দক্ষিণ ভারতে প্রশ্ন উঠছে, পশ্চিমবঙ্গ যথারীতি নিরুত্তাপ
Population Density

কম জনসংখ্যার বিপদ

ভারতের বড় রাজ্যগুলোর মধ্যে তামিলনাড়ু ও পশ্চিমবঙ্গেই জন্মহার সর্বনিম্ন। দেখে মনে হয়, পশ্চিমবঙ্গের এই ক্রমহ্রাসমান জন্মহার বিষয়ে যেন কারও কিছু যায় আসে না। কিন্তু সত্যিই কি তাই?

Advertisement
শাশ্বত ঘোষ
শেষ আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০২৪ ০৬:১৫

সম্প্রতি অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নায়ডু বলেছেন যে, সে রাজ্যের জনসংখ্যায় বয়স্কদের হার বাড়ছে, তাই তিনি রাজ্যের নাগরিকদের সন্তান উৎপাদনে উৎসাহ দেওয়ার জন্য আইন তৈরির চিন্তা করছেন। একই সুরে, যদিও খানিকটা মজার ছলে, তামিলনাড়ুর মুখমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন রাজ্যবাসীকে বলেছেন, ১৬টি সন্তানের জন্ম দেওয়াকে লক্ষ্য স্থির করতে। তাঁর বক্তব্য, রাজ্যের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমতে থাকলে লোকসভায় তামিলনাড়ুর প্রতিনিধিত্ব যেমন কমবে, কেন্দ্রীয় কর বণ্টনে রাজ্যের ভাগও কমবে।

Advertisement

এ নিয়ে জাতীয় গণমাধ্যমে বিস্তর চাপানউতোর, উত্তর ভারতের সঙ্গে তুলনা ইত্যাদি হলেও পশ্চিমবঙ্গে তার আঁচ পড়েনি তেমন। অথচ, ২০২০ সালের স্যাম্পল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, সমগ্র ভারতে যেখানে জন্মহার অর্থাৎ মহিলাপিছু সন্তানসংখ্যা ২, অন্ধ্রপ্রদেশে ও তামিলনাড়ুতে যথাক্রমে ১.৫ ও ১.৪, পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যাটি ১.৪। ভারতের বড় রাজ্যগুলোর মধ্যে তামিলনাড়ু ও পশ্চিমবঙ্গেই জন্মহার সর্বনিম্ন। দেখে মনে হয়, পশ্চিমবঙ্গের এই ক্রমহ্রাসমান জন্মহার বিষয়ে যেন কারও কিছু যায় আসে না। কিন্তু সত্যিই কি তাই? মনে রাখতে হবে, মোট জনসংখ্যার নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ ভারতে চতুর্থ সর্বাধিক জনবহুল রাজ্য ও জনঘনত্বের বিচারে দ্বিতীয়।

২০১১ সালের জনগণনার তথ্যের নিরিখে কেন্দ্রীয় সরকারের অভিক্ষেপ রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা ১০.০৫ কোটি হবে; যা ২০৩৬-এ ১০.২৯ কোটি হবে। অর্থাৎ, ১০ বছরে সামগ্রিক ভাবে পশ্চিমবঙ্গে মাত্র ২৪ লক্ষ লোক বাড়বে। দক্ষিণের রাজ্যগুলোর মতো পশ্চিমবঙ্গেও আনুমানিক ২০৪৫ সাল নাগাদ জনসংখ্যার প্রাকৃতিক বৃদ্ধির হার (পরিযাণ না হলে) শূন্য হয়ে যাবে। ২০২৬ সালে জনসংখ্যায় ষাটোর্ধ্বদের অনুপাত দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলোতে গড়ে ১৫% হলে পশ্চিমবঙ্গে তা হবে ১৩.৩%। ২০৩৬-এ পশ্চিমবঙ্গে এই অনুপাতটি বেড়ে দাঁড়াবে ১৮.৩%, অর্থাৎ প্রতি পাঁচ জনে কম-বেশি এক জন ষাটোর্ধ্ব। ২০২৬ সালে এ রাজ্যের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরই বয়স হবে ৩৩.৯ বছরের বেশি। ২০৩৬ সালে এই সংখ্যাটি হবে ৩৮.৮ বছর। যে ১০ বছরের সীমার কথা উল্লেখ করছি, সেই সময়কালে রাজ্যের প্রতি এক হাজার জনসংখ্যায় কর্মক্ষম বয়সের উপরে নির্ভরশীল ষাটোর্ধ্ব মানুষের সংখ্যা ১৯৭ থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ২৭৯। এবং, কর্মক্ষমদের উপরে যত অপ্রাপ্তবয়স্ক নির্ভরশীল হবে, তার তুলনায় নির্ভরশীল ষাটোর্ধ্বদের সংখ্যা বেশি হবে। এক দিকে জন্মহারের দ্রুত পতন, অন্য দিকে প্রত্যাশিত গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ার ফলেই এই ঘটনা ঘটছে। পশ্চিমবঙ্গের নারীদের জনতত্ত্বগত বৈশিষ্ট্য হল কম বয়সে বিবাহ (নাবালিকা বিবাহে পশ্চিমবঙ্গ দেশের মধ্যে প্রথম), দ্রুত একটি বা দু’টি সন্তানের জন্ম দেওয়া, এবং তার পর নির্বীজকরণ বা অন্যান্য গর্ভনিরোধক পদ্ধতির ব্যবহার।

