ফাইল চিত্র।
অনেক সময়ই খ্যাতনামাদের প্রয়াণের অনুষঙ্গে ‘যুগের অবসান’ কথাটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে হয়তো এ কথা যথেষ্ট নয়। পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময়ব্যাপী সক্রিয় রাজনৈতিক জীবনে তিনি চলমান ইতিহাসের সাক্ষী হিসাবে অবশ্যই মান্যতা পাবেন। কিন্তু তারই সঙ্গে স্বীকৃতি পাবে এক বর্ণময়তা, যা তাঁকে আমৃত্যু স্বতন্ত্র এবং উজ্জ্বলতর করে রেখেছে। সুব্রতের প্রয়াণ তাই, এক অর্থে, বিবর্ণতার ‘উদ্যাপন’।
তিনি ছিলেন এমন ব্যক্তিত্ব, যিনি তুমুল বিতর্কেও নিজেকে ঝকঝকে, চকচকে রাখতে জানতেন। চরম সমালোচনার মুখেও পরিহাসের তিরে প্রতিপক্ষকে বিঁধতে পারতেন। এই সহজাত সৌজন্য ও রসবোধ তাঁকে অন্য অনেকের তুলনায় ‘অজাতশত্রু’ করেছে।
তবে এও ঠিক, দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে সুব্রত ‘সুযোগ’-এর স্বার্থে ভারসাম্যের খেলা খেলেছেন অনেক। কখন কোথায় তিনি ব্যক্তিগত ভাবে ‘লাভবান’ হতে পারবেন, হিসাব কষেছেন অবিরত। কখনও তাঁর অঙ্ক মিলেছে, কখনও মেলেনি। কিন্তু রাজনীতিতে সেই চর্চাকে তিনি জীবন্ত রেখেছিলেন।
বাংলার রাজনীতিতে ‘তরমুজ’ স্থান পেয়েছে সুব্রতেরই কারণে। কংগ্রেসে থাকাকালীন তাঁর বিরুদ্ধে সিপিএমের সঙ্গে ‘বোঝাপড়া’ রাখার অভিযোগ তীব্র আকার নিয়েছিল। বাইরে সবুজ, ভিতরে লাল ‘তরমুজ’ তখন তাঁর রাজনৈতিক পরিচিতি হয়ে ওঠে। সুব্রত অকৃত্রিম রসিকতায় পাল্টা বলতেন, ‘‘সবাই খায়। কেউ সরবত করে, কেউ টুকরো করে কেটে!’’
সুব্রতদের আদি নিবাস বর্ধমান জেলায়। পরে তাঁদের পরিবার দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার সারেঙ্গায় বসত করেন। সেখান থেকেই সু্ব্রতের জীবন শুরু। পরিবারের কেউ সক্রিয় রাজনীতি করেননি। বাবা ছিলেন স্কুলশিক্ষক। সুব্রত কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজে পড়তে আসেন। কলেজে এনসিসি করতেন। ময়দানে কুচকাওয়াজে অংশ নিতে গিয়েছিলেন। সেখানে হাজির ছিলেন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। জহুরির নজরে সুব্রতকে তিনি আলাদা করে ডেকে নেন। প্রিয়র হাত ধরে রাজনীতিতে পদার্পণ। সেই থেকে ওঁরা দাদা আর ভাই! তাঁদের সম্পর্কের বাঁধুনি কত দৃঢ় ছিল, বাংলার রাজনৈতিক মহলে আজও তা আলোচনার বিযয়। সুব্রত বলতেন, ‘‘আমার সঙ্গে প্রিয়দার সত্যিকারের ঝগড়া হয়েছে বললে আমার স্ত্রীও বিশ্বাস করবেন না।’’
তখন ষাটের দশক। রাজ্যে কংগ্রেস রাজত্ব টালমাটাল। যুক্তফ্রন্ট তথা সিপিএমের উত্থানের পর্ব চলছে। ছাত্র-রাজনীতিতে যুক্ত হলেন সুব্রত। অল্প দিনেই নিজগুণে তাঁর স্থান হয়ে গেল প্রিয়র পাশে। এক দিকে সিপিএমের বিরোধিতা, অন্য দিকে নকশাল আন্দোলনের মোকাবিলায় প্রিয়-সুব্রত জুটি মজবুত হতে থাকে। ছাত্র-আন্দোলনের মাধ্যমে কংগ্রেসের মূলস্রোতের নিয়ামক হয়ে ওঠেন তাঁরা। বলা হত ‘প্রিয়-সুব্রত ম্যাজিক’।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় হার্ডিঞ্জ হস্টেলে অগ্রজপ্রতিম প্রিয়র সঙ্গে একই ঘরে থাকতেন সুব্রত। সারা দিন রাজনীতি, মিটিং-মিছিল, আন্দোলন, মাঝে মাঝে জেলখানা ঘুরে আসা। মার খেয়ে হাসপাতালেও যেতে হয়েছে বহু বার। খাবার জুটত না রোজ। এক জনের পেট ভরার মতো রুটি তরকারি কখনও প্রিয়-সুব্রত ভাগ করে খেয়েছেন।
