আমেরিকার সদ্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারে এমন দু’টি প্রতিশ্রুতি ছিল, যা তাঁর আসন্ন প্রেসিডেন্সির আর্থিক নীতির ভিত্তি গঠন করতে পারে। প্রথমত, তিনি বলেছেন যে, বিশ্বের বৃহত্তম অর্থব্যবস্থা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র গোটা দুনিয়া থেকে যত পণ্য আমদানি করে, তার সবের উপরে ১০-২০% আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে দেবেন। দ্বিতীয়ত, বিদেশে চলে যাওয়া উৎপাদন ক্ষেত্রের চাকরি তিনি দেশে ফিরিয়ে আনবেন— আমেরিকায় উৎপাদন করার জন্য তিনি বাণিজ্যিক সংস্থাগুলিকে বিবিধ ইনসেন্টিভ বা আর্থিক সুবিধা দেবেন। দু’টি প্রতিশ্রুতিকে একত্র করলে দাঁড়ায় যে, আমেরিকা বৈদেশিক বাণিজ্যবিমুখ অর্থনৈতিক নীতির পথে হাঁটতে পারে।
প্রায় একশো বছর আগে আরও একটি রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট-পদপ্রার্থী— হার্বার্ট হুভার— আমদানি শুল্ক বাড়ানোর প্রতিশ্রুতির উপরে ভর করে নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন। তিনি সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষাও করেছিলেন, এবং গৃহীত হয়েছিল ১৯৩০ সালের স্মুট-হলি ট্যারিফ অ্যাক্ট। এই আইনের ফলে আমদানি শুল্ক বেড়েছিল ৪০-৬০%। যে সব দেশের সঙ্গে আমেরিকার বৈদেশিক বাণিজ্য চলত, স্বভাবতই তারা চটেছিল, এবং তারাও আমেরিকান পণ্যের উপরে আমদানি শুল্ক বাড়িয়েছিল। শুরু হয়েছিল এক শুল্ক-যুদ্ধ। মানবসভ্যতার ইতিহাসে ভয়ঙ্করতম আর্থিক সঙ্কট গ্রেট ডিপ্রেশন বা মহামন্দা শুরু হওয়ার পিছনে এই শুল্ক-যুদ্ধের একটা বড় ভূমিকা ছিল। কাজেই, ‘আমেরিকাকে আবার মহান করে তোলা’-র উদ্দেশ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অন্তর্মুখী বাণিজ্যবিমুখ আর্থিক নীতির পথে হাঁটার প্রতিশ্রুতিটি এমনিতেই ধুঁকতে থাকা বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থার পক্ষে বিশেষ সুসংবাদ নয়।
প্রশ্ন হল, ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বলেই কি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র শেষ অবধি এই বিপজ্জনক পথে হাঁটবে? অন্তত দু’টি কারণে সে সম্ভাবনা যথেষ্ট বেশি বলেই মনে হচ্ছ। প্রথমত, শুল্ক ব্যবহার করার প্রতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশেষ আসক্তি রয়েছে। একটি সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, “আমার কাছে অভিধানের মধুরতম শব্দটি হল শুল্ক। আমার প্রিয়তম শব্দ।” আশঙ্কার দ্বিতীয় কারণটি হল, বিদায়ী বাইডেন-প্রশাসন একটি ‘শিল্পনীতি’ গ্রহণ করেছিল। আমেরিকায় নির্মাণক্ষেত্রে কলকারখানা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য বাইডেন বেশ কয়েকটি আইনি পদক্ষেপ করেছিলেন। চিপস ফর আমেরিকা অ্যাক্ট (২০২২), দি ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড জবস অ্যাক্ট (২০২১) এবং ইনফ্লেশন রিডাকশন অ্যাক্ট (২০২২) তার কয়েকটি উদাহরণ। এই আইনগুলির বিশেষ লক্ষ্য ছিল কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পক্ষেত্র, যার