দুয়ারে সরকার’ কর্মসূচিতে প্রভূত সাড়া মেলায় এ রাজ্যের প্রশাসনিক কর্তা থেকে শুরু করে নীতি নির্ধারকরা সকলেই খুব উজ্জীবিত। বিশেষ করে ‘স্বাস্থ্যসাথী’ কার্ড বা ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ নামের নতুন প্রকল্পগুলিতে নাম নথিভুক্ত করানোর জন্য প্রতিটি শিবিরে মানুষের যে দীর্ঘ লাইন চোখে পড়েছে, তাকে শাসক দল তথা সরকার স্বতঃস্ফূর্ত জনসমর্থনের বহিঃপ্রকাশ বলে বিবেচনা করছে বলেই অনুমান। আর, শিবিরের বাইরের সেই লাইনেই অশনিসঙ্কেত দেখছে বিরোধীরা। অন্য নানা বিষয়ে বছরভর সরকারের তীব্র সমালোচনা করলেও বিরোধী দলগুলি এই সব প্রকল্প সম্পর্কে কোনও বিরূপ মন্তব্য করার সাহস তো পায়নি বটেই, উপরন্তু কোনও কোনও শিবিরে তাঁদের কেউ কেউ লাইনে দাঁড়ানো মানুষের ফর্ম পূরণ করে দিয়ে পাশে থাকার বার্তা দিতে মরিয়া চেষ্টাও করছেন।
যদিও এই কর্মসূচি ঘিরে বারংবার কোভিড-বিধি লঙ্ঘিত হওয়ার অভিযোগ উঠেছে, তাতে সরকার যেমন আমল দেয়নি, বিরোধীদেরও সে ভাবে সরব হতে দেখা যায়নি। কারণ সহজবোধ্য— মানুষের চাহিদা ও প্রত্যাশা যতই অযৌক্তিক, সার্বিক প্রগতির অন্তরায় কিংবা জনস্বাস্থ্যের পক্ষে বিপজ্জনক হোক না কেন, এগুলির বিরোধিতা করে কেউই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিরাগভাজন হতে চায় না। আসলে এটাই ভোট রাজনীতির বাধ্যবাধকতা।
তবে, নিরপেক্ষ ভাবে পর্যালোচনা করলে ‘দুয়ারে সরকার’ শিবিরগুলিতে উপচে পড়া ভিড়কে কি আদৌ সরকারের সাফল্যের সূচক বলে বিবেচনা করা যায়? সরকারি প্রকল্প— তা সে যত জনহিতকরই হোক না কেন— তার সুবিধা পাইয়ে দিতে লক্ষ লক্ষ মানুষকে এই অতিমারির আবহে লাইনে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার কি খুব দরকার ছিল?
২০১৩ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যোগ্য ব্যক্তিকে সরকারি পরিষেবা প্রদান নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে ‘পশ্চিমবঙ্গ জনপরিষেবা অধিকার আইন, ২০১৩’ নামে একটি নতুন আইন প্রণয়ন করে। ৩ অক্টোবর, ২০১৩ থেকে এটি রাজ্য জুড়ে কার্যকর হয়। মূলত সময়ানুবর্তী সরকারি পরিষেবা প্রদান আইনানুগ করে, দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ প্রশাসনের মাধ্যমে পরিষেবাপ্রার্থীর হয়রানি বন্ধ করাই এই আইনের লক্ষ্য। এমনকি পরিষেবা প্রদানে উপযুক্ত কারণ ছাড়া বিলম্ব ঘটলে, কিংবা যোগ্য ব্যক্তিকে পরিষেবা থেকে কারণবহির্ভূত ভাবে বঞ্চিত করলে সংশ্লিষ্ট আধিকারিককে শাস্তি দেওয়ারও সংস্থান রয়েছে এই আইনে। এই আইনের আওতায় বিভিন্ন সরকারি দফতর ইতিমধ্যে আদেশনামা জারি করে কোন কোন পরিষেবা কত দিনের মধ্যে দেওয়া হবে, কোন আধিকারিক তার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত, অকারণ বিলম্ব ঘটলে বা অন্যায্য ভাবে পরিষেবা থেকে বঞ্চিত করলে কোন উচ্চতর কর্তৃপক্ষের কাছে আপিল করতে হবে, সব সবিস্তারে ঘোষণা করেছে।
সুতরাং ‘দুয়ারে সরকার’ প্রকল্পে যে যে পরিষেবা পাওয়ার জন্য সাধারণ মানুষকে সব কাজ বিসর্জন দিয়ে এবং অতিমারির বিপদকে উপেক্ষা করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে, সেই পরিষেবাগুলোকে অনায়াসে এই আইনের আওতায় এনে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সুষ্ঠু ভাবে দেওয়া যেত।
