Kite Strings

‘আমার ঘুড়ি কাটবে না’

কাজের জিনিস বটে। মধ্যবিত্ত বাড়িতে দিস্তা কাগজ কিনে খাতা বানানোর সময়, অথবা ঈষৎ ছিঁড়ে যাওয়া ব্যাগের কোণ বা ফিতে সেলাইয়ের সময় তার ডাক পড়ত।

Advertisement
পৌলমী দাস চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৮:৩০

ছাদভর্তি ছড়ানো সুতো। আর এক কোণে, টবের আড়ালে ঘাড় গুঁজে পড়ে থাকা লাল, নীল, সাদা-কালোর ঘুড়ি। কোনও দিন লাটাই-সুতোয় হাত না ছোঁয়ানো আমার কাছে ওইটুকুই বিশ্বকর্মা পুজোর পরম প্রাপ্তি। যত্ন করে কুড়িয়ে আনা ঘুড়ি সাজানো থাকত পুতুল খেলার চিলতে কোণে। আর মাঞ্জা দেওয়া সুতো মোটা কাগজের রোলে ঘুরপাক খেয়ে সেঁধিয়ে যেত মা-ঠাকুমার সেলাইয়ের বাক্সে।

Advertisement

কাজের জিনিস বটে। মধ্যবিত্ত বাড়িতে দিস্তা কাগজ কিনে খাতা বানানোর সময়, অথবা ঈষৎ ছিঁড়ে যাওয়া ব্যাগের কোণ বা ফিতে সেলাইয়ের সময় তার ডাক পড়ত। অসম্ভব মজবুত হওয়ায় চট করে ছিঁড়ত না। সে কালে ঘুড়ি ওড়ানোর দিনকয়েক আগে বাবা-কাকা-দাদারা বাড়িতেই তৈরি করে নিতেন মাঞ্জা সুতো। তাঁদেরই মুখে শুনেছি, ভাল মানের সুতো গোড়ায় ভিজিয়ে নেওয়া হত। তার পর সাবু ফুটিয়ে অথবা অ্যারারুট গুলে তার সঙ্গে মেশানো হত কাচের খুব মিহি পাউডারের মতো গুঁড়ো। সঙ্গে দেওয়া হত রং। ভাল ভাবে মেশানোর পর তৈরি হত মাঞ্জা। সমান ভাবে সেই মাঞ্জা মাখানো হত সুতোয়। মাঠের দু’প্রান্তে বাঁশ বা লম্বা লাঠি পুঁতে মাঞ্জা দেওয়া সুতো তাতে টাঙিয়ে দেওয়া হত। রোদে শুকিয়ে নিলেই লাটাইয়ে জড়ানোর জন্য তৈরি।

তখনও অবশ্য তার খুনে চরিত্রটি ধরা পড়েনি। কড়কড়ে সুতোয় আঙুল চিরেছে বহু বার, কিন্তু তা দিয়ে যে গলা কেটে মৃত্যুও হতে পারে, তেমন ধারণা জন্মায়নি। সেই ধারণা জন্মাল শহরে ঘুড়ির সুতো আটকে মর্মান্তিক কিছু দুর্ঘটনার পর, যখন চিনে মাঞ্জা বা সিন্থেটিক মাঞ্জা-র শব্দটি প্রকাশ্যে এল। চিরচেনা সাধারণ সুতোয় এমনতর আঘাত করার শক্তি কই? এ সুতো মূলত নাইলনের তৈরি। তার উপরে অনেক পরিমাণে মিহি কাচের গুঁড়ো রঙের সঙ্গে মিশিয়ে প্রলেপ লাগানো হয়। মেশানো হয় এক ধরনের তেল, সব শেষে মসৃণ করার জন্য ঘষা হয় সিরিশ কাগজ। এত কাণ্ডের পর সুতোর নিরীহ চরিত্র পাল্টে তা ছুরি বা ব্লেডের সমান কাজ করে। নাইলন সুতো হওয়ায় সহজে তা ছেঁড়ে না। উড়ালপুলে বাইক চালিয়ে যাওয়ার সময় এই সুতোই গলায় পেঁচিয়ে নলি কেটে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, নাক-কান-চোখ কেটে মারাত্মক আহতও হয়েছেন অনেকে।

