ক্ষুদ্রতার আগল ভেঙে পশ্চিমবঙ্গকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন
Buddhadeb Bhattacharjee Death

বিদ্রোহী, অভিমানী, একা

পার্টির ভবিষ্যৎ গঠন ও নেতৃত্ব সম্পর্কে প্রমোদ দাশগুপ্ত যে নকশাটি বানিয়েছিলেন, তাঁর তিরোধানেও তাতে বড় একটা নড়চড় হয়নি। সেই নকশায় বৃহৎ ভূমিকা ছিল অনিল ও বুদ্ধদেবের।

Advertisement
সুমিত মিত্র
শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০২৪ ০৯:৪৩

দলের নিয়ম মেনে চলতে হবে, কখনও প্রশ্ন করা চলবে না। এই মেনে নেওয়ার পুরস্কার হিসাবে পাওয়া যাবে হরেক আর্থিক ও সামাজিক সুবিধা। এটিই ছিল পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছর বামফ্রন্ট শাসনের আসল রহস্য। সেই শাসনে, মনে করা হত, কেরানি খুশি মহার্ঘ ভাতায়; কৃষিমজুর খুশি রুমাল সাইজ়ের বর্গা জমি পেয়ে; শ্রমিক খুশি, কারণ তাঁকে ছাঁটাই করে কার সাধ্যি! আর, এই খুচরো প্রাপ্তিতে খুশি থাকা জনগোষ্ঠীর উপরে বিরাজ করতেন পার্টির ‘কমরেড’রা— তাঁরাই ছিলেন বঙ্গের প্রকৃত ‘বাবু’।

Advertisement

তবে কিছু প্রতিবাদীও ছিলেন। যেমন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, যিনি পাম অ্যাভিনিউয়ের ছোট্ট বাড়িটি ছেড়ে চলে গেলেন অনেক অনেক দূরে, তাঁর প্রিয় লেখক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া কোনও চরিত্রের মতো। তিনি কমিউনিস্ট হয়েছিলেন আদর্শ ও ইতিহাসের টানে, পার্টির আমলাতন্ত্রের মধ্যে নিজের অস্তিত্ব মিশিয়ে দেওয়ার জন্য নয়। প্রথম যৌবনে কফি হাউসে দেখতাম, শক্তি চট্টোপাধ্যায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ তরুণ সাহিত্যিকদের তিনি প্রিয়পাত্র। এক দিন বলেছিলেন, “এঁদের শ্রেণিচরিত্র আগেকার অধ্যাপক কবিদের চেয়ে আলাদা। শক্তিদা যেমন শব্দ ব্যবহার করেন, ওঁর কবিতায় ছন্দের ব্যবহার, সব সাধারণ মানুষের কথোপকথনের মতো।” অথচ তাঁরা কেউই মার্কামারা বামপন্থী সাহিত্যিক ছিলেন না। ষাটের দশকের শুরুতে কলকাতায় উদারপন্থার জন্য ছিল প্রশস্ত পরিসর— কলেজছাত্র বুদ্ধদেবের সেখানে ছিল অবাধ যাতায়াত। কিন্তু সরকারি বামপন্থার সঙ্গে তাঁর ছিল পারিবারিক যোগ। পার্টি ভাগ হওয়ার পর বুদ্ধদেব সিপিএমে যোগ দিলেন।