মধ্যে রয়েছে সেমিকন্ডাকটর, ইলেকট্রনিকস, ঔষধি, চিকিৎসাসংক্রান্ত যন্ত্র নির্মাণ, মোবাইল ফোনের মতো কমিউনিকেশন ডিভাইস এবং গাড়ি ও গাড়ির যন্ত্রাংশ নির্মাণ। শুল্ক-প্রেমী ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন আমেরিকার অর্থব্যবস্থার চার পাশে বাণিজ্যবিমুখ দেওয়াল খাড়া করবেন, তখন এই শিল্পক্ষেত্রগুলি তাঁর কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাবে বলেই অনুমান করা চলে।
আমেরিকা বাণিজ্যবিমুখ রক্ষণশীলতার পথে হাঁটলে ভারতের স্বার্থে যে ঘা লাগবে, তা সহজবোধ্য। গত অর্থবর্ষে ভারত থেকে আমেরিকায় রফতানির পরিমাণ হ্রাস পেয়েছিল— বর্তমান, অর্থাৎ ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষের প্রথম ছ’মাসে কোনও ক্রমে সেই হারানো জমি উদ্ধার করা গিয়েছে। কিন্তু, তার চেয়েও বড় কথা হল, আমেরিকা যে শিল্পগুলির দিকে নজর দিয়েছে— বাণিজ্যবিমুখ রক্ষণশীল নীতি প্রতিষ্ঠিত হলে এই ক্ষেত্রগুলিতে যে পণ্য উৎপাদিত হয়, সেই পণ্য বিদেশ থেকে রফতানির উপরে কঠোর শুল্ক আরোপ করা হবে— সেই শিল্পগুলির বেশির ভাগই আবার ভারতের প্রোডাকশন-লিঙ্কড ইনসেন্টিভ (পিএলআই) প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ, এই পণ্যগুলিই আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতের রফতানিকে জোরদার করবে বলে আশা। প্রেসিডেন্ট হিসাবে তাঁর প্রথম দফায় ট্রাম্প ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন যে, ভারত আমেরিকান পণ্যকে নিজের দেশের বাজারে ঢুকতে না-দেওয়ার জন্য, এবং আমেরিকার সাপেক্ষে নিজেদের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত বজায় রাখার জন্য চড়া শুল্ক আরোপ করে (তিনি ভারতের নাম দিয়েছিলেন ‘ট্যারিফ কিং’ বা শুল্কের রাজা)। কৃষিপণ্য-সহ বিবিধ আমেরিকান পণ্য আমদানি বাড়ানোর জন্য ভারতের উপরে বিপুল চাপ তৈরি হয়েছিল, যদিও ভারত তা বহু দূর অবধি ঠেকাতে পেরেছিল। এ দফায় রক্ষণশীল বাণিজ্য নীতি চালু করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিপুল জনসমর্থন পেয়েছেন ট্রাম্প। ফলে, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাবে, এমন আশা ক্ষীণ। হয়তো তিনি ভারতের উপরে আরও বেশি আমেরিকান পণ্য আমদানি করার জন্য চাপ সৃষ্টি করবেন। এই মুহূর্তে ভারতের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল, ট্রাম্প কি ভারতের প্রতি বাইডেন জমানার প্রতিশ্রুতিগুলি রক্ষা করবেন? সেই প্রতিশ্রুতিগুলির মধ্যে কলকাতায় সেমিকন্ডাকটর ফ্যাব্রিকেশন ইউনিট প্রতিশ্রুতির সাম্প্রতিক চুক্তিও রয়েছে।
