ছোটবেলায় ফট ফট করে ক্যাপ ফাটানো আমাদের অনেকেরই অভ্যাস। ঈষৎ বারুদের গন্ধ, হাতে পিস্তল— কুকুর-বিড়ালকে ভয় পাওয়ানো বা ক্ষমতার মজা রক্তে প্রবাহিত হয় অজানতেই। শরীরে বড় হয়েও সেই মোহ ছাড়ে না।
মনে পড়ছে, এক বৃদ্ধা তাঁর নাতনিদের অ্যাকশন মুভি দেখার শখ বরদাস্ত করতে পারতেন না। বলতেন, অপসংস্কৃতি। পর্দায় এত হিংসার চাষ, তা সে দুমদুম, ফটাস ফটাস, যা-ই হোক না কেন, কী করে তা ভাল লাগতে পারে, তা ভেবেই অবাক হতেন তিনি।
সকলে তাঁর মতো করে ভাববেন, এমন ভাবার কারণ নেই। খেলনা হিসাবে ছোটদের, বিশেষত ছেলেদের হাতে স্টেনগান, খেলনা পিস্তল তুলে দেওয়া, দোলে পিস্তল-পিচকারি কেন, এ প্রশ্ন এক সময় উঠত— আর এখন তা জনপরিসরে চর্চার বিষয় বিশেষ নয়। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচ হলেই তখন লেখা হত মহারণ, ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ তার পরেও বহু বছর যুদ্ধের মর্যাদা পেয়ে এসেছে। তা নিয়ে কোনও বলার মতো তর্ক-বিতর্ক হয়নি। এক জায়গায় ভার্চুয়ালি জড়ো হয়ে মানুষকে, থুড়ি, ‘শত্রুকে খতম’ করার খেলা যখন প্রবল হয়ে উঠেছে, তখন মাঝে মাঝে তা নিয়ে তর্ক হয় বটে, কিন্তু ওই মাঝেমধ্যেই। হিংসা আমাদের রক্তে মিশে গিয়েছে। আমরা তাকে বাড়িয়ে চলেছি। মাঝেমধ্যে তর্ক বা প্রশ্নের সাধ্য কি তাকে থামায়? রবি ঠাকুরকে অনুসরণ করে মাঝেমধ্যে ‘এত রক্ত কেন’ বলে চিৎকার করা আমাদের অভ্যাস, যেমন অভ্যাস রাস্তায় চোর ধরা পড়লে চড়চাপড় মেরে আসা বা ইদানীং গাছে বা পোস্টে বেঁধে পেটানো, এমনকি গলায় পা তুলে দেওয়া। খলনায়ক ‘ইয়ে হাত মুঝে দে দে ঠাকুর’ বলে তরবারির কোপ মারলে দীর্ঘশ্বাস পড়ে, আর নায়ক খলনায়কের গলায় পা তুলে দিলে হাততালি। শুধু পর্দায় নয়, জীবনেও।
হিংসা, লড়াই, যুদ্ধের ধ্বনি আমাদের রক্তকে উত্তেজিত করে। সে কারণে ভোট এলে মহাসড়কের উদ্বোধন করতে দেশের প্রধানমন্ত্রী সামরিক পরিবহণ বিমানে অবতরণ করেন। এবং বলেন, “একটু পরেই আমরা দেখব, আপৎকালীন পরিস্থিতিতে কী ভাবে এই এক্সপ্রেসওয়ে বায়ুসেনার বড় শক্তি হয়ে ওঠে। সমস্ত যুদ্ধবিমান যখন গর্জন করবে, যাঁরা দশকের পর দশক দেশের প্রতিরক্ষা পরিকাঠামো নির্মাণকে কোনও গুরুত্বই দেননি, তাঁদের কানেও তা পৌঁছবে।”
কী অদ্ভুত! যুদ্ধবিমানের গর্জন শুধু অন্য দেশকে শোনানোই নয়, দেশের মানুষ এবং ভোটে প্রতিপক্ষকেও শোনানো। পুরোটাই সুচতুর দৃশ্য-মোহ তৈরি করে।