যে শ্রেণিগুলিকে কংগ্রেস এত দিন আয়ত্তাধীন রেখেছিল— তফসিলি জাতি, জনজাতি, দক্ষিণবঙ্গের মুসলমান— সত্তরের দশকে সিপিএম তাদের নিয়ে এল নিজের শিবিরে। এই আসা-যাওয়া ঘটছিল ষাটের দশক থেকে, কিন্তু ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে তা পেল বামফ্রন্টের পক্ষে রকেট গতি। নকশালদের বাংলা থেকে বিদায় করে, এবং জরুরি অবস্থার পর কংগ্রেসকে নির্বাচনী অঙ্কে অনেক পিছনে ফেলে, সিপিএম যখন বঙ্গে তার ৩৪ বছরের অভিযান শুরু করল, তখন দলের মূল কান্ডারি ছিলেন প্রমোদ দাশগুপ্ত। এক কমিউন-বাসিন্দা অকৃতদার মানুষ, যাঁর ব্যক্তিত্বটি তৈরি ইস্পাত দিয়ে, মনটি পার্টি সংগঠনে নিবেদিত। তিনি ছিলেন মানুষ চেনার জহুরি। দলের পাদপ্রদীপে তিনি নিয়ে আসেন তিন তরুণকে: বিমান বসু, অনিল বিশ্বাস ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। প্রমোদ দাশগুপ্তের তিনমূর্তি সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রের। বিমান বয়সে বড় ও গোঁড়া পার্টিভক্ত। অনিল এক বুদ্ধিমান সংগঠক, যাঁর তুরুপের তাসের একটি হল তাঁর তফসিলি জাতি পরিচিতি (সিপিএমে প্রথম)। এবং বুদ্ধদেব, শহুরে মানুষের মধ্যে যাঁর গ্রহণযোগ্যতা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন প্রমোদ দাশগুপ্ত। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু নিশ্চয়ই ছিলেন দলের হিমালয়সম নেতা, কিন্তু আশি সাল নাগাদই দলের নেতৃত্ব ভাবতে শুরু করেছিলেন, জ্যোতিবাবুর অনুপস্থিতিতে কে গ্রহণ করবেন তাঁর আসন? সেই দৌড়ে অন্তত প্রমোদবাবুর চোখে এগিয়ে ছিলেন বুদ্ধদেব। ১৯৮২ সালে তিনি যখন চিকিৎসার জন্য চিনে যান— আর ফেরেননি— তখন বুদ্ধদেব ছিলেন তাঁর সহচর।

সিপিএমের অন্দরে ক্রমে শুরু হল নানা টানাপড়েন। তার ঝটিকাকেন্দ্র ছিলেন জ্যোতি বসু স্বয়ং। দিল্লির এক পত্রিকায় বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর পুত্রের ব্যবসায়ের অভাবনীয় উত্থান এবং তাতে রাজ্য সরকারের ঋণদাতা সংস্থার ভূমিকাসংক্রান্ত একটি তদন্তমূলক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, যার শিরোনাম ছিল, ‘কমরেড পাপা’জ় ক্যাপিটালিস্ট সন’। লেখাটি প্রকাশের পর বিস্তর হইচই হয়। লেখাটি যে বেরোচ্ছে, বুদ্ধদেব জানতেন। প্রকাশনার পরের দিন পত্রিকাটি তিনি এক সচিবকে বিমানবন্দরে পাঠিয়ে নিয়ে আসেন। সে দিনই মধ্যাহ্নে ছিল সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠক। সেখানে উপরোক্ত পত্রিকার কপি টেবিলের উপর ছুড়ে ফেলে নাকি বুদ্ধদেব দাবি করেন, হয় মুখ্যমন্ত্রী এখনই আইনি প্রতিবাদপত্র পাঠান প্রকাশককে, নয় ত্যাগ করুন সরকারি পদ। শোনা যায়, মুখ্যমন্ত্রী সহসা অসুস্থ বোধ করায় সেই সভা অচিরেই ভঙ্গ হয়।

পার্টির ভবিষ্যৎ গঠন ও নেতৃত্ব সম্পর্কে প্রমোদ দাশগুপ্ত যে নকশাটি বানিয়েছিলেন, তাঁর তিরোধানেও তাতে বড় একটা নড়চড় হয়নি। সেই নকশায় বৃহৎ ভূমিকা ছিল অনিল ও বুদ্ধদেবের। তাঁর জীবিতকালে অনিল হয়েছিলেন পার্টির দৈনিক গণশক্তি-র বার্তা সম্পাদক, তখনই নিতেন ‘পার্টি ক্লাস’। উত্তরকালে তিনিই প্রমোদ দাশগুপ্তের আসনে অধিষ্ঠিত হন। পাশাপাশি বুদ্ধদেব হয়ে উঠছিলেন যুগপৎ দলের নতুন পথের দিশারি এবং তার নৈতিক কম্পাস। জ্যোতি বসু সম্পর্কে তাঁর অভিযোগ দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছিল, তার অন্তরালে ছিল মুখ্যমন্ত্রীর ব্যবসায়ী পুত্রের সঙ্গে সরকারের ব্যবসায়িক যোগ। তবে শুধু ব্যক্তিবিশেষের প্রতি রাগ পোষণ না করে বুদ্ধদেব ও অনিল নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিলেন বাংলার এক নতুন রূপরেখার। ঢালাও চাকরির ব্যবস্থা করতেই হবে, এবং বিশুদ্ধ সমাজতান্ত্রিক পথে চাকরির জন্য সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকলে তার কোনও আশা নেই, প্রয়োজন বেসরকারি লগ্নি।

