তা হলে গণতন্ত্রের এখনও কিছু আশা আছে? প্রবল চাপের মুখে সকলেই নুয়ে পড়বেন, শাসক দলের এমন ইচ্ছা থাকলেও তা পুরোটা করা গেল না?
পেগাসাস-কাণ্ডে সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক মন্তব্য ও নির্দেশ এমন একটা আশ্বাস ফিরিয়ে আনল। সাধারণ মানুষের হয়ে দেশের সুপ্রিম কোর্ট রাষ্ট্রশক্তির চোখে চোখ রেখে বলতে পারল, যত ক্ষমতাধর রাষ্ট্রই তুমি হও না কেন, বিচারব্যবস্থা বলে একটা শক্তি এখনও এই দেশে অস্তিত্বশীল।
মোদী সরকার কি পেগাসাস স্পাইওয়্যার কিনেছে? নানা গুরুত্বপূর্ণ মানুষের ফোনে নজরদারি করার জন্য তা ব্যবহার করার অভিযোগটি কি সত্যি? যদি সত্যি হয়, কে তা প্রয়োগের অনুমতি দিল? বিভিন্ন সন্দেহভাজনের উপর নজরদারি চালানোর জন্য এখনই দেশে নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বাহিনীর হাতে যে যে পদ্ধতি আছে তা কি যথেষ্ট নয়? বহু কোটি টাকা খরচ করে ইজ়রায়েলের কাছ থেকে এমন ভয়ঙ্কর স্পাইওয়্যার কেনার আদৌ প্রয়োজন ছিল কি? এবং তা প্রয়োগের জন্য বিরোধী রাজনীতিক, মন্ত্রী, বিচারপতি, নির্বাচন কমিশনার, সমাজ ও মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিকদের বেছে নিতে হল কেন? এঁরা কি সম্ভাব্য অপরাধী? অপরাধটা কি সরকারের বিরোধিতা? ‘সরকার’-বিরোধী, সেই কারণে ‘রাষ্ট্র’-এর চোখেই বিপজ্জনক?
এমন অসংখ্য প্রশ্ন। গণতন্ত্রের স্তম্ভ বলে পরিচিত যে সব প্রতিষ্ঠান আছে, যেমন সংসদ, বিচারবিভাগ, সংবাদমাধ্যম— তারা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলেছে। কিছু দিন আগেই পেগাসাস-কান্ড নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে যখন হলফনামা দিতে বলেছিল সুপ্রিম কোর্ট, জাতীয় নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে তা আদালতে পেশ করতে অস্বীকার করে কেন্দ্র। কেন্দ্রের যুক্তি ছিল, সরকার পেগাসাস কিনেছে কি না, সে কথা জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থেই বলা সম্ভব নয়।
এর পরেই সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দেয়, প্রত্যেক বার ‘জাতীয় নিরাপত্তা’র দোহাই দিয়ে নিস্তার পাওয়া যাবে না। পেগাসাস-কান্ডে সুপ্রিম কোর্ট তাই নিজেই তদন্ত কমিটি গড়ে দিয়েছে। কমিটির নেতৃত্বে থাকছেন সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি রবীন্দ্রন।
জার্মান দার্শনিক কার্ল শ্মিট সার্বভৌমত্বের ভিন্নতর ব্যাখ্যা দিয়ে উনিশশো ত্রিশের দশকে তাঁর দেশের নাৎসি শাসনে গুরুত্ব অর্জন করেছিলেন। তাঁর মত ছিল, যিনি ক্ষমতায় আছেন ক্ষমতা প্রয়োগের ব্যাপারে তিনিই শেষ কথা বলবেন, তাঁর উদ্দেশে কোনও প্রশ্ন করা যাবে না। তিনি কারও কাছেই দায়বদ্ধ নন। বিচারব্যবস্থা, আইন, সংসদীয় ব্যবস্থা— তিনি সবেরই ঊর্ধ্বে।
নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন সরকারের নানা কার্যকলাপ দেখে কার্ল শ্মিট-এর কথা মনে পড়ে গেলে দোষ দেওয়া যায় কি? বাদল অধিবেশনের আগে পেগাসাস নিয়ে উত্তাল হয়ে উঠেছিল সংসদ। বিরোধীরা এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর জবাব দাবি করে। সংসদের অধিবেশন দফায় দফায় ভেস্তে যায়। কিন্তু মোদী বা শাহ, কেউই এ নিয়ে আলোচনার পথে হাঁটার চেষ্টাও করেননি।
সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেই কি সব কিছু এ ভাবে উপেক্ষা করা যায়? না কি বিরুদ্ধ স্বর শুনতে পেলেই ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ আখ্যা দিয়ে জেলে পুরে দিলে সব সমস্যার সমাধান? শাসকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নাগরিক সমাজও একই পথে হাঁটছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ক্রিকেট ম্যাচ জেতার পর উল্লাস করলে এ দেশের নাগরিকরাই ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ তকমা দিয়ে দেয় অনায়াসে!