এই সুতোর জাল শুধু কলকাতা ও শহরতলিতেই নয়, ছড়িয়ে আছে সারা দেশে। এই বছরের গোড়ায় উত্তরায়ণ উপলক্ষে গুজরাতে ঘুড়ি ওড়ানোর সময় গোটা রাজ্যে প্রাণ গিয়েছিল ছ’জনের। তাদের মধ্যে ছিল তিনটি শিশুও। খাস রাজধানীতেও থেকে থেকেই দুর্ঘটনার খবর আসে। কয়েক মাস আগে পশ্চিম দিল্লিতে বাইকে সাঁতার শিখতে যাওয়ার পথে ঘুড়ির সুতো গলায় আটকে মৃত্যু হয়েছে বছর সাতেকের শিশুকন্যার। অথচ, দিল্লিতে দীর্ঘ দিন ধরেই চিনা মাঞ্জা দেওয়া সুতো বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে। সম্প্রতি ফের দিল্লি সরকার চিনা মাঞ্জা বা যে কোনও ধরনের কাচ বা ধাতব পরত লাগানো সুতোর উৎপাদন, বিক্রি, মজুত, ব্যবহার সবই নিষিদ্ধ এবং অমান্য করলে কড়া শাস্তির কথা ঘোষণা করেছে। কিন্তু তাতেও সুতোর হানা থামেনি। পশ্চিমবঙ্গে যেমন চিনা মাঞ্জার ব্যবহার যে বেআইনি, তা কার্যত খাতায়-কলমেই থেকে যায়। ধরপাকড় যেটুকু হয়, তার বেশির ভাগটাই স্বাধীনতা দিবস, বিশ্বকর্মা পুজোর আশেপাশে। কিন্তু ওইটুকু সময়ের তেড়েফুঁড়ে ওঠায় যে অবৈধ কারবারিদের দমানো যায় না, শব্দবাজি থেকে এক বার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক— সবেতেই তার জলজ্যান্ত প্রমাণ মিলেছে। প্রশাসন এখানে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয়ে উড়ালপুল ঘেরার পরিকল্পনা করে, অথচ প্রকাশ্য বাজারে কী ভাবে এই সুতো বিক্রি হচ্ছে, কোন পথে তা বাজারে আসছে এবং কোন অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে, তা চিহ্নিত করে বছরভর নজরদারির কাজটি চালায় না।

অবশ্য কড়াকড়ি করলেও কি এর ব্যবহার পুরোপুরি ঠেকানো যাবে? যাঁরা ঘুড়ি ওড়ান, সবাই কিন্তু এই সুতো কেনেন না। শখের ঘুড়ি-উড়িয়েরা এখনও ভরসা রাখেন সাধারণ সুতোর উপরেই। সুতোর টানের মারপ্যাঁচে ঘুড়িকে খেলানো, কখনও নিজে ধরাশায়ী হওয়া, কখনও অন্যকে কুপোকাত করার মধ্যে যে অনাবিল আনন্দ, তার স্বাদটুকু নিতে চান। চিনা মাঞ্জা তাঁরাই হাতে তুলে নেন, যাঁরা প্রতিযোগিতায় নামেন। সুতোকে ধারালো করে তোলার পিছনে একমাত্র কারণ— “আমার ঘুড়ি কাটবে না, কিন্তু অন্যের ঘুড়ি সহজেই কেটে যাবে”। এ প্রতিযোগিতা নিছক যোগ্যতা প্রমাণের নয়, বরং ‘আমি’র উদ‌্‌যাপনে মেতে ওঠা। সেখানে ‘অন্য’ কেউ নেই, অন্যকে নিয়ে ভাবার ইচ্ছেটুকুও নেই। ‘আমি’কে ওঠাতে হবে অনেক উপরে, প্রয়োজনে বাঁকা পথে, এবং অপরকে ছিন্নভিন্ন করে। নয়তো একের পর এক শিশুমৃত্যুর খবরও এই ক্রেতাদের বিচলিত করতে পারে না! প্রকাশ্য বাজারে ভিড় করে তাঁরা পাতলা প্লাস্টিক, রবার কেটে সুতোর ধার পরখ করেন! মানুষের মৃত্যুর তবু খবরটুকু হয়, কিন্তু অসংখ্য পাখির যে এই ধারালো সুতোয় ডানা, গলা কেটে মৃত্যু হয়, তাদের কথা ভাবার প্রয়োজনটুকুও কি নেই?

চিনা মাঞ্জাকে পরোক্ষ ছাড়পত্র দেওয়ার অর্থ এই আমি-সর্বস্ব নৃশংসতাকেও প্রশ্রয় দেওয়া। সমাজের পক্ষে তা খুব শুভ সঙ্কেত নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement