Durga Puja 2024

চিত্তবিনোদনকারী বাড়াবাড়ি

চাই জৌলুস, জাঁকজমক, আশকারা— সর্বোপরি ভোগের মহা আয়োজন যা কিনা দেখিয়ে সাজিয়ে, রূপে তোমায় ভোলাবে।

Advertisement
শ্রীদীপ
শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০২৪ ০৮:৩৪

Sourced by the ABP

সে  দিন যোধপুর পার্কে গিয়ে চমকে উঠলাম। অবাক কাণ্ড, ক্লাব প্রাঙ্গণ জুড়ে বস্তি। প্রথমে ভাবলাম বুঝি ক্লাব কর্তারা সহৃদয় হয়ে গরিবদের জন্য আবাসন বানিয়েছে। তার পর কাছে গিয়ে বুঝলাম, না, এ তো দুর্গাপুজোর থিম। এ কি কল্পনা শক্তির দারিদ্র; না কি দারিদ্রের প্রতি বিদ্রুপ; না কি শ্রেণিবিরুদ্ধ কোনও আচরণ? অবশ্য অন্য ভাবে দেখলে, রাজপ্রাসাদ, মিশর, ইলোরা, ডিজ়নি, বুর্জ-খলিফা, বাহুবলীর দুর্গ যদি দুর্গার আবাস হতে পারে তবে বস্তিই বা নয় কেন?

Advertisement

মোদ্দা কথা হল, চমক চাই। শুধু ‘উৎসবে ফিরলেই’ তো আর হবে না। চাই জৌলুস, জাঁকজমক, আশকারা— সর্বোপরি ভোগের মহা আয়োজন যা কিনা দেখিয়ে সাজিয়ে, রূপে তোমায় ভোলাবে। থিম-বিরোধী মানুষজন যাঁরা সাবেক পন্থায় পূজায় বিশ্বাসী, তাঁরা একটা সহজ বাণিজ্যিক দর্শন বুঝতে চান না। পণ্য সে যা-ই হোক না কেন, তাকে কেবলমাত্র তার উপযোগিতার ভিত্তিতে বেচাকেনা নাই হতে পারে। ঠিক যে কারণে স্কুলের নাম হয়ে যায় অক্সফোর্ড। গ্রামীণ জমি-গেলা হোটেলের নামকরণ হয় ইকো-ভিলেজ। জঙ্গল সাফ করে বিলাসবহুল কংক্রিটের প্রমোদব্যবস্থার নাম ‘রেনফরেস্ট’। ট্রাম উঠে যাওয়া শহরে, ট্রাম ডিপো ভেঙে, সেখানে তৈরি মলের মধ্যে রেস্তরাঁয় পাই প্রাক্তন ট্রাম-ডিপোর প্রতিরূপ। ভেনিসের আদলে নির্মিত হয় একটা গোটা মল। অকেজো এরোপ্লেন-এর ভিতর তৈরি হয় আমোদের ব্যবস্থা।

নুন, তেল, সাবান, প্রসাধন, পোশাক বা তোশক বিক্রি করতেও প্রয়োজন হয় স্বপ্নের, উদ্ভট কল্পনার, চমকপ্রদ রূপকের। কারণ পণ্যের ক্রিয়ামূলক তাৎপর্যটা খুবই সোজাসাপ্টা, সেটা বেজায় ‘বোরিং’। তাকে প্রলুব্ধকারী আবেশে মুড়ে ফেলাই বাজার, বিজ্ঞাপন ও বিপণনের মূল কাজ। একঘেয়ে কেজো ব্যাপারটা ছাড়া পণ্য বা পরিচর্যা আমাকে আর কী অভিজ্ঞতা প্রদান করতে পারে? কী ভাবে পণ্য আমায় ব্যাকুল করতে পারে? বা অন্য কোন অনুভূতির আশ্লেষে উত্তেজিত করার বিজ্ঞাপন দেয় পণ্য? তার ভিত্তিতেই কিন্তু আপনি অনেক সময় এটা সেবন না করে অন্যটা করেন, বা ওটার প্রতি আকৃষ্ট হন। গোটাটাই প্যাকেজিং-এর খেলা। পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড— পুজোর ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হবে, তা ভাবার কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই।

তাই প্রয়োজন থিম, তা সে যতই অভিনব হোক বা একঘেয়ে। হাবে, ভাবে, রঙে, স্থাপত্যে, নির্মাণে— সে পুজোকে কেন্দ্র করে, মূল পুজো থেকে ভিন্নমুখী করবে, এমনই তার বাজারি বহুমুখী প্রতিভা। ধার্মিক প্রেক্ষাপট পেরিয়ে, সে রূপে, সাজে, নন্দনে, মেজাজে ভোলাবে। সে আপনাকে কেনাবে, রাত জাগাবে, খোশখেয়ালে মাতিয়ে রাখবে— তবে না আপনার মনে হবে উৎসবে আছি— প্রাত্যহিকতা ছেড়ে বাঁচি— মহালয়া থেকে লক্ষ্মীপুজো অবধি। থিম আর কিছুই না, আপনার আমার মানসিক অবস্থার স্বচ্ছ, সজীব, উন্মুক্ত প্রতিফলন মাত্র। থিম কোনও ঘেরাটোপ বা চক্রান্ত নয়। সে এক স্বল্পস্থায়ী, আবেদনকারী, সাময়িক আতিশয্য যা আপনি ভোগ করেন; যা কোটি মানুষের জীবিকার উৎস; যা বহুমাত্রিক পণ্য ঘিরে এক সম্মিলিত প্রয়াস।

থিম— অর্থনৈতিক উদারীকরণ-উত্তর এক প্রচলন। আশির দশকে ক’টা থিমপুজো হত আর এখন কটা হয়? থিমের আবির্ভাব ও জনপ্রিয়তার মূলে রয়েছে আমাদের পাল্টে যাওয়া ক্রেতা-রুচি। শুধু ভক্তি, প্রতিমা, প্রসাদ আর যথেষ্ট নয়। তাতে আর ক্রেতাচিত্ত ভিজছে না। মোরে আরও আরও আরও দাও সুখ— ইন্দ্রিয় সুখ। দেখাও মূল আয়োজনের প্রান্তে আর কী কী সামগ্রীর সম্মেলন ঘটিয়েছ। মূল বিবর্তিত বাণিজ্যিক দর্শনটি হল, চিরাচরিত দৈনন্দিন কেজো সব কিছুর বাইরে, পণ্য আর কী অতিরিক্ত অনুভূতি, আকুলতা ও অভিজ্ঞতার সঞ্চার করতে পারছে— যেটা চাকচিক্যবহুল এবং দৃশ্যগত? সেই চিত্তবিনোদনকারী বাড়াবাড়ির মধ্যেই এখন নিহিত উৎসবের অর্থ, পরিচিতি, স্মৃতি, ব্যাকুলতা, আবেগ ইত্যাদি। সেই বাসনা উদ্রেককারী বস্তুবাদের নামই কেনাকাটি, মেতে থাকা, মজে থাকা। সেই প্রশ্রয়ই সকল থিমের মূল প্রেক্ষাপট— যেখানে সকল থিম এসে একত্র হয়। আপনি দিব্যি খেলার ছলে সেলফিমগ্ন হয়ে লাফিয়ে বেড়াবেন এ থিম থেকে সে থিম। গুনবেন কটা থিম-দর্শন হল আজ। জানবেন থিম একটাই যার নাম প্রাচুর্য; সেখানে আধিক্যই প্রধান— বাকিটা সাদামাটা। প্রতুলতা না থাকলে আপনি বাজারেই নামতেন না হয়তো, সকালে অঞ্জলি দিয়ে সন্ধ্যায় টিভিতে ঠাকুর দেখতেন।

গবেষণা জানাচ্ছে, অধিকাংশ পুজোর বাজেটের ষাট শতাংশ বরাদ্দ প্যান্ডেল ও আলোকসজ্জায়। আর পুজোর খরচ দশ শতাংশেরও নীচে। দেবী ও তার আরাধনা অনেক দিন আগেই ব্যাক-বেঞ্চে চলে গিয়েছে, নব্বই দশকের গোড়ার দিকে। দেবীকে ঘিরে অন্য-যা-কিছু, সেটাই প্রাথমিক। সেই ‘অন্য-যা-কিছু’র বাজারি প্রাঙ্গণেই মূল মণ্ডপের প্রতিষ্ঠা। সেখানেই বাহ্যিক বাজার ও আপনার ভিতরকার উপভোগ-বিলাসী ক্রেতাসত্তার মিলন ক্ষেত্র। বাসনা সেখানেই এসে দর্শন চায়, আর আপনি ভাবেন আপনি থিম দেখছেন। বিগত পঁয়ত্রিশ বছরে ক্রেতার মনন আমূল পাল্টেছে— তারই প্রতিফলন থিম। প্রতিবাদ, পরিযায়ী-শ্রমিক, বস্তি, সঙ্কট, মণিপুর, মায়াজাল, মেঘে ঢাকা তারা, চন্দ্রায়ণ, সুকুমার, মায়ের আঁচল, মাথার গামছা, অনুনাদ, আর্তনাদ— থিম সে যাই হোক— সকলই ভোগ্যপণ্যের বিষয়।

আরও পড়ুন
Advertisement