ভারতের পক্ষে আরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ট্রাম্প ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারির বিরোধী। বস্তুত, আমেরিকা ভারত-সহ মোট ১৩টি সহযোগী দেশের সঙ্গে যে ইন্দো-প্যাসিফিক ইকনমিক ফ্রেমওয়ার্ক ফর প্রসপারিটি তৈরি করেছে, তা পরিত্যাগ করা ট্রাম্পের একটি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল। বাইডেন প্রশাসন এই ফ্রেমওয়ার্কে বিপুল বিনিয়োগ করেছিল— চিনের আধিপত্য খণ্ডন করার জন্য এটিই ছিল বাইডেন প্রশাসনের অস্ত্র। ঠিক যেমন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলে তৈরি হয়েছিল ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট। ২০১৭ সালে প্রথম দফায় ওভাল অফিসের দখল নেওয়ার পরে ট্রাম্পের প্রথম কয়েকটি সিদ্ধান্তের মধ্যে একটি ছিল এই চুক্তি থেকে পিছু হটা। সেই সিদ্ধান্তের পিছনে তাঁর অবস্থান ছিল এই যে, আমেরিকা শুধু একক দেশের সঙ্গেই বাণিজ্য চুক্তি করবে, কোনও আঞ্চলিক সংগঠনের সঙ্গে নয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যদি তাঁর পুরনো অবস্থানে অনড় থাকেন, তবে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক-অর্থনীতিতে তার গুরুতর প্রভাব পড়বে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থা (ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজ়েশন বা ডব্লিউটিও)-কে ঘিরে অনিশ্চয়তাও ট্রাম্পের আমলে বাড়বে। ট্রাম্প তার সূচনা করেছিলেন ডিসপিউট সেটলমেন্ট বডি (ডিএসবি) ভেঙে দিয়ে। তাঁর প্রথম দফায় ট্রাম্প ডিবিএস-এ নতুন কোনও সদস্যপদকে সমর্থন করতে নারাজ ছিলেন, যার অর্থ হল, বিবদমান সদস্যদের মধ্যে কোনও সমাধানসূত্রে পৌঁছনোর প্রক্রিয়াটি অসমাপ্ত থাকবে। ডব্লিউটিও-র প্রতি ট্রাম্পের বিতৃষ্ণার কথা মাথায় রাখলে আশঙ্কা হয় যে, তাঁর দ্বিতীয় দফায় বহুপাক্ষিক বাণিজ্য ব্যবস্থা আরও দুর্বল হবে। তা যদি হয়, বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থা বিপাকে পড়বে, কারণ যথাযথ ভাবে বৈদেশিক বাণিজ্য পরিচালনা করার জন্য বহুপাক্ষিক নিয়ম-ভিত্তিক কাঠামো অপরিহার্য। এই কাঠামো না থাকলে আর্থিক ভাবে শক্তিশালী দেশগুলি দুর্বলতর বাণিজ্যসঙ্গী দেশগুলির কব্জি মুচড়ে বিবিধ সুবিধা আদায় করে ছাড়বে। এমন পরিস্থিতি যাতে তৈরি না হয়, তা নিশ্চিত করাই ডব্লিউটিও-র কাজ। কাজেই, এই প্রতিষ্ঠানটি দুর্বল হলে তার ফল কল্পনাতীত।
ঐতিহাসিক ভাবেই ভারত ও আমেরিকার আর্থিক সম্পর্ক খুব মসৃণ নয়— দুই দেশেরই বাণিজ্য ও বিনিয়োগসংক্রান্ত বিভিন্ন প্রশ্ন মতদ্বৈধ আছে। মেধাস্বত্ব নিয়ে বিরোধ মাঝেমধ্যেই চরমে পৌঁছেছে— আমেরিকার বাণিজ্য প্রশাসন বহু বার অভিযোগ করেছে যে, ভারত মেধাস্বত্ব রক্ষার জন্য যথেষ্ট নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে না; যেটুকু ব্যবস্থা আছে, তার প্রয়োগেও যথেষ্ট যত্নশীল নয়। আমেরিকায় ডেমোক্র্যাটরা ক্ষমতায় থাকুন বা রিপাবলিকানরা, দু’দেশের বিরোধ অব্যাহত থেকেছে। কাজেই, ভবিষ্যতেও সে বিরোধ থাকবে।
তবে, এ কথাও ঠিক যে, ভারত ও আমেরিকার মধ্যে এমন অনেকগুলি দ্বিপাক্ষিক প্রক্রিয়া চালু আছে যাতে শুধু এই বিরোধগুলিকে পাশ কাটিয়ে চলাই সম্ভব হবে তা নয়, একই সঙ্গে দু’দেশের সম্পর্কও মজবুততর হবে। সবচেয়ে বড় কথা, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ব্যক্তিগত সম্পর্ক খুবই ভাল। তাঁরা কী ভাবে দু’দেশের জন্য উন্নততর ভবিষ্যতের পথে হাঁটেন, সেটাই প্রশ্ন।