Contractual Workers

চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে নানা প্রশ্ন

সুপ্রিম কোর্টে শুনানি-পর্বে রাজ্য সরকারের কৌঁসুলি জানান, সরকারি হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজগুলিতে চিকিৎসকদের নিরাপত্তা বিধানে প্রায় হাজার দেড়েক চুক্তিভিত্তিক কর্মী নিয়োগ করা হবে এবং তাঁদের এক সপ্তাহের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।

Advertisement
তূর্য বাইন
শেষ আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৯:১১

আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তার-ছাত্রীর নৃশংস ধর্ষণ ও হত্যার পরে প্রথম যে সন্দেহভাজন কলকাতা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন, তিনি এক জন সিভিক ভলান্টিয়ার অর্থাৎ চুক্তিভিত্তিক পুলিশকর্মী। পরে জানা গেছে, হাসপাতালের মধ্যে একটা পুলিশ ক্যাম্প থাকলেও সেখানকার চিকিৎসক, চিকিৎসাকর্মী ও রোগীদের নিরাপত্তার দায়িত্ব মূলত চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের উপরেই ন্যস্ত। এর পর থেকে চুক্তিভিত্তিক কর্মী নিয়োগের পদ্ধতি, নিযুক্তদের দায়বদ্ধতা, সততা ও দক্ষতা নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।

Advertisement

সুপ্রিম কোর্টে শুনানি-পর্বে রাজ্য সরকারের কৌঁসুলি জানান, সরকারি হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজগুলিতে চিকিৎসকদের নিরাপত্তা বিধানে প্রায় হাজার দেড়েক চুক্তিভিত্তিক কর্মী নিয়োগ করা হবে এবং তাঁদের এক সপ্তাহের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। মাননীয় বিচারপতিরা রাজ্য সরকারের এই সিদ্ধান্তের শুধু তীব্র সমালোচনাই করেননি, স্থায়ী পুলিশকর্মীদেরই যে নিরাপত্তার দায়িত্ব দিতে হবে, এমন অভিমতও ব্যক্ত করেছেন।

সরকারি কাজে, সামরিক প্রতিরক্ষাতেও ব্যয় সঙ্কোচে চুক্তিভিত্তিক কর্মী নিয়োগের নিরীক্ষা নতুন নয়। বিশ্বের বহু দেশে কয়েক শতাব্দী আগে থেকে ন্যূনতম খরচে সর্বোচ্চ পরিষেবা আদায়ে স্থায়ী কর্মীর পরিবর্তে চুক্তিভিত্তিক কর্মীরা নিযুক্ত হয়ে আসছেন। যুদ্ধের সময় ‘ভাড়াটে সেনা’ নিয়োগের ভূরি ভূরি উদাহরণ রয়েছে। ১৭৮১ সালে আমেরিকান কংগ্রেসের প্রশাসনিক কার্যালয়ে নবগঠিত ‘সুপারিনটেন্ডেন্ট অব ফাইনান্সেস’ পদে সর্বসম্মত ভাবে নিযুক্ত হন রবার্ট মরিস। সেনায় সামরিক পরিষেবা ও পণ্য সরবরাহের জন্য দরপত্র আহ্বানের সূচনা করে, যুদ্ধকালে জরুরি পণ্য ও সামরিক পরিষেবা পাওয়ার এটাই সবচেয়ে সস্তা, নিশ্চিত ও সর্বোত্তম পদ্ধতি বলে দাবি করেন তিনি। পরবর্তী প্রায় ষাট বছর নানা পরিবর্তন-পরিমার্জনের মধ্য দিয়ে এই অসরকারি ব্যবস্থা চলেছিল। পরে প্রমাণিত হয়, এই ব্যবস্থা শুধু সীমাহীন দুর্নীতিরই উৎস নয়, জনসাধারণের দুর্ভোগেরও অন্যতম উৎস।

তার পরেও কখনও শাসকের পছন্দের মানুষকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার তাগিদে, প্রশ্নহীন আনুগত্য নিশ্চিত করতে, বা নিছকই ‘সস্তায় পুষ্টি’-র লোভে চুক্তিভিত্তিক কর্মী নিয়োগ চলে আসছে। সাম্প্রতিক অতীতে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দফতরে আইএএস পদমর্যাদার সমতুল বেশ কিছু চুক্তিভিত্তিক ‘বিশেষ সচিব’ ও প্রতিরক্ষা দফতরে ‘অগ্নিপথ’ প্রকল্পে চার বছরের চুক্তিতে ‘সেনা’ নিয়োগের ঘোষণা শোনা গিয়েছে।

