বক্সার জঙ্গলে রয়্যাল বেঙ্গল। নিজস্ব চিত্র।
বক্সার জঙ্গলে রয়্যাল বেঙ্গলের দেখা মিলেছে। এর থেকে ভাল খবর এই মুহূর্তে আর কিছু হতে পারে না। বাস্তুতন্ত্রের জন্য তো বটেই, স্থানীয় অর্থনীতির জন্য এই বাঘের দেখা পাওয়া অত্যন্ত ইতিবাচক ভূমিকা নিতে পারে। পাল্টে যেতে পারে বক্সার আর্থ-সামাজিক অবস্থান। বদলে যেতে পারে রাজ্যের বন-মানচিত্রে বক্সার ভূমিকা।
তবে একটা বিষয় কোনও ভাবে ভুললে চলবে না। আগে সংরক্ষণ, তার পরে সব কিছু। ফলে বাঘের সংরক্ষণে কোনও রকমের হেলাফেলা করা উচিত হবে না। আমাদের রাজ্যে দুটো ব্যাঘ্র প্রকল্প রয়েছে। একটি সুন্দরবন, অন্যটি বক্সা। বাঘের কথা উঠলেই কিন্তু গোটা দুনিয়া সুন্দরবনের কথা বলে। বক্সাকেও যদি সেই জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায়, তার থেকে ভাল আর কী হতে পারে!
বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্প তো আজকের নয়। সেই আশির দশকের শুরুর দিকের। কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরেই বক্সায় সরাসরি বাঘ দেখা যায়নি। কয়েক দশক পরে এই প্রথম সশরীরে বাঘের দেখা পাওয়া গেল বন দফতরের ট্র্যাপ ক্যামেরায়। কোনও জঙ্গলে বাঘ আছে কি না, তা মূলত দু’ভাবে বোঝা যায়। প্রথমত, কিছু অপ্রত্যক্ষ প্রমাণের উপর ভিত্তি করে। দ্বিতীয়ত, ট্র্যাপ ক্যামেরা বা পর্যটকের ক্যামেরায় বাঘের সশরীর উপস্থিতি।
অপ্রত্যক্ষ প্রমাণ কী ধরনের? জঙ্গলে কোনও জন্তুর আধখাওয়া দেহাবশেষ পড়ে থাকতে দেখা গেলে মনে করা হয়, ওই জন্তুটিকে বাঘে খেয়েছে। বা বড় বড় গাছের গুঁড়িতে নখ ঘষটানোর দাগ। বাঘ তার নখ আরও ধারালো করার জন্য গাছের গুঁড়িতে আঁচড় কাটে। অথবা বিষ্ঠার ডিএনএ পরীক্ষা বা পায়ের ছাপ। অস্তিত্বের অন্যান্য এই প্রমাণের পাশাপাশি সরাসরিও বাঘ দেখা যায়।
এত দিন বক্সায় বাঘের উপস্থিতির কোনও প্রমাণ সে ভাবে পাওয়া যাচ্ছিল না। প্রশ্ন উঠছিল, তবে কি বক্সায় বাঘের সংখ্যা শূন্য হয়ে গেল? অনেক বিশেষজ্ঞই বলছিলেন, তা হলে ব্যাঘ্র প্রকল্প কেন বলা হবে?