ইতিহাস বলে, আড়ি পাতা বিষয়টি চিরকালই ছিল। ‘জাতীয় নিরাপত্তা’র জন্য দেশে-বিদেশে রাষ্ট্রশক্তি নানা রূপে ব্যক্তিপরিসরে আড়ি পেতেছে। এর প্রয়োজনীয়তা ও ব্যবহার নিয়ে বিতর্ক আছে বিস্তর— তবু আড়ি পাতা ও সর্বক্ষণ নজরদারি তো এক বিষয় নয়! হতেই পারে না। নির্দিষ্ট কোনও কারণে, বিশেষ করে সন্ত্রাসবাদ রুখতে রাষ্ট্রের আড়ি পাতা এবং ২৪ ঘণ্টা নাগরিককে ‘ডকুমেন্টেড’ করে রাখার মধ্যে তফাত আছে, থাকবে।
আমি-আপনি হোয়াটসঅ্যাপে কী কথোপকথন চালাচ্ছি, কাকে কখন কী বিষয়ে মেল করছি, এই মুহূর্তে কোথায় রয়েছি, কাদের সঙ্গে রয়েছি, আমার পছন্দ-অপছন্দ, কেনাকাটার ধরন, ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রবণতা, কী কী বিষয় নিয়ে ‘সার্চ’ করছি, ‘সংবেদনশীল’ বিষয়ে কার কার সঙ্গে কবে, কত বার, কত ক্ষণ কথা বলেছি, কেন বলেছি, আমার অভিব্যক্তি বা কথা বলার ভঙ্গিমা কেমন, সব আমার-আপনার অগোচরে জেনে নেওয়া আসলে নাগরিক অধিকারের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ। নেট ব্যবহার করে কী কী বিষয়ে কে পড়াশোনা করছে, কেন নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে এত আগ্রহ দেখাচ্ছে, সব বিশ্লেষণ করে দেখা— এটা সরকারের অধিকারের মধ্যে পড়ে না, পড়তে পারে না। এ দিকে আমরা তো প্রযুক্তি ব্যবহারের আরামে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি, সুতরাং এই চক্রব্যূহ থেকে বেরোনোর পথও আমরা জানি না।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের দিকে তাকানো যাক। ২০১১ সালে রাষ্ট্রের সুবিশাল গোপন তথ্যভান্ডার একেবারে জনগণের সামনে ফাঁস করে দেয় উইকিলিকস। সংস্থার কর্ণধার জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ দাবি করেন, প্রশাসন সমেত নেতাদের স্বচ্ছতা বজায় রাখার কাজে বাধ্য করতে এবং দুর্নীতি রুখতে তিনি ও তাঁর টিম এই কাজ করেছেন। হ্যাকিং করে কোনও অন্যায় তিনি করেননি, প্রয়োজনে আবার করবেন।
এর বছর দুয়েক পরে, ২০১৩-য় এডওয়ার্ড স্নোডেন আরও ভয়ঙ্কর জিনিস ফাঁস করে দিলেন। কম্পিউটার বিশারদ হিসাবে স্নোডেন কাজ করতেন আমেরিকার অন্যতম গোয়েন্দা সংস্থা ন্যাশনাল সিকিয়োরিটি এজেন্সি-তে (এনএসএ)। এই সংস্থা মূলত সাইবার দুনিয়ায় কাজ করে। স্নোডেন ফাঁস করে দিলেন, এনএসএ এবং ব্রিটেনের গুপ্তচর সংস্থা গভর্নমেন্ট কমিউনিকেশনস হেডকোয়ার্টার্স (জিসিএইচকিউ) একটি বিরাট কর্পোরেট সংস্থার কাছ থেকে অর্থের বিনিময়ে