আসা যাক রাজ্যের প্রসঙ্গে। বাম আমল থেকেই এ রাজ্যে ‘ডেটা এন্ট্রি অপারেটর’, ‘সিস্টেম অ্যাডমিনিস্ট্রেটর’-সহ বেশ কিছু কাজে ও পদে চুক্তিভিত্তিক কর্মী নিয়োগ শুরু হয়। সময় যত এগিয়েছে, শূন্য পদে স্থায়ী কর্মী নিয়োগ মুলতুবি রেখে চুক্তিভিত্তিক কর্মী নিয়োগের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাম শাসনের অন্তিম লগ্নে চতুর্থ শ্রেণির কর্মী নিয়োগের জন্য পশ্চিমবঙ্গ পাবলিক সার্ভিস কমিশন গৃহীত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মেধা তালিকা থেকে কিছু নিয়োগ হয়। তার পর থেকে চতুর্থ শ্রেণির কর্মী নিয়োগের উদ্যোগ তেমন দেখা যায়নি। অবশ্য সরকারি নিয়মানুযায়ী প্রতি বছর প্রতিটি দফতরের মন্ত্রীর তিন জন করে ‘অ্যাটেন্ড্যান্ট’ চতুর্থ শ্রেণির কর্মী হিসাবে নিযুক্ত হয়ে আসছেন। এ ছাড়া কর্মরত অবস্থায় মৃত সরকারি কর্মীর পরিবার থেকেও ‘কম্প্যাশনেট গ্রাউন্ড’-এ এক জন চতুর্থ শ্রেণির পদে চাকরি পান, যদিও প্রয়োজনের তুলনায় সব মিলিয়ে সংখ্যাটা সীমিত। ক্লার্কশিপ-সহ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নানা পদে নিয়োগে পিএসসি-র পরীক্ষাগুলি অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। একই অবস্থা স্কুল বা কলেজ সার্ভিস কমিশনেরও। কিছু কিছু পরীক্ষা হলেও স্বচ্ছতার প্রশ্নে নানা আইনি জটিলতায় নিয়োগ আটকে আছে।

অধিকাংশ সরকারি দফতরে শূন্য পদ ক্রমবর্ধমান। পাশাপাশি সরকারের কাজের পরিধিও তুলনায় যথেষ্ট বেড়েছে। গত বেশ কয়েক বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গে একের পর এক নতুন জনকল্যাণমূলক প্রকল্প চালু হয়েছে। বিপুল কাজ সামলাতে ‘মেড ইজ়ি’ হয়ে উঠেছে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ।

শুরু থেকেই এর স্বচ্ছতা নিয়ে নানা প্রশ্ন। সিভিক ভলান্টিয়ার-এর মতো পদে পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ হলেও তার পদ্ধতি ও স্বচ্ছতা নিয়ে আদালতে সমালোচনা হয়েছে। পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নানা দফতরে এজেন্সির মাধ্যমেও বহু চুক্তিভিত্তিক কর্মী নিযুক্ত হয়েছেন। এঁদের ক্ষেত্রে না হয়েছে যোগ্যতা নির্ণায়ক পরীক্ষা, না হয়েছে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স। বিরোধীদের অভিযোগ, বেছে বেছে শুধু শাসক দলের অনুগামীদেরই নিয়োগ হয়েছে। আবার বেশ কিছু বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, কেন্দ্র ও বিভিন্ন রাজ্য নানা বড় পদে পুনর্নিয়োগ করে চলেছে সরকারি অবসরপ্রাপ্ত আমলা ও বিচারব্যবস্থার সঙ্গে যুক্তদের একাংশকে। এঁদের অধিকাংশ চাকরিরত অবস্থায় শাসকের আস্থাভাজন ছিলেন, এমন কথাও উঠেছে। অগ্রজপ্রতিম অনুগৃহীতদের সাফল্যে প্রাণিত হয়ে পদস্থ আধিকারিক থেকে সাধারণ কর্মীরা যদি মেয়াদ শেষে পুনর্নিয়োগের যোগ্যতা অর্জনে প্রতিযোগিতায় নামেন, তবে বিচার বা প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত ও তার রূপায়ণ পক্ষপাতদুষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ও অবসরপ্রাপ্তদের পুনর্নিয়োগ যে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও দক্ষ প্রশাসনের পরিপন্থী, এই ধারণা তাই একেবারে অমূলক নয়।

আরও পড়ুন
Advertisement