২০৩৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের অর্ধেকের বেশি জনসংখ্যা কর্মক্ষম বয়সের মানুষের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। অর্থাৎ, কর্মক্ষম মানুষের উৎপাদনশীলতা যেমন বাড়াতে হবে, তেমনই তাঁদের বাচ্চা ও বয়স্ক উভয়ের দেখভাল করতে হবে। কিন্তু উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর যে প্রয়োজনীয় উপাদান— যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কাজের বাজার-সহ অন্যান্য আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামো— তার অপ্রতুলতা এ রাজ্যে প্রকট। রাষ্ট্রপুঞ্জের তথ্য অনুযায়ী, এই রাজ্যে প্রায় ২৪% বয়স্ক মানুষ কাজ করেন (মূলত অসংগঠিত ক্ষেত্রে); তাঁদের মধ্যে ৯০ শতাংশের বেশি কাজ করেন ‘বাধ্য’ হয়ে। রাজ্যে জনসংখ্যাগত পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে করুণ অবস্থা হবে বয়স্ক বিধবাদের, কারণ তাঁদের গড় আয়ু পুরুষের চেয়ে বেশি, কিন্তু অর্থ উপার্জনের পরিধি সীমিত ও তাই পরিবারে দরকষাকষির ক্ষমতাও পরিমিত। এক দিকে বয়স্কদের দেখভাল করা, সামাজিক নিরাপত্তা প্রদান, অন্য দিকে বয়সজনিত রোগের মোকাবিলা করার জন্য একদম প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের স্তরে বৃদ্ধদের স্বাস্থ্য ও পরিচর্যাসংক্রান্ত বিভাগ খোলার ক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপের যেমন আশু প্রয়োজন, তেমনই বাচ্চা ও বয়স্ক, উভয়ের দেখভাল করতে গিয়ে কর্মক্ষম মানুষদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়াও অতি গুরুত্বপূর্ণ।

যে কোনও সমাজে জনসংখ্যার পরিবৃত্তিতে জনসমাজের ‘বার্ধক্য’ এক অবশ্যম্ভাবী প্রক্রিয়া। সরকারি স্তরে প্রণোদনা দিয়ে কি জন্মহার বাড়ানো যায়? বাবা-মা’কে বাচ্চার দু’বছর হওয়া অবধি সবেতন ছুটি, বিনামূল্যে বাচ্চার দেখভালের বন্দোবস্ত, ১৮ বছর পর্যন্ত সন্তানের সব দায়িত্ব সরকারের নেওয়া ইত্যাদি নীতি জন্মহারের অতি পতন থেকে ডেনমার্ক বা সিঙ্গাপুরের মতো কিছু দেশকে হয়তো রক্ষা করতে পেরেছে, কিন্তু বেশির ভাগ পশ্চিমি দেশে, এবং চিন, জাপান বা দক্ষিণ কোরিয়াতে এ সব প্রণোদনা সফল হয়নি। তাই এই সম্ভাব্য আর্থ-সামাজিক বিপর্যয়ের মোকাবিলা করার জন্য চাই রাজ্য সরকারের সর্বোচ্চ স্তরে সঠিক চিন্তাভাবনা, নীতিপ্রণয়ন ও তার যথাযথ প্রয়োগ।

