চুরির ক্যানসার যত ছড়িয়েছে, তার কোন স্টেজ কে বলতে পারে
SSC recruitment scam

ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা

নেতাদের অন্যায়ের দায় সমর্থকরা বইবেন কেন? তাঁদের বাড়ি বা মহল্লার কোনও মেধাবী সন্তান কি রোদ-জল-ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে বসে নেই রাস্তায়?

Advertisement
বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০২২ ০৪:১৮
অনড়: গান্ধীমূর্তির পাদদেশে এসএসসি-দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভের ৪৯৯তম দিন। রণজিৎ নন্দী

অনড়: গান্ধীমূর্তির পাদদেশে এসএসসি-দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভের ৪৯৯তম দিন। রণজিৎ নন্দী

নাটকের মঞ্চ থেকে ‘চরণদাস চোর’ এসে দাঁড়ালেন কলকাতার রাস্তায়। হাবিব তনভীরের সৃষ্ট চরিত্রটির দেশ-বিদেশে অবাধ বিচরণ। চরণদাসকে দেখেই সমস্বরে আওয়াজ উঠল, ‘চোর, চোর’।

“আমি যে চোর, সে তো আমি নিজেই বলি,” চরণদাস বিস্ময়কে ঠাট্টায় মুড়ে পরিবেশন করলেন।

Advertisement

“আপনাকে কেউ বলছে না, বলছে ওই লোকটাকে,” সেই লোকটার ছবি দেখাল এক জন।

চরণদাস উঁচু গলায় হেসে উঠলেন ছবি দেখে।

“হাসছেন কেন,” জানতে চায় উপস্থিত জনতা।

“চোর তো সে, যে পালাতে সুবিধে হবে বলে শীতের রাতেও খালি গায়ে সর্ষের তেল মাখে; চোর তো সে, যার ঘরে বাচ্চা জ্বরে কাতরাচ্ছে অথচ ভাঁড়ারে নেই একমুষ্টি চাল; চোর তো সে, ধরা পড়লে বেধড়ক মার খেতে হবে যাকে। চারটে লোক পায়ে ধরে হুইলচেয়ারে বসিয়ে সুপার-স্পেশালিটির ভিতরে নিয়ে যাচ্ছে যাকে, সে চোর হবে কেন?”

নাকতলার সন্তোষবালা স্মৃতি পাঠাগারের সামনে এক কালে নিঃসম্বল উদ্বাস্তু পরিবারের অজস্র মানুষ দরমার বেড়া আর টালির চালের ঘরে থেকেও বই নেওয়ার লাইনে গিয়ে দাঁড়াতেন। ইদানীং সবাই ফোনে পড়ে, লাইব্রেরিতে তাই লোক পাওয়া যায় না তত। তবে গত কয়েক দিন ধরে প্রচুর ভিড় পাঠাগারের ঠিক উল্টো দিকের একটি ফ্ল্যাটের সামনে। ওই বাড়িতে বিলিতি কুকুরদের শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত একটি ঝাঁ-চকচকে ফ্ল্যাট রয়েছে।

মানুষের ফ্ল্যাটের পুরোটা জুড়ে কুকুরকে বাস করায় যারা, যারা মানুষের যন্ত্রে কুকুরের ডায়ালিসিস করায়, তারা বোধ হয় পেডিগ্রিসম্পন্ন কুকুরের মতোই নির্দিষ্ট কিছু লোক চায়, যারা প্রভুকে দেখলে কুঁইকুঁই করবে, অন্য কাউকে দেখলেই তেড়ে যাবে! ওই তেড়ে যাওয়া লোকগুলো কদাপি কারও সমর্থক নয়। যে কোনও দলের সাধারণ সমর্থক একটি বিন্দুতে এক— তাঁরা দলের গ্যালারিতে বসে হাততালি দেন না কেবল, দলের খেলোয়াড়দের বাছা বাছা বাক্যবাণেও ফালাফালা করেন, যাতে আরও ভাল খেলে দল।

নেতাদের অন্যায়ের দায় সমর্থকরা বইবেন কেন? তাঁদের বাড়ি বা মহল্লার কোনও মেধাবী সন্তান কি রোদ-জল-ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে বসে নেই রাস্তায়? দু’দিন আগেও তাদের রাস্তায় ফেলে পেটাবার হুমকি দেওয়া হয়েছে, কেউ ভুলে যায়নি। এরা আবার ভিনরাজ্যের এয়ারপোর্টে নেমে চোখে-মুখে বেদনা ফুটিয়ে বুকে হাত দিয়ে অলীক কুনাট্য রঙ্গ করে। হৃদয় বলে কিছু আছে? ছিল কোনও দিন?

