Birth Centenary

পান্তাভাত থেকে বিলিতি সুরা

নিজের কাজের চেয়েও নিজের জীবনযাপনে শাঁটুলবাবু আজও বাঙালির একটি বিলুপ্ত যুগের প্রতীক হয়ে আছেন।

Advertisement
আশিস পাঠক
শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০২২ ০৫:৪৫

গত ডিসেম্বরে শতবর্ষ পেরোলেন শাঁটুলবাবু— রাধাপ্রসাদ গুপ্ত। সদ্য-পেরনো কিংবা আসি-আসি-করা অন্য বাঙালিদের শতবর্ষের পাশে এই শতবর্ষটি অন্য রকম। কারণ, এ এক অন্য রকম বাঙালির শতবর্ষ। তাকে ‘রাধাপ্রসাদ গুপ্তের শতবর্ষ’ না বলে ‘শাঁটুলবাবুর শতবর্ষ’ বললে আরও খোলতাই হয়।

নিজের কাজের চেয়েও নিজের জীবনযাপনে শাঁটুলবাবু আজও বাঙালির একটি বিলুপ্ত যুগের প্রতীক হয়ে আছেন। বাঙালির সে যুগ ছিল ব্যক্তিত্বের বহুবর্ণে চিত্রিত। নায়ক হওয়ার বাসনা সে যুগে সবাইকে তাড়া করে বেড়াত না। অনেকেই দিব্য আনন্দে থেকে যেতেন পার্শ্বচরিত্রে। যেমন শাঁটুলবাবু। জীবনভর কত বিচিত্র বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করেছেন, চিন্তা করেছেন। সে সব চিন্তা-চর্চাকে বলা যেতে পারে অনেকটা অহৈতুকী সাধনা। কোথাও লিখবেন বলে বা বক্তৃতায় বলবেন বলে প্রস্তুতির পড়াশোনা নয়, নিজেরই আনন্দে কিছুটা যেন রেনেসাঁস-যুগের উন্মুখতা নিয়ে পড়াশোনা। হয়তো সে জন্যই সেই মনীষার ফসল মিলেছে কমই। তাঁর প্রথম বই যখন প্রকাশিত হয়েছে, তখন তিনি পঁয়ষট্টির কোঠায়, অবসর নিয়েছেন জনসংযোগের চাকরি-জীবন থেকে। বইয়ের নাম কলকাতার ফিরিওয়ালার ডাক আর রাস্তার আওয়াজ। অভিনব বিষয়। আরও অভিনব তাঁর লেখার ধরন। ছত্রে ছত্রে গভীর পড়াশোনার ছাপ। তবু ভূমিকাতেই বলে দিলেন, “আমি এই বই পণ্ডিতি দেখানোর জন্যে নয় মজার জন্যে লিখেছি।”

Advertisement

বস্তুত পণ্ডিত এবং পণ্ডিতম্মন্য বাঙালির ভিড়ে এই মজার বাঙালিই আজ ক্রমশ লুপ্তপ্রায়। ‘মজা’ শব্দটাকেই আমরা খুব লঘু অর্থে দেখি। যেমন, ‘সরস’ শব্দটাকেও। লঘু রচনা, হাসির গল্প এ সবের সঙ্গেই সরস শব্দটাকে জুড়ে দেখতে ভালবাসি আমরা। অথচ, রস শব্দটার সঙ্গে হাস্যরসের কোনও অনিবার্য সম্পর্কই নেই। তাই হয়তো আমাদের গবেষণা মানেই গম্ভীর, শুষ্কং কাষ্ঠং, অনেকাংশে প্রাতিষ্ঠানিকতার খোপে সীমাবদ্ধ।

রাধাপ্রসাদ ছিলেন সে ঘরানার একেবারে বিপ্রতীপে। তাই অনায়াসে প্রথম বইয়ের ভূমিকাতেই লিখতে পারতেন, “খাবার-দাবারে পরিমিত ভেজাল আর ময়লা না থাকলে তার স্বাদ খোলে না। কিন্তু আমার ভারি ভয় যে আমার লেখায় ভেজালের আধিক্য দেখে কেউ কেউ হয়তো এটাকে সখের জলপান না বলে অমৃতলাল বর্ণিত অখাদ্য সাড়ে বত্রিশ ভাজা না ভাবেন।”