প্রেমে পড়েন যখন, প্রিয়র কাচিয়ে রাখা ধুতিপাঞ্জাবি পরে বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করতে যেতেন। মজা করে বলতেন, ‘‘প্রিয়দার জামা আমার ঝুলে ছোট হত। তাই হাত গুটিয়ে নিতাম। সেই অভ্যাস রয়ে গেল। চির কাল পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে পরে আসছি।’’ প্রসঙ্গত, এখন রাজ্যে হাতেগোনা ধুতিপাঞ্জাবি পরা নেতাদের অন্যতম ছিলেন তিনি।
১৯৭১-এ বালিগঞ্জ কেন্দ্র থেকে কংগ্রেস প্রার্থী হিসাবে জিতে প্রথম বিধায়ক হন সুব্রত। ১৯৭২-এ আবার একই কেন্দ্রে একই টিকিটে জয়। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের মন্ত্রিসভায় কনিষ্ঠতম মন্ত্রীও হলেন। প্রথমে তথ্য-প্রতিমন্ত্রী, পরে পুলিশ দফতরেরও ভার পান সিদ্ধার্থশঙ্করের প্রিয়পাত্র সুব্রত।
ইন্দিরা গাঁধীও ব্যক্তিগত ভাবে সুব্রতকে পছন্দ করতেন। সুব্রতের আনুগত্য তিনি বুঝতেন। তার প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে নানা ঘটনায়।
মন্ত্রী হিসাবে সুব্রতের দক্ষতা প্রথম থেকেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সময়ের সঙ্গে যা স্বাভাবিক ভাবে আরও পরিণত হয়েছে। বস্তুত আজ রাজ্যের মন্ত্রিমণ্ডলীতে তাঁর সঙ্গে তুলনীয় প্রশাসক কমই।
কলকাতার মেয়র হিসাবেও সুব্রত উল্লেখযোগ্য ছাপ রেখেছিলেন। পাঁচ বছর ওই পদে ছিলেন তিনি। পদটি যেন পূর্ণ গরিমা অর্জন করেছিল সেই সময়। ট্রেড ইউনিয়ন করেছেন যখন, ধাপে ধাপে নিজেকে উত্তীর্ণ করেছেন আন্তর্জাতিক নেতৃত্বের স্তর পর্যন্ত।
বিধায়ক সুব্রতের দক্ষতাও ছিল নজরকাড়া। পরিষদীয় রাজনীতিকে প্রাণবন্ত করে রাখার কৌশল তিনি জানতেন। বুঝতেন আইনের খুঁটিনাটি। তাই তাঁর উপস্থিতি মাঝে মাঝেই বিধানসভার নিস্তরঙ্গ অধিবেশনকেও ভিন্ন মাত্রা দিতে পারত। কখনও তা বিশুদ্ধ মজার, কখনও শাসককে বিপাকে ফেলার।
১৯৭৭-এ জরুরি অবস্থার পরের ভোটে, কংগ্রেসের দুর্দিনে বালিগঞ্জে হেরে গিয়ে কয়েক বার উত্তর কলকাতার জোড়াবাগানে লড়েছিলেন সুব্রত। পরে চৌরঙ্গি। তৃণমূলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে বালিগঞ্জে ফিরিয়ে আনেন ২০১১ সালে। সেটিই ছিল তাঁর শেষ তিন বারের জেতা কেন্দ্র।
প্রিয় যেমন সুব্রতকে ‘খুঁজে’ নিয়েছিলেন, তেমনই মমতাকে রাজনীতির সামনের সারিতে আনার পিছনে ভূমিকা ছিল সুব্রতের। যোগমায়া কলেজে ছাত্র ইউনিয়ন করা মমতাকে তিনি ডেকে পাঠিয়ে বড় দায়িত্বে বসান। ১৯৮৪-র লোকসভা নির্বাচনে যাদবপুর কেন্দ্রে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বিপক্ষে মমতার নামও সুব্রতই সুপারিশ করেছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কাছে। তবে রাজনীতির জটিল অঙ্কে মমতার সঙ্গে সুব্রতের দূরত্ব তৈরি হয়েছে অনেক বার। মমতা কংগ্রেস ভেঙে তৃণমূল গড়ার সময় প্রথম যাঁরা এসেছিলেন, সুব্রত সে-দলে ছিলেন না। তিনি যোগ দেন আরও বছরখানেক পরে। কখনও মমতার সঙ্গে থেকেছেন, কখনও চলে গিয়েছেন। কটাক্ষে বিঁধেছেন মমতাকে, আবার ফিরেও গিয়েছেন মমতার দলে।
তবু প্রিয়-সুব্রতের মতো সুব্রত-মমতা রসায়ন কখনও তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পর্কে ছায়াপাত ঘটাতে পারেনি। বরং তৃণমূলে পাকাপাকি ফেরার পরে মমতা তাঁকে মন্ত্রী করেছেন টানা তিন দফায়।
পঁচাত্তরে পৌঁছালেও সুব্রত মনে এবং কথায় ছিলেন বেপরোয়া, চিরযৌবনের প্রতিনিধি। ভয় ছিল শুধু ভূতের, আর অন্ধকারের। দীপাবলির আলোয় তাঁর বিদায় তাই এক অদ্ভুত সমাপতন।