিবিদকে নিয়োগ করবে ইভিএম-গুলি পরীক্ষা করার জন্য?

নির্বাচন কমিশনের কাজ কেবল ভোটার তালিকা সঠিক রাখা বা ইভিএম চালানো নয়— যদিও এ কাজগুলি গুরুত্বপূর্ণ, এবং কমিশনের স্থায়ী কর্মীদের প্রধান দায়িত্ব। নেতৃত্বের কাজ হল যে কোনও পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের মধ্যে নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে অনড় আস্থা বজায় রাখা। কিছু অফিসার হয়তো এই প্রয়োজনীয়তা পূরণ করতে পারবেন, কিন্তু অন্যরা পারবেন না। সামান্য কয়েকটি বদল বা সংশোধন পর্যাপ্ত হবে না— দরকার একেবারে নতুন ও বৈপ্লবিক চিন্তাভাবনা।

বিধি সেন্টার ফর লিগাল পলিসি। মতামত ব্যক্তিগত।

Advertisement
আরও পড়ুন