এ ছাড়া, পরিপূরক হিসাবে ব্যবহার করা যেত ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকেও। সে ক্ষেত্রে, বিনা হয়রানিতে সাধারণ মানুষকে সরকারি পরিষেবা প্রদান করার জন্যে আলাদা করে শিবিরে ডাকতে হত না। প্রয়োজন হত না এত ঢাকঢোল পেটানোরও।
অনেকে বলছেন, ‘দুয়ারে সরকার’ কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারি প্রশাসনযন্ত্রকে আরও বেশি জনমুখী ও গণবান্ধব হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে। এর ফলে প্রশাসন সম্পর্কে জনমানসে আবহমান কাল ধরে চলে আসা নেতিবাচক ধারণা ধীরে ধীরে দূর হচ্ছে। শিবিরগুলোয় উপচে পড়া ভিড় অন্তত তেমনটাই ইঙ্গিত করছে।
আর এক দল বলছে, বিষয়টা আসলে অতটা সরল নয়। ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বিশ্বাসযোগ্যতা ও নিরপেক্ষতা এমন তলানিতে ঠেকেছে যে, রাজ্যের অধিকাংশ গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদগুলি শাসক দলের দখলে থাকলেও সরকার তাদের উপরে আর আস্থা রাখতে পারছে না। বিশেষ করে আমপান-পরবর্তী ত্রাণ বিলিকে কেন্দ্র করে সর্বাত্মক দুর্নীতির যে ভয়াবহ চিত্র জনসমক্ষে এসেছে, তাতে সরকারের ভাবমূর্তি এতটাই আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে যে, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী নিজের ক্ষোভ গোপন করতে পারেননি। উপরন্তু, যারা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়েও ত্রাণের টাকা আত্মসাৎ করেছে, তাদের কড়া হুঁশিয়ারি দিয়ে টাকা ফেরতের নির্দেশও দিতে দেখা গিয়েছে তাঁকে।
প্রকৃতপক্ষে সরকারি কাজে সাধারণ মানুষ যাতে অংশগ্রহণ করতে পারেন, সরকারি আধিকারিকদের দাক্ষিণ্যের উপর নির্ভর না করে যাতে সাধারণ মানুষ নিজেদের দাবি ও অধিকার অর্জন করতে পারেন, তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত বসন্তরাই মেহতা কমিটির সুপারিশক্রমে দেশের অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গেও পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু হয়। যদিও প্রাথমিক ভাবে তা ছিল দ্বিস্তর। ১৯৭৩ সালে কার্যকর হওয়া নতুন পঞ্চায়েত আইনের মাধ্যমে ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু হয়।
১৯৭৮ সালের জুন মাসে পশ্চিমবঙ্গের নবগঠিত পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় প্রথম দলীয় প্রতীকের ভিত্তিতে একই দিনে গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদের গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে এটি একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে। প্রকৃত ‘দুয়ারে সরকার’ হিসাবে দশকের পর দশক ধরে অনুশীলিত এই ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের হাতে যে প্রশাসনিক, জনকল্যাণমূলক, বিচারবিভাগীয় ও প্রতিনিধিত্বমূলক স্বায়ত্তশাসন তুলে দেওয়া হয়েছিল, তাতে যদি দুর্নীতির ঘুণ ধরে থাকে, তা হলে সরকারের উচিত ছিল সর্বাগ্রে সেই ঘুণকে নির্মূল করা। কিন্তু নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের উপেক্ষা করে, সরকারি আধিকারিকদের তত্ত্বাবধানে ‘দুয়ারে সরকার’ কর্মসূচির মাধ্যমে আবারও আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন হয়তো গণতন্ত্রের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপনেরই নামান্তর। এমন এক কর্মসূচিতে লক্ষ লক্ষ মানুষের অংশগ্রহণ সত্যিই সরকারের সাফল্য সূচিত করে কি না, সেটাও ভাবার বিষয়।