‘সেবার্থী’: সেবাশ্রয় স্বাস্থ্য শিবিরে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় কথা বলছেন জনতার সঙ্গে, ডায়মন্ড হারবার, ২ জানুয়ারি। ছবি: পিটিআই।
ডায়মন্ড হারবারের ‘সেবাশ্রয়’ কর্মসূচি রাজ্যের রাজনীতিতে সহসা বিশেষ চর্চার কারণ হয়ে উঠেছে কেন, তা বুঝতে রকেট-বিজ্ঞান জানার দরকার নেই। তবে তৃণমূলের ভিতরের সাম্প্রতিক টানাপড়েন এবং ‘ক্ষমতা’র তথাকথিত সমীকরণের নিরিখে সামগ্রিক পরিস্থিতি কতটা ঘোরালো, সেটা আলোচনার যোগ্য।
তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর ভাইপো, দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে সম্পর্কের ‘শীতলতা’ এখন অনেকটাই সামনে এসে গিয়েছে। পর্যবেক্ষকদের অনেকের ধারণা, বিষয়টি ক্রমশ জটিল আকার নিচ্ছে। এ ভাবে চলতে থাকলে তা জটিলতর হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
কলেজে ছাত্র ইউনিয়ন থেকে ধরলে মমতার রাজনৈতিক জীবন কমবেশি পঞ্চাশ বছরের। অভিষেকের রাজনীতিতে সক্রিয় উপস্থিতি বছর দশেক। প্রজন্মের ব্যবধানে নানা বিষয়ে তাঁদের ভাবনাচিন্তা, মূল্যায়ন থেকে শুরু করে কাজের ধারা এবং ব্যক্তি-বাছাই পর্যন্ত অনেক কিছুই আলাদা। এ সব নিয়ে উভয়ের মধ্যে খুচখাচ খিটিমিটিও যে কখনও হয়নি তা নয়।
তবে অভিষেক যত দিন দলের অন্যতম শীর্ষপদটি পাননি, তত দিন তার প্রকাশ ছিল এক রকম। পদে বসার পরে এটা রাতারাতি অধিকার ‘ফলানো’র স্তরে চলে গিয়েছে। সেখানেই মতভেদ থেকে বিবাদ। এ বার যেটা সংঘাতের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
অভিষেককে তৃণমূলে মমতার উত্তরসূরি ভাবার সূত্রপাত ২০১৪ সালে তিনি প্রথম সাংসদ হওয়ার সময় থেকেই। সেটা তিনি মমতার পরিবারের সন্তান এবং সক্রিয় রাজনীতিতে পুরোপুরি যুক্ত হয়েছেন বলে। একক নেতৃত্বের অনেক দলেই এটা স্বাভাবিক। তাই এখনও বলব, পরিস্থিতির নাটকীয় বদল না ঘটলে মমতার দলে তাঁর ভাইপোর উত্তরাধিকারের সম্ভাবনা বারো আনা। আপাতত চার আনা হাতে থাক! কারণ আজও মমতাকে চ্যালেঞ্জ করে বা তিনি সক্রিয় থাকাকালীন অপর কেউ তৃণমূলে ক্ষমতার সমান্তরাল ভরকেন্দ্র হয়ে উঠতে চাইলে কাজটা খুব সহজ হবে না। সেটা অভিষেক হলেও।