বৈচিত্রের দিক থেকে বক্সার একটা অনন্যতা রয়েছে। তরাইয়ের জঙ্গল থেকে একেবারে পাহাড়— বক্সার বিস্তৃতি অনেক বৈচিত্রময়। অনেকটা জায়গা জুড়ে। বক্সায় অনেক এমন জায়গা রয়েছে, যেখানে পর্যটক কেন, বন দফতরের কর্মীরাও সব সময় যেতে পারেন না। গাড়ি যায় না। ট্রেকিং করে পৌঁছতে হয়। ফলে সরাসরি বাঘের দেখাও মিলছিল না। আবার সুমারিতেও তাদের সংখ্যা খুবই কম। বক্সার সঙ্গে ভুটানের যোগাযোগ ভাল। তবে কি ভুটানের দিকে বাঘ চলে যাচ্ছে? ও দিকটা কি তা হলে বাঘের জন্য বেশি উপযোগী? এমন একটা আশঙ্কা তৈরি হচ্ছিল। ঠিক সেই রকম একটা সময়ে রাজ্যের প্রধান মুখ্য বনপাল (বন্যপ্রাণ) হিসাবে দায়িত্ব নিলেন প্রদীপ ব্যাস। উনিই প্রথম উদ্যোগ নিলেন বক্সাকে বাঘের উপযোগী তৈরি করার। কাজ শুরু হল।
এক সময় বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের ক্ষেত্র অধিকর্তা (ফিল্ড ডিরেক্টর) ছিলেন প্রদীপ। ফলে ডুয়ার্সের ওই অরণ্যের সমস্যা সম্পর্কে তাঁর স্পষ্ট ধারণা ছিল। প্রদীপ অবসর নেওয়ার পর তাঁর জায়গায় এলেন রবিকান্ত সিন্হা। তাঁর পর ভিকে যাদব। এর পর দায়িত্ব নিলেন বর্তমান প্রধান মুখ্য বনপাল (বন্যপ্রাণ) দেবল রায়। তিনি এখনও দায়িত্বে আছেন। এই চার জনের তত্ত্বাবধানে অনেক বছর ধরে বক্সার জঙ্গলকে বাঘের উপযোগী করে তোলার কাজ করা হয়েছে। আর তাতে অনেকটা উপকার হয়েছে বক্সার।
অনেকে বলেন, বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পে প্রচুর সমস্যা। সেখানে গরু চরে বেড়ায়। জঙ্গলের অন্দরে এবং প্রান্তের গ্রামের মানুষের জঙ্গলে আনাগোনা। কিন্তু এমন সমস্যা ভারতের সব বাঘের জঙ্গলে আছে। বান্ধবগড়ের জঙ্গলে। রবেটে রয়েছে। দক্ষিণের জঙ্গলেও সমস্যা আছে। কোথাও সমস্যা বেশি কোথাও কম। জঙ্গলের অন্দরে যে সমস্ত গ্রাম আছে, সেগুলোর বাসিন্দাদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে পুনর্বাসন বলা যতটা সহজ, দেওয়া অতটা সহজ নয়। ফলে নতুন করে আমাদের ভাবতে হবে। পরিকল্পনা করতে হবে।
বক্সায় বাঘের স্থিতিশীল সংখ্যা তৈরি হলে ইকোট্যুরিজমের একটা বিশাল জায়গা তৈরি হবে। যেমন উত্তরাখণ্ডের জিম করবেট জাতীয় উদ্যানের জন্য কাছে ‘গেটওয়ে’ রামনগর এবং রাজস্থানের রণথম্ভৌর জাতীয় উদ্যানের ‘গেটওয়ে’ সওয়াই মাধোপুরের অর্থনীতি পুরোটাই গড়ে উঠেছে বাঘের উপর নির্ভর করে। আমাদের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সব সময় স্বনির্ভর প্রকল্পের কথা বলেন। রাজ্যবাসীকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর কথা বলেন তিনি। বক্সাকে বাঘের উপযোগী একটা জঙ্গলে পরিণত করা গেলে বাঘের সংখ্যা বাড়বে। ইকোট্যুরিজম থেকে আর্থসামাজিক অবস্থা—দুটোই চাঙ্গা হবে।
তবে একটা জিনিস মনে রাখতে হবে। বাঘের সংখ্যা নয়, আরও অনেক বেশি প্রয়োজন অন্য তিনটে বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া এবং নিশ্চিত করা।