খেতে পাই বা না-পাই, ‘শত্রু’র নির্মাণে আমাদের অ্যাড্রিনালিনের তেজ বেড়ে যায়। এ অনেকটা সেই ডিমের মতো দেখতে পাথর দিয়ে নুন-ঝোল তৈরি করা— পাথরটা দেখব, আর তাকে রক্তবর্ণ মশলাদার ডিম বলে ভাবতে ভাবতে লালায় বাকি ভাত মেখে খেয়ে ফেলব। লঙ্কা দিয়ে হুশহাশ করে ভাত খাওয়ার মতো লিখতে গিয়েও লেখা গেল না, কারণ, ইদানীং লঙ্কারও খুব দাম। তাতে কেন্দ্রীয় সরকারের কিছু এসে যায় না— করোনা আবহে তারা কেন দরিদ্রের জন্য রান্নাঘর খুলতে পারে না, সেই জবাব দেওয়ার প্রয়োজনও নরেন্দ্র মোদীর সরকার বোধ করেনি। কারণ, তাদের হাতে যুদ্ধবিমান আছে। হেলিকপ্টারের শব্দ শুনলে অনেকেই এখনও হাঁ করে আকাশের দিকে তাকাই। যুদ্ধবিমান দেখলে তো কথাই নেই। একের পর এক যুদ্ধবিমান মহাসড়কে নামছে, গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে ভাবতে।
অনেকেই বলবেন, দেশের প্রতিরক্ষার কি দরকার নেই? নিশ্চয় আছে। কিন্তু তা ভোট এলেই দেখাতে হবে কেন? দেখানোই বা হবে কেন? প্রজাতন্ত্র দিবসে সামরিক কুচকাওয়াজে দেশের সামরিক শক্তিকে তুলে ধরা, দেশের মানুষের সামনে প্রতিরক্ষার এবং গর্বের বোধ তৈরি করা এবং জাতীয়তাবোধের জিগির তৈরি করার সুচতুর কৌশল রয়েছে। তবে দূরদর্শনে মৃদু, তথ্যসমৃদ্ধ ধারাবিবরণীর সঙ্গে চিৎকৃত সাংবাদিকতার যে তফাত, তা সরকারের কাজেকর্মেও প্রকট। সারা দেশেই যা এক ভয়ঙ্কর চালচিত্রের মতো বিরাজমান। জাতীয় পতাকার গর্ব যখন তার ধারক দণ্ডটির উচ্চতার উপর নির্ভর করে, দেশের শীর্ষ প্রশাসকের কৃতিত্ব যখন ছাতির হিসাবে নিরূপিত হয়, তখন দেশের মানুষের অপুষ্টি, ক্ষুধা পিছনের সারিতে চলে যাবে, তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই।
বিপদ হল, আমরা বিস্মিত হতে ভুলেও গিয়েছি। কারণ, হিংসার প্রবাহে ভেসে চলেছি। দোকানে দোকানে খেলনা পিস্তল, গণপ্রহার, সালিশি, মোবাইল গেমে যুদ্ধ এবং খতমের খেলার জনপ্রিয়তা আমাদের যে মানসিকতাকে নগ্ন করে জনউঠোনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, তা নিখাদ হিংসারতি।
রবীন্দ্রনাথের ‘কর্ণ-কুন্তী সংবাদ’-এ কর্ণ বলছেন: “আজি এই রজনীর তিমিরফলকে/ প্রত্যক্ষ করিনু পাঠ নক্ষত্র-আলোকে/ ঘোর যুদ্ধ-ফল। এই শান্ত স্তব্ধ ক্ষণে/ অনন্ত আকাশ হতে পশিতেছে মনে/ জয়হীন চেষ্টার সংগীত, আশাহীন/ কর্মের উদ্যম— হেরিতেছি শান্তিময়/ শূন্য পরিণাম। যে পক্ষের পরাজয়/ সে পক্ষ ত্যজিতে মোরে কোরো না আহ্বান।”
নক্ষত্রআলোকে ‘শান্তিময় শূন্য পরিণাম’ পাঠ করার মতো মনন, মানসিকতা যাঁরা লালনই করি না, তাঁরা শুধু জয়ী-ই হতে চাইব এবং জয়ের সোজা রাস্তায় কিস্তিমাত করতে চাইব, তাতে আর আশ্চর্য কী? তা সে রাজাই হই আর প্রজাই হই!