অধিকার প্রতিষ্ঠার পরিসর তৈরি করে ২০১৬-র বিধানসভা ভোটের সময় মাত্র দু’বছরের সাংসদ অভিষেক যখন নিজেকে দলের জয়ের ‘কারিগর’ বলে তুলে ধরেন, মমতা সে দিন যথেষ্ট ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। অন্দরে অশান্তিও হয়েছিল। তবে অভিষেককে ‘অনভিজ্ঞ’ বিবেচনা করে বিষয়টি তখন কিছুটা লঘু করে দেখা হয়।
সবাই জানি, তৃণমূলে মুকুল রায়ের দোর্দণ্ডপ্রতাপের সময় তাঁকেই ধরা হত মমতার পরে প্রথম ব্যক্তি অর্থাৎ, নাম্বার টু। দলের ভিতরে-বাইরে কোনও আপত্তি শোনা যেত না। তাঁর সঙ্গে সমান্তরাল ক্ষমতার লড়াইতে আর এক জন দাবিদার ছিলেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। অবশ্যই বেশ খানিকটা পিছিয়ে। মিডিয়ার সামনে আসতে না-চাওয়া রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী চিরদিন নিজেকে এই দর-কষাকষির বাইরে রাখতেন, অন্তত প্রকাশ্যে।
তবে রথ-পথ-মূর্তির দড়ি টানাটানিতে ‘অন্তর্যামী’ মমতার তেমন হেলদোল ছিল না। কারণ তাঁরা সকলেই মমতার ছত্রছায়া মানতেন। দলনেত্রীকে ছাপিয়ে ওঠার তাড়না কখনও ছিল না।
২০১৯-এর লোকসভা ভোটে বিজেপি চ্যালেঞ্জে ফেলে দিল তৃণমূলকে। তার পরেই অভিষেকের ‘উল্কাগতি’র সূচনা দেখা গেল। ভোট-কুশলী প্রশান্ত কিশোরকে ডেকে এনে তিনি কার্যত ‘কান্ডারি’ হতে চাইলেন। মমতা বাধা দেননি। বরং ২০২১-এর বিধানসভায় জয়ের পরে দ্রুত অভিষেককে তিনি দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক করে এগিয়ে দিলেন। এ ভাবেই মমতার তুলে দেওয়া ‘ধন’-এ অভিষেক ‘ধনী’ হলেন। আর তৃণমূলের নেতা-কর্মী-সমর্থক থেকে সাধারণ মানুষ সবাই বুঝে গেলেন, দলে অভিষেক-পর্ব শুরু হল!
মমতার অনুগ্রহ ছাড়া অভিষেকের পক্ষে যেমন অনায়াসে এত বড় ক্ষমতা অর্জন করার সাধ্য ছিল না, তেমনই মমতার সামনেও হয়তো সে দিন বিকল্পের ঘাটতি ছিল। কারণ ঘটনাচক্রে তার আগেই মুকুল, শোভন চট্টোপাধ্যায়দের মতো অভিষেকের ‘পথের কাঁটা’ সাফ হয়ে যায়। এমনকি শুভেন্দু অধিকারীও। তাঁরা কে কেন দল ছেড়েছিলেন, বা কী হলে কী হতে পারত, সেই সব আলোচনা আজ অর্থহীন। ঘটনা হল, মসৃণ পথে হেঁটে জমি শক্ত করতে অভিষেকের কোনও বাধা ছিল না।
অচিরে ববি হাকিম, অরূপ বিশ্বাসদের মতো মন্ত্রীদের ঘাড়েও নবাগত সাধারণ সম্পাদকের নিঃশ্বাস পড়তে শুরু করে। নানা ভাবে তাঁদের সবাইকে বুঝিয়ে দেওয়া হতে থাকে, ক্ষমতার চাবিকাঠি শুধুই পিসির আঁচলে বাঁধা নেই। ভাইপোর পকেটেও আছে এবং তা দিয়েও ‘সিন্দুক’ খোলা যায়!