১৯৯৮ সালে রাজ্য সম্পাদক হয়েই অনিল বিশ্বাস স্তালিনীয় কায়দায় জ্যোতি বসুকে ক্ষমতাচ্যুত করলেন। নতুন সহস্রাব্দের সূচনায় বুদ্ধদেব হলেন মুখ্যমন্ত্রী। ক্ষমতাসীন হয়েই তিনি এবং অনিল তৎপর হলেন দল ও সরকারের খোলনলচে বদলাতে। মুসলমানরা তখন রাজ্য জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ, কিন্তু তাদের না আছে শিক্ষার উপযুক্ত ব্যবস্থা, না কর্মসংস্থান। এই বঞ্চনার হিসাব লেখা আছে সাচার কমিটির ২০০৬ সালের রিপোর্টে। ক্রমশ রাজ্য সরকারের তৎপরতায় আধুনিকীকরণ হল রাজ্যের মাদ্রাসাগুলির, তৈরি হল আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ২০০৬ সালের নির্বাচনে বিপুল জয়ের পরেই রতন টাটা হাজির হলেন সিঙ্গুরে ন্যানো গাড়ি কারখানার পরিকল্পনা নিয়ে। আবার ইন্দোনেশিয়া গিয়ে স্বভাবত ঘরকুনো বুদ্ধদেব সেখানকার সালিম গোষ্ঠীর সঙ্গে সই করে এলেন এক ৪০,০০০ কোটি টাকার চুক্তি, যার ফলে পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় শুধু এক রাসায়নিক শিল্পের ‘হাব’ তৈরিই হবে না, গড়ে উঠবে এক বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও সুদীর্ঘ আধুনিক সড়কে সমন্বিত নতুন দক্ষিণবঙ্গ। কাজ শুরু হতে চলেছিল জিন্দলদের ইস্পাত কারখানারও।

সবই বানচাল হয়ে গেল একটি কারণে। অনিল বিশ্বাসের অভাবে পার্টিতে এমন কোনও নেতা ছিলেন না, যিনি দলের এই নতুন পদক্ষেপকে জোরালো সমর্থন দিতে পারতেন কৃষক সভা প্রভৃতি গণসংগঠনে, পার্টিকর্মীদের কাছে ও জনসমাজে। গ্রামবাংলায় শিল্প অপরিচিত, সেই কারণেই সেখানকার মানুষের কাছে ভীতিপ্রদ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুধু অপেক্ষা করছিলেন সুযোগের। সেই সুযোগ এল সরকারের জমি অধিগ্রহণ শুরু হতেই। সিঙ্গুরে হাইওয়ে অবরোধ ও ধর্নার ধাক্কায় টাটা বন্ধ করে দিল গাড়ি প্রকল্প। সালিমদের প্রস্তাবিত বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রতিবাদে নন্দীগ্রামে মিছিলে পুলিশের গুলিতে ১৪ জনের মৃত্যু হল। আমেরিকার সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষরের প্রতিবাদে ইউপিএ থেকে বেরিয়ে এলেন তৎকালীন সিপিএম সেক্রেটারি প্রকাশ কারাট। ফলে কেন্দ্রও বুদ্ধদেবকে সাহায্য করল না। শেষ হল তাঁর বাংলায় শিল্পায়নের স্বপ্ন। কায়েম হল ‘মা মাটি মানুষ’-এর যুগ। মধ্যবিত্ত বাঙালি ইন্টেলেকচুয়ালের চরিত্রে, অন্তত এক কালে, একটা গোঁয়ারতুমি ছিল— সে দোষ বুদ্ধদেবেরও ছিল। না হলে হয়তো ২০১১-র পরাজয়ের পর এ ভাবে গুটিয়ে নিতেন না নিজেকে, সেখানেই শেষ করতেন না নিজের রাজনৈতিক জীবন। তিনি রাজ্যসভায় যেতেও রাজি হলেন না।

ব্যর্থতার বোঝা ঘাড়ে নিয়ে চলে গেলেন অভিমানী বুদ্ধদেব। ২০১১ সালে পরাজয়ের পর কারও সঙ্গে বিশেষ যোগাযোগ রাখতেন না, পার্টির সঙ্গেও না। তবে নিজেকে নিশ্চয়ই প্রশ্ন করতেন, কেন ভুল হল সব হিসাব? কী উত্তর তিনি পেতেন? ভুল মার্ক্সবাদী দর্শনে? না কি, ভুল তাঁর প্রাথমিক ধারণায় যে, বুর্জোয়া গণতন্ত্রের সঙ্গে মার্ক্সবাদী রাষ্ট্রের সহাবস্থান সম্ভব? কে জানে।

আরও পড়ুন
Advertisement