গোটজ় অ্যালি-র একটি জগদ্বিখ্যাত বই আছে, হিটলার’স বেনিফিশিয়ারিজ়। সেই বইতে অ্যালি দেখিয়েছেন, কী ভাবে উত্তর আফ্রিকা কিংবা পূর্ব ইউরোপ থেকে টন টন ভোগ্যপণ্য জার্মানিতে আসত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত। হাঙ্গেরি কিংবা মরক্কোর জমিতে তখন বাগানবাড়ি বানানোর পরিকল্পনা করছেন জার্মান অভিজাতরা— আক্রমণে জিতে নেওয়া ভূখণ্ডে লুটতরাজের কারণে অধিকাংশ উচ্চবিত্ত জার্মান পরিবারে উপচে পড়ছে হ্যাম বা মধু। সেই পরিবারগুলোর অনেকেই পঞ্চাশের দশকে ভোল পাল্টে সমাজতন্ত্রী সেজেছিল, ঠিক যে রকম একাত্তর সালে নেতাজিনগরের উদ্বাস্তু কলোনিতে গুলি করে পাঁচ কিশোর-তরুণকে মেরে ফেলা থেকে শুরু করে বাহাত্তর থেকে সাতাত্তর বিজয়গড়-বাঘাযতীন-নাকতলা-বাঁশদ্রোণীতে সন্ত্রাস চালানো ভৈরববাহিনীর তরুণ তুর্কি গত সপ্তাহ অবধি নিয়ো-কমিউনিস্ট ছিলেন!

ইতিহাস ভুলিয়ে দেওয়ার মোক্ষম রাস্তা হল কেচ্ছা। কাউকে নিয়ে যখনই কেচ্ছা শুরু হয়, তখনই তার থেকে আমোদ পেতে থাকে লোক, তার দুষ্কর্মের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ দুর্বল হয়ে আসে। স্কুলের গণ্ডি পেরোতে না-পারা কেউ যখন একটা গ্রামের পানীয় জলের কল পর্যন্ত ধ্বংস করে দেওয়ার স্পর্ধা দেখায়, তখন বুঝতে হবে যে, অনেকখানি ছাড় দিয়ে তার মালিকই চাইছে ওই হিংস্র চেহারাটাকে সামনে নিয়ে আসতে, যাতে মালিকের ছিপ-ফেলে মাছধরার সময় গ্রামের কেউ বিরক্ত করতে আসার সাহস না পায়। মালিকের উপরও মহামালিক আছেন, না হলে যে পদে যে কোনও সরকারের আমলেই এক জন শিক্ষক বসেন, সেই পদে হঠাৎ করে কোনও কর্পোরেটের লোককে বসিয়ে দেওয়া কেন? পরিবর্তনের সরকারে প্রথম শিক্ষামন্ত্রী যিনি ছিলেন, তিনি একটি চমৎকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন— কলেজে অনলাইনে ভর্তি। রাতারাতি চেয়ার চলে গেল তাঁর। নিন্দুকেরা বলে, সেই সময় ও ভাবে অ্যাডমিশন চালু হলে ইউনিয়নের নাম করে ‘ছোট ছেলেরা’ নগদ-নারায়ণ তুলতেই পারত না।