ক্রমে ক্যামাক স্ট্রিটে অভিষেকের ঝাঁ-চকচকে, অত্যাধুনিক কৃৎকৌশলে সাজানো অফিসে নেতা-মন্ত্রী-বিধায়কদের আনাগোনা বাড়ে। সেখান থেকে আসা বহু নির্দেশ পালিত হতে থাকে বিনা বাক্যব্যয়ে। একই সঙ্গে শোনা যায়, প্রশাসন ও পুলিশের উপরতলাতেও ক্যামাক স্ট্রিটের ছায়া প্রলম্বিত হচ্ছে। যার সবটাই ভিত্তিহীন নয়।
রাজ্যের শাসক দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অবশ্য সবাইকে ‘ডাকেন’ না। সবাই তাঁর সঙ্গে অনায়াসে যোগাযোগ করতেও পারেন না। বস্তুত তৃণমূলের সর্বময় কর্ত্রী মমতার মতো করে দলের হারু-নাড়ু-হাবলা-পাঁচুর মতো নিচুতলার সাধারণ কর্মীদের সঙ্গে দলের এই শীর্ষ নেতার সরাসরি সংযোগ কতটা, সে প্রশ্ন দলের মধ্যে অনেকেরই।
তবে অভিষেক যাঁকে ডাকেন বা যাঁর সঙ্গে একটু আলাদা কথা বলেন, অন্যদের চোখে সেই নেতা-মন্ত্রীর ‘নম্বর’ বাড়ে! কারণ তাঁর অফিস থেকে আইপ্যাক সংস্থার মাধ্যমে দলের লোকজনের কাজের ‘মূল্যায়ন’ হয়ে থাকে, ভোটে সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকা তৈরি হয় ইত্যাদি। দৃশ্যত এ ভাবেই তৃণমূল এখন দু’টি ঠিকানায় বিভাজিত। একটি হল দলের দফতর, অপরটি ক্যামাক স্ট্রিট। একটি যদি সাইনবোর্ডে হয়, অন্যটি ‘কৌশল’-এ ক্রিয়াশীল।
কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, এ জিনিস কেন এত দিন ধরে চলে এসেছে? সহজ উত্তর, মমতা চলতে দিয়েছেন। মমতা হয়তো ‘আটকাতে’ পারেননি। যেটাই প্রকৃত কারণ হোক, আপাতত বিষয়টি ভিন্ন বাঁকে। দলনেত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রী দুই মমতাই কড়া হাতে রাশ ধরেছেন এবং যা বলছেন তার মর্মার্থ হল, দল ও সরকারের প্রধান তিনি। সিদ্ধান্তও নেবেন তিনিই। উপরন্তু দলের ‘হিসাব পরীক্ষা’ও এ বার থেকে তিনি নিজে করবেন। এর পরেই তৃণমূলে ‘ক্ষমতার সংঘাত’ নিয়ে জল্পনা আরও বড় মাত্রা পেয়েছে।
এ সব অবশ্য বহু-আলোচিত। বিশদ ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। তবে এরই মধ্যে নিজের নির্বাচন কেন্দ্র ডায়মন্ড হারবারে সাংসদ অভিষেকের সাম্প্রতিকতম ‘সেবাশ্রয়’ কর্মসূচি তপ্ত তেলে বেগুন ভাজার পরিস্থিতি তৈরি করে দিল। ধারাবাহিক ভাবে স্বাস্থ্য শিবির খুলে চিকিৎসার ঢালাও বন্দোবস্তকে প্রচারে বলা হচ্ছে, এক ঐতিহাসিক মাইলস্টোন।
রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোতে অবশ্যই বহু গলদ, অনিয়ম, দুর্নীতি রয়েছে। তার প্রতিবাদ ও সমাধান দুটোই জরুরি। কিন্তু সরকারি দলের খোদ শীর্ষনেতার কর্মসূচি রাজ্যের সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে নিশানা করলে তার রাজনৈতিক অর্থ গভীর। বিশেষত মমতাই রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী। অভিষেকের ‘সেবাশ্রয়’-এ তৃণমূল থেকে সদ্য সাসপেন্ড হওয়া চিকিৎসক-নেতা শান্তনু সেনের উদ্যোগী ভূমিকাও একই কারণে প্রশ্ন জাগায়। ব্যাপারটি যেন সরাসরি চ্যালেঞ্জ। যদিও দল এখনও নীরব।
তৃণমূলের একটি দলীয় সভা আসন্ন। শোনা যাচ্ছে, মমতা সেখানে ‘সরব’ হবেন। আগ্রহ থাকবেই। ইতিমধ্যে হাওয়ায় ছড়িয়েছে, অভিষেক নাকি মহারাষ্ট্রের একনাথ শিন্দের মতো দল ভেঙে বেরোতে পারেন! রটনার কতটা ‘ঘটনা’, জানা নেই। তবে এমন গুঞ্জনে কাদের ইন্ধন ও কলকাঠি থাকতে পারে, শিশুর পক্ষেও তার অনুমান সম্ভব।
আবার এও ঠিক, অভিষেক এখনও নিজের জোরে কোনও ভোট জেতাননি। তৃণমূলে ভোটের মুখ আজও মমতা। বাকি সব নেপোয় মারে দই!