বিশেষজ্ঞতার খোপে ক্রমশ বন্দি হতে থাকা বাঙালি-মনন আজ বিচিত্র বিষয়ে আগ্রহ ও উৎসাহমুখর এই সরস ঘরানাটিকে ভুলতে বসেছে। প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণার বাইরেও গবেষণার যে বিপুল বিচিত্র জগৎ, তাকে একদা উজ্জ্বল করে রেখেছিলেন শ্রীপান্থ, রাধাপ্রসাদ গুপ্তের মতো অন্য রকম বাঙালিরা। আজ তা শুধুই স্মৃতি।

তাঁর একটি বিশেষ সংগ্রহ ছিল কলকাতার নানা রেস্তরাঁর মেনু কার্ড। বাঙালির রসনা-সংস্কৃতি ছিল তাঁর বিশেষ আগ্রহের বিষয়। আক্ষরিক অর্থেই রসে-বশে থাকা মানুষ শাঁটুলবাবুর আতিথ্য এখনও স্মরণীয় হয়ে আছে চিত্রপরিচালক গৌতম ঘোষের, শাঁটুলদার বাড়িতে ‘পোখল দুপুর’ অনেকের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। আমারও সৌভাগ্য হয়েছিল দু’-এক বার যাওয়ার। পোখল বা পান্তাভাত কী ভাবে খেতে হবে, তিনি বলে দিতেন অতিথিদের।

পুরনো কলকাতার কথা, কালীঘাট পট, কমিক্স, পুরনো পঞ্জিকা— বিচিত্র আগ্রহ নিয়ে বেঁচেছিলেন শাঁটুলবাবু। অনেকের কাছেই তিনি ছিলেন চলমান বিশ্বকোষ। অনেকেরই তাই আক্ষেপ, তাঁর পাণ্ডিত্য যদি আরও বেশি লেখায় প্রকাশ পেত! আসলে রাধাপ্রসাদও হয়তো রবীন্দ্রনাথের বিচিত্র প্রবন্ধ-র সেই পনেরো আনা প্রবন্ধের মতো করে ভাবতেন, “জীবন বৃথা গেল! বৃথা যাইতে দাও! অধিকাংশ জীবন বৃথা যাইবার জন্য হইয়াছে! এই পনেরো-আনা অনাবশ্যক জীবনই বিধাতার ঐশ্বর্য্য সপ্রমাণ করিতেছে।”

এই সূত্রেই ফেলুদার সিধুজ্যাঠার সঙ্গে শাঁটুলবাবুর চরিত্রের একটা মিল রয়েছে। অনেকের মতে, ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাধাপ্রসাদ গুপ্তের ছায়াতেই সত্যজিৎ রায় সিধুজ্যাঠা চরিত্রটি সৃষ্টি করেছিলেন, যিনি অনেক কিছু করলেই অনেকের পসার জমত না। তাই তিনি কিছুই না করে শুধু মনের জানলাগুলো খুলে রেখেছিলেন।

রাধাপ্রসাদের পনেরো আনা অবশ্য বৃথা যায়নি। তিনটি বাংলা বই (কলকাতার ফিরিওয়ালার ডাক আর রাস্তার আওয়াজ, মাছ আর বাঙালি এবং স্থান কাল পাত্র) আর কিছু ছড়ানো-ছিটানো লেখা (যার অনেকগুলি সঙ্কলিত হয়েছে শাঁটুলবাবু বইয়ে) ছাড়া তাঁর নিজের সৃষ্টি আর নেই ঠিকই, কিন্তু তাঁর আদ্যন্ত বাঙালি অথচ আন্তর্জাতিক জীবনযাপন আজও কিংবদন্তির মতো স্মরণীয় হয়ে আছে। পান্তাভাত থেকে শৌখিন বিলিতি সুরা পর্যন্ত সে যাপনের বিস্তার। তাঁর জন্মশতবর্ষ-অতিক্রান্ত বাঙালির এই মরা সময়ে তার আলাপ ফিরে ফিরে বাজবে।

আরও পড়ুন
Advertisement