ওই সময় থেকেই শুরু হল, ভর্তি হতে গেলে চল্লিশ হাজার, চাকরি পেতে হলে আট লাখ। ধীরে ধীরে রাস্তার চায়ের দোকানে শোনা যেতে লাগল, লোকে বিশ্বাস করতে শুরু করল, জমি-গয়না বেচে হত্যে দিতে শুরু করল নেতাদের পিছনে; ‘পঁচিশ রেখে পঁচাত্তর দাও’ তত্ত্ব এল বাজারে, এবং প্রাক্তন নকশাল, প্রাক্তন আরএসএস, প্রাক্তন মুসলিম লীগ, প্রাক্তন সিপিএম, প্রাক্তন আমলা, প্রাক্তন সংস্কৃতিকর্মী, সবার নাম ঢুকতে শুরু করল এক প্রাক্তন মানুষের ‘বেনিফিশিয়ারি’র তালিকায়। কেউ ভিসি হলেন, কেউ চেয়ার প্রফেসর হলেন, কেউ বদলি হলেন, কেউ উল্কার গতিতে অ্যাসিস্ট্যান্ট থেকে অ্যাসোসিয়েট হতে হতে অনেকগুলো ফ্ল্যাট আর বাগানবাড়ির মালিকও হয়ে গেলেন, কেবল ‘শিক্ষা’ নামের সেই ‘চির-হিমায়িত অন্তর্মৃত্তিকা’, শত সহস্র বছরেও যা অবিকৃত থাকে, লোভ আর লালসার আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে গেল।

বাংলা আকাদেমিতে এক সাহিত্য অনুষ্ঠানের অবসরে কে কত নম্বর বাসে চেপে কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতেন, সেই গল্প করেছিলেন শঙ্খ ঘোষ, অমিতাভ দাশগুপ্ত, তরুণ সান্যালরা। ‘সে ছিল একদিন আমাদের যৌবনে কলকাতা’— বাসে চেপে আসতেন প্রণম্য অধ্যাপক-অধ্যাপিকারা। এখন সল্টলেকের অধ্যাপকের কোচিংয়ে মাসে দু’হাজার করে দিয়ে তিনশো জন, তো চন্দননগর-সিউড়ি-শিলিগুড়ির অধ্যাপকদের টোলেও দেড় হাজার করে দিয়ে আড়াইশো জন। আর প্রশ্নফাঁস তো জলভাত, হরবখত সোশ্যাল মিডিয়ায় তার চর্চা। চর্চা আরও বহু কিছুর— কোন গাইড স্কলারদের দিয়ে বাজার করাচ্ছেন, কে চাকরি পাইয়ে দিচ্ছেন ঘনিষ্ঠদের, চর্চার কি শেষ আছে?

টিভি চ্যানেলে যখন একদা-অধ্যাপিকা তথা শাসক দলের নেত্রী স্পষ্ট বলেন যে, পশ্চিমবঙ্গের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপাচার্যকে শাসক দলকে টাকা তুলে দিতে হয়, তখন হয় সরকারের তা তথ্য দিয়ে খণ্ডন করা উচিত, নয়তো কারও জনস্বার্থ মামলা করা প্রয়োজন। আর একটি কথাও খুব সাংঘাতিক— প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী নাকি শিক্ষাঙ্গনে হারেম প্রতিষ্ঠা করবার লক্ষ্যে ছিলেন। মন্ত্রীকে করা টেক্সট চ্যাটে এক, দুইকে বাদ দিয়ে তেইশ বা বাহান্নকে নিতে বলছেন কেউ, এমনটা টিভির পর্দায় দেখা গেলেও, এই ধরনের উক্তি জানপ্রাণ দিয়ে পড়ানো অসংখ্য দিদিমণির প্রতি অসম্মানসূচক।

চরণদাস রাতে ফোটা ফুল চুরি করে রবীন্দ্রনাথের পায়ে দিয়ে ছত্তীসগঢ়ে ফিরে যাবেন। কিন্তু ইতিউতি গজিয়ে ওঠা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে দিনমজুরের মতো মুখে রক্ত তুলতে হবে অসংখ্য মেধাবী ছেলে-মেয়েকে। আবারও সেই রাস্তায় গিয়েই বসতে হবে স্কুলে চাকরির পরীক্ষায় মেধার জোরে উত্তীর্ণদের। চুরির নামে যে ক্যানসার ছড়িয়ে পড়েছে গোটা সমাজে, তা কোন স্টেজে আছে, কে বলতে পারে!

‘যেখানে পরের দুঃখ পরে জানে… পরের জন্য পরকে মরিতে হয় না’, প্রতাপকে তো সেখানে যেতে বলেছেন সাহিত্যসম্রাট। কিন্তু যেখানে চুরি করে স্কুলে চাকরি নেওয়া মন্ত্রী-কন্যা চাকরি চলে গেলে কলেজে চাকরি পেতে যায়? সেখানে আমরা কোথায় যাব, শৈবলিনী?

আরও পড়ুন
Advertisement