২০২৬-এর পরে লোকসভায় আসন পুনর্বিন্যাস হলে রাজ্যের জনসংখ্যার এই পরিবর্তনের ফল তাতে কী প্রভাব ফেলবে? ১৯৭১-কে ভিত্তিবর্ষ ধরে স্থির হয় যে, ২০২৬ অবধি ভারতে লোকসভার আসনসংখ্যা থাকবে ৫৪৩; তার পর তা পুনর্বিন্যাসের কথা ভাবা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে দু’টি সম্ভাবনা— এক, মোট আসনসংখ্যা অপরিবর্তিত থাকল, কিন্তু জনসংখ্যার অনুপাতে বিভিন্ন রাজ্যের আসনসংখ্যা বাড়ল বা কমল; এবং দুই, মোট জনসংখ্যা বৃদ্ধির অনুপাতে আসনসংখ্যা বেড়ে হতে পারে ৮৪৮। প্রথম ক্ষেত্রে উত্তর ভারতের চারটি রাজ্য যথা উত্তরপ্রদেশ, বিহার, রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশ সম্মিলিত ভাবে ৩১টি আসন বেশি পাবে; দক্ষিণ ভারতের পাঁচটি রাজ্য মোট ২৬টি আসন হারাবে; পশ্চিমবঙ্গ হারাবে ৪টি আসন। আর যদি আসনসংখ্যা বেড়ে ৮৪৮ হয়, তবে উত্তর ভারতের উল্লিখিত রাজ্যগুলিতে আসনসংখ্যা বাড়বে মোট ১৫০টি; দক্ষিণের পাঁচটি রাজ্য সর্বসাকুল্যে ৩৫টি আসন বেশি পাবে। পশ্চিমবঙ্গে বাড়বে ১৮টি আসন। সুতরাং, উভয় ক্ষেত্রেই লোকসভায় পশ্চিমবঙ্গ-সহ দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলোর প্রতিনিধিত্ব কমবে। গণতন্ত্র ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপরে তার কী প্রভাব পড়বে, এবং কী ভাবে তা মোকাবিলা করা যায়, গভীর ভাবে ভাবতে হবে।

কেন্দ্রীয় কর বণ্টনে রাজ্যের ভাগ অবশ্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ঘটনা হল, ভারতের মোট রাজস্ব আয়ে দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলির যতটা অবদান, তার অনেক কম তারা ফেরত পায়। পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২১-২৬ আর্থিক বছরে দক্ষিণ ভারতের পাঁচটি রাজ্য সম্মিলিত ভাবে কেন্দ্রীয় করের টাকার ১৫.৮% পেয়েছে; অন্য দিকে উত্তরপ্রদেশ একাই পেয়েছে প্রায় ১৮%, বিহার ১০ শতাংশের কিছু বেশি। পশ্চিমবঙ্গ পেয়েছে ৭.৫%। অন্য দিকে, ২০২১-২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় করে এক টাকা সাহায্য করলে, কর্নাটক, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলঙ্গানা ও কেরল ফেরত পায় যথাক্রমে ১৫, ২৯, ৪৯, ৪৩ ও ৫৭ পয়সা; সেখানে বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ ফেরত পায় যথাক্রমে ৭.০৬ টাকা, ২.৭৩ টাকা এবং ২.৪২ টাকা। পশ্চিমবঙ্গ ফেরত পায় ৮৭ পয়সা। তাই কেন্দ্রীয় করের পুনর্বণ্টনের ক্ষেত্রেও আমূল সংস্কারের প্রয়োজন। করের আনুভূমিক হস্তান্তরের সংস্কারের একটা উপায় অবশ্য বণ্টনের অনুপাত নির্ণয়ে জনসংখ্যার গুরুত্ব একটু কমিয়ে, জনসংখ্যা কমানোর কৃতিত্ব ও তার সঙ্গে অন্যান্য সামাজিক সূচক যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সুশাসনের গুরুত্ব বৃদ্ধি। তবে এটা জটিল, সমাধান খুঁজতে হবে সাবধানে।

এ রাজ্যে জনসংখ্যা সংক্রান্ত চর্চা সর্ব স্তরেই অবহেলিত। দেশে ১৮টা পপুলেশন রিসার্চ সেন্টার থাকলেও পশ্চিমবঙ্গে নেই। এখানে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে জনসংখ্যাতত্ত্ব পৃথক বিষয় হিসাবে পড়ানো হয় না। বিষয়টির সামাজিক গুরুত্ব সম্বন্ধে সরকার উদাসীন; প্রধান বিরোধী দল বিভ্রান্তিকর প্রচার চালায় যে, একটি নির্দিষ্ট ধর্মের লোকজনের বেশি বাচ্চা হয়, আর অনুপ্রবেশ বেড়েই চলেছে। অন্য বিরোধী দলগুলির কোনও বক্তব্য শোনা যায় না। জনসংখ্যা বৃদ্ধির নিম্নগতি যে রাজ্যে গভীর উদ্বেগের বিষয়, সেখানে চায়ের দোকান থেকে টিভি চ্যানেল, সর্বত্র লোকে জনবিস্ফোরণের উদ্বেগ নিয়ে আলোচনা করে চলে। সেই রাজনীতির আড়ালে যে বিপদ ঘনিয়ে উঠছে, রাজ্যবাসী তা কবে টের পাবেন?

আরও পড়ুন
Advertisement