Teesta River Agreement

তিস্তা চুক্তির জট কাটার নয়

দুই বাংলার মানুষের প্রয়োজনমতো তিস্তার জল সরবরাহ করতে গেলে দরকার এই রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তের বাইরে বেরিয়ে নতুন ভাবে ভাবা।

Advertisement
জয়ন্ত বসু
শেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০২২ ০৬:০৫
তিস্তা নদী।

তিস্তা নদী।

ভারত, বাংলাদেশ নিয়ে যে কোনও আলোচনা তিস্তা নদীতে গিয়ে থমকে যাবে, গত এক দশক ধরে সেটাই দস্তুর। সম্প্রতি নরেন্দ্র মোদী ও শেখ হাসিনার দিল্লি বৈঠকেও তার অন্যথা হয়নি। দু’দেশের প্রধানমন্ত্রী কুশিয়ারা নদীর জলবণ্টন-সহ সাতটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও, বৈঠক শেষে প্রকাশিত যৌথ বিবৃতিতে ৩৩টি বিষয়ের মধ্যে চোদ্দো নম্বরে স্থান পাওয়া ‘না হওয়া’ তিস্তা চুক্তিই আরও এক বার হেডলাইনে।

আদৌ কি দু’দেশ, বিশেষ করে ভারত, এই অচলাবস্থা কাটাতে উৎসাহী? ১৯৮৩ সালে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি অস্থায়ী চুক্তি হয়। ২০১১ সালে আর একটি তিস্তা চুক্তির খসড়া তৈরি করে দুই দেশ, যেখানে শুখা মরসুমে ভারতের ৩৭.৫ শতাংশ এবং বাংলাদেশের ৪২.৫ শতাংশ জল পাওয়ার কথা হয়। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই চুক্তির বিরোধিতা করেন পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থহানির যুক্তি দেখিয়ে। যে-হেতু জল বিষয়টি ভারতের সংবিধান অনুযায়ী রাজ্যের অধিকারভুক্ত, তাই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর আপত্তি সত্ত্বেও এই চুক্তি সম্ভব নয়। বাংলাদেশের মানুষের একটা বড় অংশের ধারণা, এবং ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার সেই ধারণাকে প্রশ্রয় দেয় যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রের বিরোধিতা করতে গিয়ে এই চুক্তি আটকে রেখেছেন, যেটি সম্পূর্ণ ঠিক নয়। যদিও মমতা মনে করেন, গঙ্গা চুক্তিতে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে যে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল, তা তিস্তার ক্ষেত্রে হয়নি।

Advertisement

২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নিজস্ব রিপোর্টে বলা হয় যে, দুই বাংলার তিস্তা পারের চাষিদের শুখা মরসুমে যে জলের প্রয়োজন, তার ১৬ ভাগের এক ভাগও তিস্তায় থাকে না। গত এক দশকে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। পাশাপাশি গোটা সিকিম জুড়ে অজস্র জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নদীটিকে প্রায় খুন করার জোগাড় করেছে। অন্য দিকে, তিস্তার জন্মস্থানের কাছাকাছি থাকা অধিকাংশ হিমবাহ জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায় গলতে শুরু করেছে। ফলে নদীর শুরুতে জলের পরিমাণ কমছে। আশির দশকের গোড়া থেকেই তিস্তা ক্রমেই শীর্ণকায়া হচ্ছে, গজলডোবা ব্যারাজের ঠিক আগে তিস্তা-মহানন্দা লিঙ্ক ক্যানাল দিয়ে জল পাঠানো এই প্রবণতাকে বাড়িয়েছে মাত্র। শিলিগুড়ি-সহ উত্তরবঙ্গের এক বড় অংশের মানুষ নির্ভরশীল এই জলের উপর। এই তথ্যগুলির উপর দাঁড়িয়ে তিস্তা চুক্তির আলোচনা এগোনোর কথা থাকলেও তা গত এক দশক ধরে রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তে আটকে আছে।

সম্প্রতি দুই প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাপত্রের দিকে তাকালেও এই নদী রাজনীতি স্পষ্ট হবে। অসমকে ঘিরে কুশিয়ারা নদীর জলবণ্টন চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে, আর আগামী দিনে ত্রিপুরার ফেনি নদী নিয়ে চুক্তির কথা বলা হয়েছে। এটা নিছক কাকতালীয় নয় যে, দু’টি রাজ্যেই বর্তমানে বিজেপি সরকার। উল্টো দিকে, তিস্তা চুক্তি নিয়ে কখনও কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে বসে মীমাংসা সূত্র বার করার চেষ্টা করেছে, এমনটা জানা নেই। আসলে, ২০১১ সালের খসড়া অনুযায়ী তিস্তা চুক্তি করে ফেলাটা যেমন শেখ হাসিনার দেশীয় রাজনীতিতে শক্তিশালী হওয়ার জন্য প্রয়োজন, তেমনই না হওয়াটা জরুরি মোদী-মমতার অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সমীকরণে। ঐতিহাসিক ভাবেই মমতার রাজনৈতিক প্রভাব দক্ষিণবঙ্গের তুলনায় উত্তরবঙ্গে কম। ফলে তিনি যে তিস্তা চুক্তি সম্পাদনে সায় দিয়ে রাজনৈতিক হারাকিরি করতে চাইবেন না, তা স্পষ্ট। পাশাপাশি, পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক উত্তরণের স্বপ্ন দেখা নরেন্দ্র মোদীর পক্ষেও উত্তরবঙ্গকে বঞ্চিত করে বাংলাদেশকে জল দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন।

দুই বাংলার মানুষের প্রয়োজনমতো তিস্তার জল সরবরাহ করতে গেলে দরকার এই রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তের বাইরে বেরিয়ে নতুন ভাবে ভাবা, যে ভাবনায় পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি সিকিমকেও আলোচনায় শামিল করতে হবে। জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলির বেআইনি ভাবে নদী দখল করা আটকাতে হবে। পাশাপাশি, দু’দেশের মধ্যে প্রবাহিত ৫৪টি নদীর অববাহিকার জল কেমন ভাবে ভাগ করা উচিত তা নিয়ে সামগ্রিক সিদ্ধান্তের প্রয়োজন, প্রয়োজন জলবায়ু পরিবর্তনের কথা মাথায় রাখা, ওই অঞ্চলে কৃষির ধরন পাল্টানোর কথা ভাবা বা ভূগর্ভস্থ জলের সদ্ব্যবহার। সম্প্রতি বাংলাদেশে তিস্তার উন্নয়নের জন্য চিনের উৎসাহ ভারতকে চিন্তায় ফেলেছে। ফলে, নরেন্দ্র মোদীর কাছে তিস্তা এখন এক উভয় সঙ্কট। এই ধর্মসঙ্কটে পড়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতাকে বোড়ে সাজিয়ে ‘তিস্তা চুক্তি করতে চাই, কিন্তু পারছি না’ বলা ছাড়া এই মুহূর্তে কেন্দ্রীয় সরকারের অন্য উপায় নেই। এই ফর্মুলা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছেও গ্রহণযোগ্য, কেননা তাতে তাঁর ‘পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থে লড়ে যাচ্ছি’ জাতীয় ভাবমূর্তিতে জলসিঞ্চন হবে। দ্রুতই তিস্তা চুক্তি হবে বলে আশা প্রকাশ করে বিবৃতি দেওয়া ছাড়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও বিশেষ কিছু করার নেই।

আপাতত তিস্তা চুক্তি নাটক চলবে, এটাই ভবিতব্য।

আরও পড়ুন
Advertisement