১। প্রোটেকশন বা নিরাপত্তা: বাঘকে সব রকম ভাবে নিরাপত্তা দিতে হবে। চোরাশিকারিদের হাত থেকে বাঘকে রক্ষা করতে হবে। জঙ্গল কেটে সাফ না করে বাঘকে সুরক্ষা দিতে হবে। সেটা তখনই সম্ভব, যখন পর্যাপ্ত পরিমাণ বনকর্মী থাকবেন। মান্ধাতার আমলের বন্দুক বা লাঠি দিয়ে বাঘ সুরক্ষা সম্ভব নয়। তাঁদের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র দিতে হবে। নতুন বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক দায়িত্ব নিয়ে সে কথা ঘোষণাও করেছেন।
২। আইসোলোশেন বা নিভৃতবাস: বাঘকে বাঘের মতো করে জঙ্গলে থাকতে দিতে হবে। বাঘের জঙ্গলে বাইরের লোকজনের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হবে। জঙ্গলকে একটা মন্দির ধরে নিয়ে তার গর্ভগৃহকে (কোর এরিয়া) আগলে রাখতে হবে। বনকর্মীদের যাতায়াতের বাইরে কারও আনাগোনা চলবে না।
৩। স্পেস বা বাসস্থান: বাঘের বাসস্থান আমরা না দিতে পারলে তারা থাকবে কী করে? সারা ভারতে জঙ্গল নিধন হচ্ছে। কোথাও বড় প্রকল্পের জন্য। কোথাও বিশাল হাইওয়ের জন্য। জঙ্গল চিরে রাস্তা চলে যাচ্ছে কোথাও। বহু বন্যপ্রাণী গাড়ি চাপা পড়ে মারা যাচ্ছে। বাঘের জায়গায় আমাদের ঢুকলে চলবে কেন!
এই তিনটে বিষয় ভাল ভাবে পালন করতে পারি, তা হলে বাঘ সংরক্ষণ একটা জায়গায় পৌঁছতে পারে। না হলে সবটা মুখ থুবড়ে পড়বে। এর সঙ্গে আরও একটা বিষয়— জঙ্গলবাসী প্রান্তিক মানুষকে সঙ্গে নিয়ে চলতে হবে। মনে রাখা উচিত, বাঘ বাঁচলে জঙ্গল বাঁচবে। জঙ্গল বাঁচলে নদীনালা বাঁচবে। আর নদীনালাই আমাদের বেঁচে থাকার আধার। সুন্দরবনের বাদাবন আছে বলেই কলকাতা শহর এ ভাবে সুরক্ষিত। ঝড়ঝাপ্টা সব তো সুন্দরবন সামলায়! আর সুফল ভোগ করে কলকাতা।
বক্সার জীববৈচিত্র অন্য অনেক নামী জঙ্গলকে টেক্কা দিতে পারে। এক বার এটা শেষ হয়ে গেলে আর তৈরি হবে না। এক বার যখন বাঘের সন্ধান মিলেছে এত বছর পর, সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে বক্সাকে কিন্তু আর রোখা যাবে না। বাঘের ছবি প্রকাশ্যে আসার পর কিছু দিন পর্যটকদের জন্য বক্সার দুয়ার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অনেকের হয়তো অসুবিধা হবে। কিন্তু এটুকু এক বার মেনে নিতে পারলে ভবিষ্যৎ অনেক উজ্জ্বল।
মনে রাখতে হবে, বাঘ বেঁচে থাকলে গোটা বাস্তুতন্ত্রটা সচল থাকবে। সেটা সচল থাকলে গোটা সমাজ উপকৃত হবে। খাদ্যশৃঙ্খলের একবারে উপরে রয়েছে বাঘ। ওই পিরামিডে বাঘ না থাকলে গোটাটাই ভেঙে পড়বে। একটা বাঘের জঙ্গলে যা অবদান, একটা পোকারও তাই, একটা পাখিরও সেটাই। বাস্তুতন্ত্রের জন্য সব কিছুর প্রয়োজন।
বাস্তুতন্ত্র আগে। ইকোট্যুরিজম তার পরে।
(লেখক রাজ্য বন্যপ্রাণ উপদেষ্টা পর্যদের সদস্য। মতামত নিজস্ব)