আমেরিকার নাগরিকদের ফোন-কলের রেকর্ড নিয়মিত ভাবে সংগ্রহ করেছে। ফাইবার অপটিক দিয়ে তৈরি কেবল ‘ট্যাপ’ করে প্রচুর পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ করছে। ব্রিটেন এবং আমেরিকার এক যৌথ প্রকল্পের কথাও ফাঁস করেন স্নোডেন, যার নাম ‘টেম্পোরা’। এর মাধ্যমে দু’দেশের নাগরিকদের টেক্সট মেসেজ, ইমেল যাঁরা ব্যবহার করেন তাঁদের ইন্টারনেট সার্চ করার ইতিহাস, ক্রেডিট কার্ডে কেনাকাটার বিশ্লেষণ সমেত অসংখ্য তথ্য দুই গোয়েন্দা সংস্থার কাছে চলে যাচ্ছে। এবং তা সকলের সম্পূর্ণ অগোচরে। স্নোডেনের এই কাহিনি নিয়ে এক অসামান্য গ্রন্থ রচনা করেন গার্ডিয়ান পত্রিকার সাংবাদিক লিউক হার্ডিং। মস্কোয় ওই পত্রিকার বুরো চিফ হার্ডিংকে তাঁর এক অনুসন্ধানমূলক সাংবাদিকতার জেরে রাশিয়া সে দেশ থেকে বহিষ্কার করেছিল।
সুতরাং, পেগাসাস নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক এই নির্দেশকে স্রেফ আইনি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাখ্যা করলে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ও অভিঘাত অনুধাবন করা যাবে না। গণতন্ত্রের দেশে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নিয়ে শীর্ষ আদালতের মন্তব্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কোর্ট বলেছে, ব্যক্তিগত পরিসরের প্রশ্ন শুধু সাংবাদিক বা রাজনীতিকদের জন্য নয়। এটা ব্যক্তির অধিকারের প্রশ্ন। সব সিদ্ধান্তই সাংবিধানিক প্রক্রিয়া মেনে হওয়া উচিত। বলেছে, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়তে সংস্থাগুলি নজরদারি চালায়। সেখানে ব্যক্তিগত পরিসরে ঢোকার দরকার হতে পারে। সে ক্ষেত্রে সাংবিধানিক প্রক্রিয়া মেনেই প্রযুক্তির ব্যবহারের কথা ভাবতে হবে।
প্রাক্তন অ্যাটর্নি-জেনারেল, প্রখ্যাত আইনজ্ঞ সোলি সোরাবজি ২০১৭-য় এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, যখনই কেন্দ্র জাতীয় নিরাপত্তার প্রসঙ্গ আনে, তখনই সাধারণ বিচারব্যবস্থা তা যাচাই করতে চায় না। পেগাসাস নিয়ে নির্দেশে সুপ্রিম কোর্ট সে দিক দিয়ে উল্লেখযোগ্য। শীর্ষ আদালতের গড়ে দেওয়া তদন্ত কমিটি আট সপ্তাহ পরে কী রিপোর্ট দেবে, বা সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে সরকার আদৌ কী ব্যবস্থা করবে, সে সব পরের প্রশ্ন।
কিন্তু এই বলদর্পী সংখ্যাগরিষ্ঠের গণতন্ত্র থেকে আপাতত কিছুটা শ্বাস নিতে শেখাল বিচারব্যবস্থা, এটাই বা কম কী?